
পূর্ব শত্রুতা, আধিপত্য বিস্তার, জমিজমা বিরোধ, আর্থিক লেনদেন ও পারিবারিক কলহে রক্তাক্ত শরীয়তপুর; প্রতিমাসে গড়ে তিনটির বেশি হত্যাকাণ্ড। শরীয়তপুরে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতিতে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে সাধারণ মানুষ। মাত্র আট মাসে জেলায় সংঘটিত হয়েছে ২৬টি হত্যাকাণ্ড। পূর্ব শত্রুতা, আধিপত্য বিস্তার, জমিজমি বিরোধ, আর্থিক লেনদেন, পারিবারিক কলহসহ নানা কারণে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটছে। গড়ে প্রতি মাসে তিনটির বেশি খুনের ঘটনা ঘটায় জেলার মানুষ এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
শরীয়তপুরে গত আট মাসে একের পর এক নৃশংস হত্যাকাণ্ডে জেলাজুড়ে তৈরি হয়েছে চরম নিরাপত্তাহীনতা ও আতঙ্কের পরিবেশ। পূর্ব শত্রুতা, আধিপত্য বিস্তার, পারিবারিক ক্ষোভ, আর্থিক লেনদেন কিংবা জমিজমা বিরোধসহ নানা কারণে ঘটে চলেছে হত্যাকাণ্ড। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত মাত্র আট মাসে জেলায় সংঘটিত হয়েছে ২৬টি হত্যাকাণ্ড।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, শরীয়তপুর সদর উপজেলায় ৫টি, নড়িয়ায় ৩টি, জাজিরায় ৫টি, ভেদরগঞ্জে ৪টি, গোসাইরহাটে ৫টি এবং সখিপুর থানায় ৪টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এসব হত্যার মধ্যে জমিজমা বিরোধ থেকে ঘটেছে ৩টি, টাকা-পয়সা লেনদেনের জেরে ৩টি, পারিবারিক কলহ থেকে ৭টি, ডাকাত সন্দেহে ৪টি এবং অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে আরও ৪টি।
পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, জেলার আটটি থানার মধ্যে ছয়টিতেই প্রতি মাসে খুনের মামলা রুজু হচ্ছে। গড়ে প্রতি মাসে তিনটির বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটছে শরীয়তপুরে, যা জেলার মানুষের মধ্যে গভীর উদ্বেগ ও আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।
অপরাধ বিশ্লেষক ও সচেতন মহল মনে করেন, সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেই মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। সামান্য তুচ্ছ ঘটনায়ও মারামারি থেকে শুরু করে হত্যার মতো ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা বলছেন, জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভয়াবহভাবে অবনতির দিকে যাচ্ছে। শহরমুখী শিক্ষার্থীরা সর্বক্ষণ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে, কখন কোথায় কী ঘটতে পারে সেই অনিশ্চয়তায় তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে।
এ বিষয়ে জাজিরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজের শিক্ষার্থী শাওন আলম বলেন, “এখন শরীয়তপুরে নিরাপত্তা বলতে কিছু নেই। সন্ধ্যার পর বাসা থেকে বের হতে ভয় লাগে। অপরাধীরা যে কোনো মুহূর্তে কোথাও হামলা করতে পারে, এ আশঙ্কা নিয়ে আমাদের দিন কাটছে।”
জাজিরা উপজেলা প্রেসক্লাবে যুগ্মসাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহিম বলেন, শরীয়তপুরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমেই উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে।আমি যখন আমার কাজে বের হই জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় থাকি সেই সাথে আতঙ্কিত থাকে আমার পরিবার দ্রুত আইন-শৃঙ্খলা পরস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলে শরীয়তপুর হয়ে উঠবে আতঙ্কের নগরী।
স্থানীয়দের অভিযোগ, জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রভাবশালী শক্তি রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে নানা অপকর্ম চালাচ্ছে। সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, আবার কেউ প্রতিবাদ করতে গেলেই ভয়ঙ্কর পরিণতির শিকার হতে হচ্ছে। ছোট ছোট বিরোধ মেটানোর পরিবর্তে তা দ্রুত হত্যাকাণ্ডে রূপ নিচ্ছে।
শরীয়তপুর জেলা দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট মনিরুজ্জামান দিপু বলেন, “একটি হত্যাকাণ্ড শুধু ভুক্তভোগী পরিবারকেই ধ্বংস করে না, অপরাধীর পরিবারকেও নিঃস্ব করে দেয়। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে, আইন নিজের হাতে নেয়া যাবে না। বড়দের অপরাধ শিশুদের মধ্যে প্রবেশ করছে, কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে। এতে সমাজে অপরাধ আরও বেড়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সমাজের সবাইকে পুলিশের পাশে দাঁড়াতে হবে।”
শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার মো. নজরুল ইসলাম বলেন, “প্রত্যেকটি মামলা আমরা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছি। ২৬টি হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ৪টিতে অভিযোগপত্র দাখিল হয়েছে, ২টির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে এবং বাকি ২০টি মামলা তদন্তাধীন। স্বচ্ছতার সঙ্গে আমরা কাজ করছি। তবে পুলিশকে কার্যকরভাবে সহযোগিতা করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যেকোনো ঘটনায় আগে পুলিশকে জানাতে হবে, কোনোভাবেই আইন নিজের হাতে নেয়া যাবে না।”
জেলার সচেতন নাগরিকরা মনে করছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ, প্রশাসন এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের আরও কঠোর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। অপরাধ দমন ও অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি না করলে জেলার সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতেই থাকবে।
শরীয়তপুরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমেই উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে মানুষ প্রতিনিয়ত চিন্তিত, শিক্ষার্থীরা ভয়ে অসহায়, সাধারণ মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে কঠোর আইন প্রয়োগ, দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রভাবশালীদের অপকর্মের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।
Comments