Image description

চট্টগ্রাম বন্দরে ব্রাজিল থেকে আগত একটি কনটেইনারে তেজস্ক্রিয়তা শনাক্ত হয়েছে। ‘মেগাপোর্ট ইনিশিয়েটিভ রেডিয়েশন ডিটেকটিভ সিস্টেম’-এর মাধ্যমে তেজস্ক্রিয়তার সংকেত পাওয়ার পর কাস্টমস কর্তৃপক্ষ কনটেইনারটির খালাস স্থগিত করেছে। কনটেইনারটিতে পুরোনো লোহার টুকরা বা স্ক্র্যাপ রয়েছে, যাতে তিনটি রেডিওনিউক্লাইড আইসোটোপ—থোরিয়াম-২৩২, রেডিয়াম-২২৬ এবং ইরিডিয়াম-১৯২—শনাক্ত হয়েছে।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের নথি অনুযায়ী, ঢাকার ডেমরার আল আকসা স্টিল মিলস লিমিটেড ব্রাজিল থেকে পাঁচটি কনটেইনারে ১৩৫ টন স্ক্র্যাপ আমদানি করেছিল। তেজস্ক্রিয়তা শনাক্ত হওয়া কনটেইনারটি এই পাঁচটির একটি। গত ৩ আগস্ট ‘এমভি মাউন্ট ক্যামরন’ জাহাজের মাধ্যমে জিসিবি টার্মিনালের ৯ নম্বর জেটিতে এটি নামানো হয়। বুধবার (৬ আগস্ট) বন্দরের ৪ নম্বর ফটক দিয়ে খালাসের সময় মেগাপোর্টের যন্ত্রে তেজস্ক্রিয়তার সংকেত ধরা পড়ে।

কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান, প্রাথমিক পরীক্ষায় তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা এক মাইক্রোসিয়েভার্টস পাওয়া গেছে, যা উচ্চ মাত্রার নয়। তবে লোহার টুকরা ও কনটেইনারের দেয়ালের কারণে সঠিক মাত্রা নির্ণয় করা কঠিন। নিরাপত্তার স্বার্থে কনটেইনারটি আলাদা করে রাখা হয়েছে।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ মারুফুর রহমান বলেন, “সতর্কসংকেত পাওয়ার পর কনটেইনারটি খালাস বন্ধ করে আলাদা স্থানে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনকে বিষয়টি জানিয়ে চিঠি দেওয়া হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা এসে সরেজমিন পরীক্ষা করবেন, এরপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

কনটেইনারের গতিপথ

কনটেইনারটির যাত্রা শুরু হয় ব্রাজিলের মানাউস বন্দর থেকে। মেডিটেরানিয়ান শিপিং কোম্পানির (এমএসসি) তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ মার্চ মানাউসে স্ক্র্যাপ বোঝাই করে কনটেইনারটি জাহাজে তোলা হয়। এরপর ১৮ এপ্রিল পানামার ক্রিস্টোবাল, ৩ মে নেদারল্যান্ডসের রটারড্যাম এবং ১৫ জুলাই শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দরে নামানো হয়। সর্বশেষ ২৮ জুলাই কলম্বোর সাউথ এশিয়া গেটওয়ে টার্মিনাল থেকে ‘এমভি মাউন্ট ক্যামরন’-এ করে চট্টগ্রামে আনা হয়। এই চারটি বন্দরের মধ্যে তিনটিতে তেজস্ক্রিয়তা শনাক্তকরণ যন্ত্র থাকলেও কোনো সংকেত ধরা পড়েনি। শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরের মেগাপোর্ট সিস্টেমে এটি শনাক্ত হয়।

ঝুঁকি ও সতর্কতা

চিকিৎসা, শিল্প ও গবেষণায় তেজস্ক্রিয় উৎস ব্যবহৃত হয়, যা সাধারণত বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষিত থাকে। ব্যবহার শেষে এগুলো তেজস্ক্রিয় বর্জ্য হিসেবে নিরাপদে ব্যবস্থাপনা করা প্রয়োজন। অসতর্কতা বা দুর্ঘটনার কারণে এই উৎস বাইরে ছড়িয়ে পড়লে মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ঝুঁকি তৈরি হয়। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মাসুদ কামাল বলেন, “তেজস্ক্রিয়তার সঠিক মাত্রা জানতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন। যেহেতু সতর্কসংকেত পাওয়া গেছে, কনটেইনারটি মানুষের সংস্পর্শ থেকে আলাদা রাখা উচিত। অতিরিক্ত তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে এলে স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে।”

আগেও তেজস্ক্রিয়তার ঘটনা

ব্রাজিলের মানাউস বন্দর থেকে আগেও তেজস্ক্রিয় পদার্থ শনাক্ত হয়েছিল। ২০২১ সালের ১৪ ডিসেম্বর মানাউস থেকে চট্টগ্রামমুখী একটি কনটেইনারে মাল্টা বন্দরে তেজস্ক্রিয়তা ধরা পড়ে। পরে ২০২২ সালের ২৩ জুন ব্রাজিলের সুয়াপে বন্দরে ফেরত পাঠানো হয়। ব্রাজিলের ন্যাশনাল নিউক্লিয়ার এনার্জি কমিশন তেজস্ক্রিয় উৎস আলাদা করে সংরক্ষণাগারে স্থানান্তর করে। ওই কনটেইনারে রেডিয়াম-২২৬ পাওয়া গিয়েছিল। ব্রাজিলিয়ান জার্নাল অব রেডিয়েশন সায়েন্সেস-এর গত ১৫ জুলাই প্রকাশিত নিবন্ধে এ তথ্য উঠে এসেছে।

অতীতের ঘটনা

বাংলাদেশে প্রথম তেজস্ক্রিয়তা শনাক্ত হয় ২০১৪ সালে। শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দরে চট্টগ্রাম থেকে ভারতে রপ্তানিকৃত মরিচারোধী ইস্পাতের কনটেইনারে তেজস্ক্রিয়তা ধরা পড়ে। ফেরত আনার পর যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশসহ চার দেশের বিজ্ঞানীরা ‘রেডিয়াম বেরিলিয়াম’ নামে তেজস্ক্রিয় পদার্থ আলাদা করেন, যা থেকে ঘণ্টায় ১২ হাজার মাইক্রোসিয়েভার্টস বিকিরণ হচ্ছিল।

চট্টগ্রাম বন্দরে ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে স্থাপিত মেগাপোর্ট সিস্টেম তেজস্ক্রিয়তা শনাক্তকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পরমাণু শক্তি কমিশনের পরীক্ষার পরই কনটেইনারটির বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।