
অধিদপ্তরের নীতিমালা অনুযায়ী, দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পিটিআই সংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয় ও সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিটিতে পঞ্চম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের চল্লিশ শতাংশ শিক্ষার্থী বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে। এর বাইরে বেসরকারি বা প্রাইভেটভাবে পরিচালিত কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে না। এই সিদ্ধান্তটি নিয়ে রিট ও রুল হয়েছে, আলোচনা ও সমালোচনা হচ্ছে।
‘পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষায় কিন্ডারগার্টেন ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাদ দিয়ে শুধু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়াকে একটি বড় ধরনের ষড়যন্ত্র ও নিষ্পাপ কোমলমতি শিশুদের সঙ্গে বৈষম্য বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন ঐক্য পরিষদ। তারা বলেছে, এ ধরনের হঠকারী ও বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই মেনে নেয়া হবে না। অবিলম্বে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার জারিকৃত প্রজ্ঞাপন বাতিল করে পূর্বের মতো সরকারি-বেসরকারি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষা নেয়ার জোর দাবি জানিয়েছেন।’
আমাদের দেশের সংবিধান অনুসারে প্রাথমিক শিক্ষা সবার মৌলিক অধিকার। আমরা সেই অধিকার নিশ্চিত করতে পারছি না! সকল শিশু অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় আনতে পারছি না। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় জরিপ (Annual Primary School Census) ?২০২৩ অনুযায়ী প্রাথমিক পর্যায়ের মোট শিক্ষার্থী প্রায় ১ কোটি ৯৭ লাখ ১৩ হাজার ৬৮৫ জন। এর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে প্রায় ১ কোটি ৯ লাখ ৮৫ হাজার ৮১৫ জন; যা মোটের ৫৫.৭%।
বাকি বেসরকারি তথা এনজিও স্কুল, ইবতেদায়ী মাদ্রাসা, সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান মিলে লেখাপড়া করে প্রায় ৮৭ লাখ ২৭ হাজার ৮৭০ জন; যা মোটের ৪৪.৩%। এ হিসাব অনুসারে দেখা যায় প্রাথমিক স্তরের প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। প্রত্যন্ত গ্রামেও এখন কেজি স্কুল বিদ্যমান। অর্থাৎ আমাদের সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদে প্রাথমিক শিক্ষা সবার জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক হলেও আমরা তা বাস্তবায়ন করতে পারছি না। ফলে সবার জন্য সমান সুযোগ এবং একই মানের শিক্ষা ও সহশিক্ষা নিশ্চিত হচ্ছে না। এ বৈষম্য নিরসন করা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শুধুমাত্র দরিদ্র পরিবারের শিশুরা পড়বে, ধনী পরিবারের শিশুরা পড়তে পারবে না কিংবা করতে চাইলে বেতন দিয়ে পড়তে হবে, এমন কোনো বিধান আছে বলে আমার জানা নেই। অর্থাৎ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ধনী-দরিদ্র সব পরিবারের শিশুদের জন্য উন্মুক্ত। তথাপি প্রাথমিক স্তরের এত বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী কেন বিনা-বেতনে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করে না অথবা কেন বেতন দিয়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করে সে প্রশ্নের উত্তর অনেক বিস্তৃত।
সে আলোচনা অন্যদিন অন্য লেখায় করব। সংক্ষেপে বলা যায়, অধিকাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যে মানের লেখাপড়া হয় তাতে অধিকাংশ অভিভাবকগণ সন্তুষ্ট নন। সেখানে সরকারি শিক্ষক আছেন, তুলনামূলক ভালো শ্রেণিকক্ষ আছে, কম/বেশি শিক্ষা উপকরণ আছে, খেলাধুলার জন্য ছোট/বড় মাঠ আছে, সম্পূর্ণ ফ্রি লেখাপড়ার সুযোগ আছে।
তথাপি অনেক অভিভাবক এমনকি অনেক সরকারি শিক্ষকও তাদের সন্তানদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করাতে আগ্রহী নন! বরং তারা ভর্তি ফি ও বেতন দিয়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে; যেখানে সরকারি শিক্ষক নেই, (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে) নিজস্ব জমি নেই, খেলাধুলার মাঠ নেই, উত্তম ভবন নেই, পর্যাপ্ত শিক্ষা সামগ্রী নেই; সেখানেই তাদের সন্তানদের লেখাপড়া করাতে আগ্রহী। নিশ্চয়ই এর কারণ সবাই কম/বেশি অনুধাবন করতে পারেন, পারবেন।
যতক্ষণ পর্যন্ত সকল শিশু সরকারি শিক্ষার আওতায় এনে সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে বৈষম্য নিরসন করা সম্ভব না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিশু শিক্ষার্থীদের সাথে কোনোরূপ বিমাতাসুলভ আচরণ করা অনুচিত, অনৈতিক। বরং তাদেরকে যথাসম্ভব সাপোর্ট দেয়া রাষ্ট্রের নৈতিক ও সাংবিধানিক দায়িত্ব।
প্রাথমিক স্তরের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে সরকারি পাঠ্যবই দেয়া হয়। বই ক্রয় করার ক্ষমতা আছে এ কথা বলে তাদের কাছে কিন্তু সরকারি বই বিক্রি করা হয় না। অর্থাৎ সরকারি ও বেসরকারি উভয় বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সমান সরকারি সুযোগ দেয়া হয়। এ কাজ অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
একই দৃষ্টিকোণ থেকে তাদেরকে সহশিক্ষায় ও বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সমান সুযোগ প্রদান করা উচিত। অর্থাৎ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মত বেসরকারিদেরও ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক ও একাডেমিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। এজন্য তাদের আন্দোলন করতে হবে কেন? বরং সবাইকে সুযোগ দিয়ে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর বিভিন্ন প্রতিযোগিতা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনে বেসরকারি শিক্ষকদের সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে।
সরকারিভাবে আয়োজিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিশুদের ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার প্রতিটি ইভেন্টে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, মোট তিনটি করে পুরস্কার দেয়া হয়। এক্ষেত্রে প্রাথমিক স্তরের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিশুদের অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে প্রতি ইভেন্টে পাঁচটি বা দশটি করে পুরস্কার দেয়া হোক।
এদিকে এবার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মোট ৮২ হাজার ৫০০ জন শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেয়া হবে বলে জানা যায়। এতে প্রতি থানায়/উপজেলায় কম/বেশি ১৫০ জন বৃত্তি পাবে। এক্ষেত্রে প্রাথমিক স্তরের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে বৃত্তির পরিমাণ ও সংখ্যা দ্বিগুণ বা তিনগুণ করা হোক। এতে অধিক শিক্ষার্থী উপকৃত হবে।
শিক্ষায় ও সহশিক্ষায় প্রতিযোগীর সংখ্যা এবং প্রতিযোগিতার পরিসর বৃদ্ধি পাবে। প্রতিযোগীরা অধিক উৎসাহিত হবে, চর্চা বা অনুশীলন বৃদ্ধি করবে, আরও মেধাবী ও সুদক্ষ হয়ে উঠবে। এটাই তো আমাদের প্রত্যাশা। তদুপরি সকল শিশুর মধ্যে আন্তরিকতা বাড়বে। শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে সৌজন্যতা ও সহযোগিতা বাড়বে। মনে রাখতে হবে, শিক্ষা খাতে অর্থ খরচ রাষ্ট্রীয় ব্যয় নয়, সবচেয়ে লাভজনক দীর্ঘমেয়াদি টেকসই বিনিয়োগ। সরকার চাইলে মেধাবৃত্তির পাশাপাশি সংখ্যা বৃদ্ধি করে পৃথক নিয়ম করে দরিদ্রবৃত্তি যুক্ত করতে পারে এবং তা করা উচিত। তাতে নিয়মের মধ্যে থেকেই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দরিদ্র শিশুরা বেশি সুযোগ পাবে।
যদি কেউ এমন মনে করেন যে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিশু-শিক্ষার্থীদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করা হলে তারা সরকারি প্রতিষ্ঠানে আসতে বাধ্য হবে তো সেটি ভুল ধারণা। মান বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। লক্ষণীয়, প্রাইভেটে পড়ার সাধ্য আছে এমন ধনী পরিবারের ছেলেমেয়েরাও সরকারি মেডিকেল কলেজে, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে।
শক্ত প্রতিযোগীকে অংশগ্রহণের সুযোগ না দিয়ে বিজয়ী হওয়ার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। বরং সব প্রতিযোগীকে সমান সুযোগ দিয়ে বিজয়ী হওয়াই বীরত্ব। সুস্থ প্রতিযোগিতায় উভয়ের মান বৃদ্ধি পায়। সরকারি প্রতিষ্ঠান রেখে কেন শিক্ষার্থীরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করতে যাচ্ছে সে কারণ উদ্ঘাটন করে তা সমাধানের চেষ্টা করাই উত্তম চিন্তা এবং তা অত্যন্ত জরুরি। এর পাশাপাশি সুষ্ঠু বিধিমালা প্রণয়ন করে এবং নিরপেক্ষভাবে তা অনুসরণ করে সকল যোগ্য বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুমোদন দিয়ে সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনা আবশ্যক।
সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও থাকা উচিত নয়। প্রাথমিক স্তরের সকল ধরনের সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমমান বজায় রেখে সকল শিশুর জন্য সুশিক্ষা নিশ্চিত করতে পারাটাই আমাদের প্রকৃত সফলতা। যার জন্য প্রয়োজন শিক্ষায়, সহশিক্ষায় ও পরীক্ষায় সকল শিশুর জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করা।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
Comments