Image description

আজ ৬ সেপ্টেম্বর সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র ৫৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৮৬২ সালের ৮ অক্টোবর তৎকালীন ত্রিপুরা জেলার (বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া) নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৭২ সালের এই দিনে ভারতের মাইহারে পরলোকগমন করেন বিশ্ব বরেণ্য এই সংগীতজ্ঞ। তাঁর পিতার নাম সাবদর হোসেন খাঁ ওরফে সদু খাঁ এবং মাতার নাম সুন্দরী বেগম।

ওয়ারেন হেস্টিংস তখন ভারতের বড়লাট। সন্ন্যাসী ও ফকিরদের ওপর এ সময় নেমে আসে অত্যাচারের স্টিমরোলার। ক্রমাগত নিপীড়নে অতিষ্ঠ হওয়ার ফলে শুরু হয় সন্ন্যাসী আন্দোলন এবং ফকির বিদ্রোহ। মজনু শাহ, মূসা শাহ, চেরাগ আলী, নূরুল মোহাম্মদ এরাই ছিলেন সেদিনকার ফকির বিদ্রোহের কর্ণধার। ফকির বিদ্রোহের এক সাহসী সৈনিকের নাম সিরাজুদ্দিন খাঁ।

আসামের জঙ্গলে ইংরেজদের মুখোমুখি এক সংঘর্ষে তিনি গুরুতর আহত হন। আহত অবস্থায় এক বৃদ্ধ ফকিরের সেবা শুশ্রূষায় তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং ফকিরের কন্যা নয়তন বিবিকে বিয়ে করে সংসারের পথে পা বাড়ান। পরবর্তী সময়ে স্ত্রীর ইচ্ছায় সিরাজ খাঁ আসামের বনভূমি ছেড়ে নবীনগরের শিবপুর গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। এভাবেই শিবপুর গ্রামে খাঁ বংশের গোড়াপত্তন হয়।

সিরাজ খাঁ’র স্ত্রী নয়তন বিবি, তাদের পুত্র মিরাজ খাঁ, স্ত্রী নসিমন বিবি, তাদের পুত্র আলী আহমদ খাঁ, সালেহ আহমদ খাঁ, জাফর মোহাম্মদ খাঁ, পুত্র মাদার খাঁ, পুত্র সবদর হোসেন খাঁ (সদু খাঁ), স্ত্রী সুন্দরী বেগম, তাদের পুত্র ছমির উদ্দিন খাঁ, আপ্তাব উদ্দিন খাঁ, আলাউদ্দিন খাঁ, নায়েব আলী খাঁ, আয়েত আলী খাঁ।

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র পিতা সদু খাঁ ছিলেন বিখ্যাত সেতার বাদক। আগরতলার তৎকালীন মহারাজা বীরবিক্রম মাণিক্য মহারাজের রাজদরবারের সভা বাদক ও মিয়া তানসেনের বংশধর ওস্তাদ কাসেম আলী খাঁ’র কাছ থেকে সদু খাঁ যন্ত্রসংগীতের তালিম গ্রহণ করেন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ উত্তরাধিকার সূত্রে পিতা সদু খাঁ’র নিকট থেকে সংগীতানুরাগের বিশেষ গুণটি অর্জন করেন।

সদু খাঁ প্রতিদিন খুব ভোরে সেতার বাজাতেন। সেতারের টুংটাং মিষ্টি সুরে শিশু আলাউদ্দিনের ঘুম ভাঙতো। শুয়ে শুয়েই চুপচাপ শুনতেন সেতারের ঝংকার। এভাবেই সংগীতের প্রতি তার আগ্রহ প্রবল হয়। স্কুলের লেখাপড়ায় তার মন বসত না, ভালো লাগতো রাখালের বাঁশির সুর। গ্রাম্য আখড়ার গান, মাঝির কণ্ঠের ভাটিয়ালি।

বয়স যখন দশ কি বারো, সে সময় তিনি একদিন সবার অজান্তে একটি পুঁটলি সম্বল করে ঘর ছেড়ে পালালেন। ওই পুঁটলিতে ছিল একটি গামছা, একটা জামা, মায়ের জমানো কিছু টাকা। পথে দেখা হলো এক যাত্রাদলের সাথে। যুক্ত হলেন সেই যাত্রাদলে। এই যাত্রাদলের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে ঢাকা এলেন। ঢাকা থেকে আবার একদিন একাই চলে গেলেন কলকাতায়। উদ্দেশ্য কোনো নামকরা ওস্তাদের কাছে সংগীতের তালিম নেবেন। কলকাতায় নেমে তো তিনি হতভম্ব। এত বড় শহর আর ওপর এখানে তার কোনো আত্মীয়-স্বজন কিংবা পরিচিত নেই।

লঙ্গরখানায় দু’বেলা আধপেটা খান আর রাতের বেলা ড. কেদার নাথের সিঁড়িতে ঘুমান। এ অবস্থায় একদিন ঘুম থেকে জেগে দেখলেন মাথার নিচের পুটলিটা উধাও! দুঃখে হতাশায় কাঁদতে লাগলেন তিনি। ডা. কেদার নাথ আদর করে তাকে কাছে ডেকে নিলেন, জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারলেন তার ঘর পালানোর কথা, গভীর সংগীতানুরাগের কথা। তিনি আলাউদ্দিনকে সেদিন থেকে নিজ বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করলেন।

কলকাতার বিখ্যাত জমিদার সৌরীন্দ্র মোহন ছিলেন দারুণ সঙ্গীত প্রিয় মানুষ। তাঁর বাড়িতে প্রায়ই গানের জলসা বসতো। গান গাইতে আসতেন বিখ্যাত সংগীত সাধক ওস্তাদ গোপাল কৃষ্ণ ভট্টাচার্য ওরফে নুলো গোপাল। ডা. কেদার নাথের মাধ্যমে ওস্তাদ নুলো গোপালের সঙ্গে এখানেই আলাউদ্দিনের পরিচয় হয়। আলাউদ্দিন নুলো গোপালের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। শর্ত- কমপক্ষে বারো বছর সরগম সাধনা করতে হবে। আলাউদ্দিন যেকোনো শর্তেই রাজি। কিন্তু শিষ্যত্ব গ্রহণের সাত বছর কাটতে না কাটতেই প্লেগ রোগে নুলো বাবু মারা গেলেন। আবার নতুন ওস্তাদ খোঁজার পালা শুরু। পেটের দায়ে চাকরি নিলেন কলকাতার মিনার্ভা থিয়েটারে- তবলাবাদক হিসেবে। বেতন মাসে বারো টাকা।

এসময় মি. লবো নামক এক গোয়ানীজ ব্যান্ড মাস্টারের কাছে তিনি বেহালায় তালিম নিতে শুরু করেন। লবো সাহেবের স্ত্রীর কাছেও শিখতে লাগলেন পাশ্চাত্য সংগীতের শুদ্ধ স্বরলিপি। এছাড়া ওস্তাদ অমর দাশ নামক একজন সংগীত শিক্ষকের নিকটও দেশীয় ঢংয়ে বেহালা বাদনের শিক্ষা গ্রহণ করেন। বিখ্যাত মৃদঙ্গবাদক নন্দলালের কাছে শিখলেন পাখোয়াজ। ওস্তাদ অমৃতলাল দত্ত ওরফে হাবু দত্তের কাছে শিখলেন ক্ল্যারিওরেট, বাঁশি, পিকলু, সেতার, ম্যাণ্ডোলিন, ব্যাঞ্জো প্রভৃতি যন্ত্রের বাদন। হাজারী ওস্তাদের কাছে তালিম নিয়ে শিখলেন সানাই, নাকারা ও টিকারী। এভাবেই তিনি দিনে দিনে নিজেকে সর্ববাদ্য বিশারদ হিসেবে গড়ে তুললেন।

একদিন মিনার্ভা থিয়েটার থেকে বের হতেই বড় ভাই ওস্তাদ আপ্তাবউদ্দিনের সঙ্গে দেখা। ওস্তাদ আপ্তাবউদ্দিন ছোট ভাই আলাউদ্দিনকে গ্রামের বাড়ি শিবপুরে নিয়ে যেতে এসেছেন। বড় ভাইয়ের সঙ্গে বাড়ি ফিরেই আলাউদ্দিনকে বিয়ে করতে হলো। মা সুন্দরী বেগমের চাপে পড়ে বিয়ে করলেন মদিনা বেগমকে। কিন্তু বিয়ের রাতেই সুর পাগল আলাউদ্দিন নববধূ মদিনা বেগমকে ফেলে আবার উধাও হলেন। আবার সেই কলকাতা।

ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার তৎকালীন জমিদার অত্যন্ত সংগীত রসিক ছিলেন। তাঁর আমন্ত্রণে ওস্তাদ আলাউদ্দিন মুক্তাগাছায় আসেন। পরিচয় হয় বিখ্যাত সরোদ বাদক ওস্তাদ আহমদ আলী খা’র সঙ্গে। ওস্তাদ আহমদ আলীর সরোদ বাদন শুনে তিনি তাঁর শিষ্য হলেন এবং মন প্রাণ সঁপে দিলেন সরোদ শিক্ষায়। পরবর্তীকালে ওস্তাদ আহমদ আলী খা’র সঙ্গে এক সঙ্গীত সফরে তিনি পাটনা, কাশী ঘুরে ওস্তাদের বাড়ি রামপুরে আশ্রয়গ্রহণ করেন। ওস্তাদ আহমদ আলীর কাছে তিনি চার বছর সরোদ বাজনা শেখেন।

সেসময় ভারতীয় দ্রুপদ সংগীতের আরেক দিকপাল রামপুরে বাস করতেন- ওস্তাদ ওয়াজীর খাঁ। তিনি ছিলেন রামপুরের নবাব হামিদ আলী খা’র সঙ্গীত গুরু। অনেক চেষ্টা তদবীরের পর এক নাটকীয় ঘটনার মাধ্যমে হামিদ আলী খা’র সুপারিশ লাভ করে আলাউদ্দিন খাঁ ওয়াজীর খাঁ’র শিষ্যত্ব গ্রহণ করার দুর্লভ সুযোগ পান। এখানে তিনি দ্রুপদ, ধামার ও রাগ সংগীতের সূক্ষ্ম রীতি পদ্ধতি সম্পর্কে প্রকৃত পারদর্শিতা অর্জন করেন।  এছাড়া রবাব ও সুর শৃঙ্গার থেকে শুরু করে অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের বিস্ময়কর দক্ষতা লাভ করেন। সুর সাধনা করতে করতে একসময় প্রবর্তন করলেন বিশ্ব বিখ্যাত এক নতুন সংগীত ঘরানা- যার নাম আলাউদ্দিন ঘরানা। দীর্ঘদিন সাধনার পর আলাউদ্দিনের সংগীতের প্রতিভায় ওস্তাদ ওয়াজীর খাঁ সন্তুষ্ট হলেন। অবশেষে তিনি আলাউদ্দিনকে কর্মজীবনে প্রবেশের অনুমতি দিলেন।

ওস্তাদ আলাউদ্দিন চাকরি নিলেন মধ্যপ্রদেশের সামন্ত রাজ্য মাইহার রাজদরবারে দরবার সংগীতজ্ঞ হিসেবে। ধীরে ধীরে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র খ্যাতি স্বদেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও পৌঁছাতে শুরু করে। ১৯৩৪ সাল থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত তিনি বিশ্ব সফর করেন। এসময় তিনি ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকার বহু দেশ সফর করেন। ১৯৩৬ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি পবিত্র হজও পালন করেন। সারা জীবন সাধনায় তিনি বহু রাগরাগিণী আবিষ্কার করেন। তার মধ্যে হেমন্ত, প্রভাতকেলী, হেম বেহাগ, বসন্ত বেহাগ, শেখ বাহার, প্রভাতি রাগ উল্লেখযোগ্য।

সংগীতে অমূল্য অবদানের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে খাঁ সাহেব, পিএইচডি (দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়), ডক্টর অব ল (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), (দেশিকোত্তম) বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লা হল ও ফজলুল হক হলের আজীবন সদস্য এবং ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ ও পদ্মবিভূষণ খেতাবে সম্মানিত করে।

বিশ্ব নিন্দিত সংগীত সম্রাট হয়েও তাঁর মনে অহংকারের ছিটেফোঁটা ছিল না। গ্রামের মানুষের সঙ্গে তাঁর ছিল নাড়ির সম্পর্ক। গ্রামের মানুষের আবদার রক্ষা করে তিনি শিবপুরে একটি পুকুর কাটান এবং সেই সঙ্গে একটি পাকা মসজিদও তৈরি করে দেন। তাঁর অতি আদরের কন্যা রওশন আরা বেগম অন্নপূর্ণাকে তিনি তাঁর প্রিয় শিষ্য ভারতের বিখ্যাত সেতার বাদক পণ্ডিত রবিশংকরের সঙ্গে বিয়ে দেন। অবশ্য পরবর্তী সময় এই বিয়ে টিকেনি। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ভারতের মাইহার রাজ্যে আমৃত্যু বসবাস করেন। সেখানেই তৈরি করেন নিজের বাড়ি মদিনা ভবন। এই মদিনা ভবনে ১৯৭২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সংগীত জগতের কিংবদন্তী পুরুষ সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ইন্তেকাল করেন।