Image description

বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন জটিলতার জালে বন্দি-দুর্ভোগে জনগণ। এমন চিত্র নতুন নয়। দেশে উন্নয়নের ক্ষেত্রে নানা সময়ে উন্নয়নের ‘জোয়ার’ বইতে দেখা যায়। কিন্তু এসব উন্নয়নের মাঝে একধরনের পরিকল্পনাহীনতা ও সমন্বয়হীনতা মাঝেমধ্যেই দৃশ্যমান হয়, যার একটি চিরায়ত উদাহরণ সেতু আছে, সড়ক নেই। 

উন্নয়ন মানেই শুধু কাঠামো নির্মাণ নয়; বরং সেটি জনগণের জীবনমান উন্নয়নে কী ভূমিকা রাখছে সেটিই মুখ্য। কিন্তু আমাদের দেশে তার উল্টো চিত্র। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো এমন বহু সেতু দাঁড়িয়ে আছে, যেগুলোর দুই পাশে সংযোগ সড়কই তৈরি হয়নি বা অকার্যকর অবস্থায় আছে। ফলে সেতু হয়ে দাঁড়িয়েছে একখণ্ড স্থাপত্য, যার কোনো বাস্তব কার্যকারিতা নেই, এমন চিত্র আমাদের হতাশ করে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদসূত্রে জানা যায়, মেহেরপুর জেলার বেতবাড়িয়া ও কুষ্টিয়ার মধুগাড়ি গ্রামের মানুষের জন্য মাথাভাঙ্গা নদীর ওপর ২০২০ সালে সেতু নির্মাণ শুরু হয়। প্রায় সাড়ে ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০২৩ সালে শেষ হয় নির্মাণকাজ। তবে দুই বছর পেরিয়ে গেলেও তৈরি হয়নি সেতুর সংযোগ সড়ক। হয়নি জমির অধিগ্রহণ। 

ফলে ফসলি জমির মাঝখানে সেতুটি এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে স্থানীয়দের জন্য। অতিকষ্টে সেই সেতু পার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। আনা-নেয়া করা যাচ্ছে না কোনো ফসল। মাঝেমধ্যেই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন অনেকেই। সেতুর ওপারে মধুগাড়ি গ্রামে নির্মিত হয়েছে সংযোগ সড়ক। জমি অধিগ্রহণ জটিলতার কারণে এপারে বেতবাড়িয়া গ্রামে সংযোগ সড়ক নির্মাণ হয়নি। 

এদিকে সংযোগ সেতু নির্মাণ না হওয়ার পেছনে গ্রামবাসী দুষছেন এলজিইডি কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর মালিকদের জমি না দেয়া। তবে জমির মালিকরা বলছেন, জমি দেয়ার জন্য এক বছর ধরে এলজিইডি কর্তৃপক্ষের কাছে যোগাযোগ করা হলেও কোনো সমাধান মেলেনি। ফলে অধিগ্রহণ জটিলতায় সংযোগ সড়ক দুর্ভোগে সাধারণ মানুষ। উন্নয়ন হলেও দুর্ভোগ কমছে না। 

দুপক্ষের বিতর্কে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষের। দুই বছর ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে সেতুটি, এটি উন্নয়নের নামে দুর্ভোগের চিত্র। দুঃখজনক হলেও সত্য, এক বছরেও মেলেনি সমাধান, উল্টো বাড়ছে দুর্ভোগ ও দুর্ঘটনার সংখ্যা। এমন পরিস্থিতি সারাদেশেই কমবেশি দেখা যায় কিন্তু তার স্থায়ী সমাধান নেই। ফলে উন্নয়ন দুর্ভোগে পরিণত হচ্ছে। 

একটি সেতুর প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো দুই প্রান্তের মানুষ ও যানবাহনের সহজ ও নিরবচ্ছিন্ন চলাচল নিশ্চিত করা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সেতু থাকলেও সংযোগ সড়ক না থাকায় মানুষ নৌকা, বাঁশের সাঁকো কিংবা বিকল্প দুরূহ পথ ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে। কোথাও কোথাও সেতু নির্মাণের কয়েক বছর পার হলেও আজও তা ব্যবহারযোগ্য হয়নি। প্রশ্ন ওঠে, এ কেমন উন্নয়ন? এই পরিস্থিতি কেবল অর্থ ও সম্পদের অপচয় নয়, বরং সাধারণ মানুষের সঙ্গে একধরনের নিষ্ঠুর রসিকতা। 

জনগণের করের টাকায় নির্মিত এসব সেতু যখন বাস্তবে কোনো উপকারে আসে না, তখন তা উন্নয়নের নামে একপ্রকার প্রহসন হিসেবেই প্রমাণ হয়। এ অবস্থার ফলে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় যেমন ঘটছে, তেমনি জনগণের ভোগান্তিও বেড়েছে বহুগুণ। প্রকল্প হাতে নেয়া হয় সেতু নির্মাণের, কিন্তু সড়ক নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ বা বাজেট বরাদ্দের বিষয়টি উপেক্ষিত থাকে, এমন চিত্র নতুন নয়। 

স্থানীয় সরকার, সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং প্রকৌশল দপ্তরের মধ্যে পর্যাপ্ত সমন্বয় না থাকায় একপক্ষ সেতু তৈরি করে ফেলে, অন্যপক্ষ তখনো সড়কের জন্য প্রস্তুত নয়। অনেক সময় রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এমন জায়গায় সেতু নির্মাণ করা হয়, যেখানে বাস্তবিক চাহিদা বা উপযোগিতা নেই। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ বের না করতে পারলে উন্নয়নের নামে শুধু রাষ্ট্রের অর্থ ব্যয় হবে কিন্তু জনগণের দুর্ভোগ কমবে না। তাই সব উন্নয়ন যেন জনগণের কাজে লাগে, এমন ব্যবস্থা নিতে হবে।

যেকোনো অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে তা যেন সমন্বিতভাবে পরিকল্পনা করা হয় সেতু, সড়ক, সংযোগপথসহ। প্রকল্প গ্রহণের আগে স্থানীয় জনগণের প্রয়োজন ভূগোল ও পরিবেশগত দিক বিবেচনায় নেয়া জরুরি। অপূর্ণ প্রকল্প বা অকার্যকর উন্নয়নের জন্য সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব নির্ধারণ এবং মনিটরিং ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করা উচিত। 

উন্নয়ন শুধু অবকাঠামোর দৃশ্যমান রূপ নয়, এর কার্যকারিতাই আসল। সেতু তৈরি করে যদি মানুষ পার হতে না পারে, তাহলে তা উন্নয়ন নয়, একপ্রকার অপচয়। তাই প্রয়োজন টেকসই ও জনমুখী উন্নয়নের, যা হবে পরিকল্পিত, যৌক্তিক এবং জনগণের জীবনে বাস্তব পরিবর্তন নিয়ে আসবে। মানুষ চায় কার্যকর, পরিকল্পিত ও টেকসই উন্নয়ন, যার সুফল তারা সরাসরি ভোগ করতে পারে।

উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকৃত মানে তখনই দাঁড়ায়, যখন তা মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে। তাই লোক-দেখানো উন্নয়ন নয়, বাস্তবভিত্তিক, পরিকল্পিত ও জনবান্ধব উন্নয়ন জরুরি।