
প্রতিষ্ঠার ১৭ বছরেও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষক নিয়োগে বঞ্চিত করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। যেখানে দেশের অন্যান্য সরকারি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বিসিএস, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গুলোতেও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিয়োগ পাচ্ছেন। সেখানে শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগে উলটো চিত্র বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ না দেওয়া অনেকটা অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রায় ২২ টি বিভাগে ২০৪ জনের মত কর্মরত শিক্ষক রয়েছেন। এদের মধ্যে বেশিরভাগ শিক্ষকই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী।
২০০৮ সালে অ্যাকাডেমিক যাত্রা শুরু করা বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ইতোমধ্যে ১২টি ব্যাচ তাদের মাস্টার্স শেষ করেছেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, তিস্তা ইউনিভার্সিটি, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন।
ভালো সিজিপি, বিদেশি ডিগ্রি,পিএইচডি,এমনকি অসংখ্য পাবলিকেশন থাকা সত্ত্বেও অনেক শিক্ষার্থীকেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। যা শিক্ষার্থীদের মাঝে হতাশার সৃষ্টি করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়,প্রতিষ্ঠার ১৭ বছরে মাত্র এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৮ জন শিক্ষার্থী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। এর মধ্যে সাবেক উপাচার্য কলিমুল্লাহর আমলে বাংলা বিভাগে ১ জন নিয়োগ পান। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে পরবর্তীতে সাবেক উপাচার্য হাসিবুর রসিদের মেয়াদে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ১ জন, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে ১ জন, ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে ১ জন ও ম্যানেজম্যান্ট স্টাডিজ বিভাগে ১ জন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর নতুন উপাচার্য দায়িত্ব নেয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রধান দাবি ছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকেই এখানে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার। তারই লক্ষ্যে তারা কয়েকবার উপাচার্যের সাথে দেখা করে উপাচার্য বরাবর এ আবেদন করেন।
শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে আসছেন, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভালো ফলাফল এবং গবেষণা থাকলেও তাদেরকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় না। বিভিন্ন সময় লিখিত পরীক্ষা বা ভাইভা খারাপের দোহাই দিয়ে নিয়োগ বোর্ড থেকে কৌশলে বাদ দেয়া হয়।
নতুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শওকাত আলী এসেই ১১ জন নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেন, সেখানে মাত্র ৩ জন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে নিয়োগ পান ।
যদিও সবগুলো বিভাগে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আবেদন করেছিলেন, কিন্তু নিয়োগ পান তিনটি বিভাগে। তাদের অভিযোগ, ভালো ফলাফল থাকা সত্ত্বেও তাদের কৌশলে অন্য বিভাগ গুলো থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।
অভিযোগের সত্যতা যাচাই করতে এই উপাচার্যের সময়ের ১১ টি বিভাগের মধ্যে গণিত, ভূগোল ও পরিবেশ এবং ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক নিয়োগের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গণিত বিভাগের শিক্ষক নিয়োগে, বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৯ জন শিক্ষার্থী আবেদন করেন। এর মধ্যে লেলিন চৌধুরি ও সুমাইয়া খাতুন স্নাতকোত্তরের সিজিপিএ ৪ এ ৪ পেয়েছেন। এছাড়াও খালিদা আক্তার ৩.৯৮, রায়হানুল ইসলাম ৩.৯৭ এবং খোরশেদা আক্তার ৩.৯৫ পেয়েছেন। তবে এ বিভাগে চূড়ান্তভাবে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক একজন শিক্ষার্থী নিয়োগ পেয়েছেন, যার সিজিপি এসকল শিক্ষার্থীদের চাইতেও কম। এছাড়াও, আবেদনকারী ৯ জনের মধ্যে ২ জনের পূর্বে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ও রয়েছে।
অন্যদিকে, ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নিয়োগে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫ জন শিক্ষার্থী আবেদন করেন। এদের কেউই চূড়ান্ত নিয়োগ পাননি। এ বিভাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক একজন শিক্ষার্থী চূড়ান্তভাবে নিয়োগ পান, যার অনার্স ও মাস্টার্সের ফলাফল যথাক্রমে ৩.৭০ ও ৩.৭২, তার কোন গবেষণা বা শিক্ষকতার পূর্ব কোন অভিজ্ঞতাও ছিল না।
আবেদনপত্র বিশ্লেষণ করে আরো দেখা যায়, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত তিনজন শিক্ষার্থী নিয়োগ পাওয়া শিক্ষার্থীর চাইতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের ফলাফলে এগিয়ে ছিলেন। এছাড়া অন্তত ৭ জন শিক্ষার্থী মাস্টার্সের ফলাফলেও এগিয়ে আছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মোছাদ্দেকাতুন জান্নাত স্নাতকএ ৩.৮০ এবং স্নাতকোত্তরে ৩.৯৪ পেয়ে ও নিয়োগ পাননি। আরেক শিক্ষার্থী হাসনাহেনা অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম এবং দুইটি গবেষণা থাকা সত্ত্বেও বাদ পড়েন। বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী শহিদুল ইসলামও তার ব্যাচে অনার্সে ৩.৬৯ এবং মাস্টার্সে ৩.৮৭ পেয়ে প্রথম হন এছাড়া এ প্রার্থীর ৫ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ও তিনটি গবেষণা রয়েছে, তিনি ও বাদ পড়েন। আরেক প্রার্থী মোছাঃ খুরশিদা ইয়াছমিন তার ব্যাচে অনার্সে ৩.৭৪ এবং মাস্টার্সে ৩.৭৬ পেয়ে প্রথম হন এছাড়া এ প্রার্থীর শিক্ষকতার ও অভিজ্ঞতা রয়েছে। বাদ পড়ার তালিকায় তিনিও রয়েছেন।
ইংরেজি বিভাগের আবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, একটি পদের বিপরীতে মোট ৩৩ জন প্রার্থীকে পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়। এই বিভাগেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষার্থী আবেদন করেন, যার মধ্যে মিশকাতুল জান্নাত নামের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের ফলাফল, নিয়োগ পাওয়া প্রার্থীর চেয়েও এগিয়ে ছিলেন। এ বিভাগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী নিয়োগ পান।
এ বিষয়ে বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মোকছেদুল মুমিন বলেন, প্রতিষ্ঠার ১৭ বছরেও নিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তেমন শিক্ষক নিতে আমরা দেখি না, যদিও আমাদের কোয়ালিফাই শিক্ষার্থী রয়েছে। হয়ত পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার অভাবে অধিক পরিমাণে শিক্ষার্থী সেভাবে অগ্রগতি করার সুযোগ পায়না, তারপরেও অনেক শিক্ষার্থী নিজেদেরকে সংগ্রাম করে প্রস্তুত করেন কিন্তু দুঃখজনক, তারাও বঞ্চিত হচ্ছে। আমরা দেখি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বেরোবিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের আধিক্য বেশি। সেক্ষেত্রে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। এখানে স্বজনপ্রীতি থাকলেও থাকতে পারে। আবার নিজ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে (রাবি) তাদের প্রতি আলাদা সহানুভূতি থাকতে পারে।
কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী রহমত আলী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক উন্নয়নে নিজস্ব শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতায় সম্পৃক্ততা জরুরি। ইতোমধ্যে অনেক বেরোবিয়ান অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে। তাই নিয়োগে বেরোবিয়ানদের অগ্রাধিকার দেওয়া শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবী।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শওকাত আলীকে একাধিকবার ফোন দিলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
Comments