
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সীমা স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছেন দেশবাসীকে। দেশের বাইরেও আন্তর্জাতিক ফোরামে সরকার প্রধান বলেছেন ঘোষিত সময়ে নির্বাচন হওয়া নিয়ে তার অঙ্গীকারের কথা। এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) চিঠি দিয়ে ভোটের আয়োজন করার নির্দেশনাও দিয়েছেন।
রাজনীতির মাঠে তবুও নির্বাচন নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। এ নিয়ে উল্টো বাক্যালাপ শোনা যাচ্ছে কারো কারো কণ্ঠে। কিন্তু যাদের জন্য এই রাজনীতি, যাদের জীবন-জীবিকায় সচল দেশের অর্থনীতি- সমাজের সেই শ্রেণির মানুষের ভাবনা কী? নির্বাচন ঘোষিত সময়ে আদৌ হবে কীনা এ নিয়ে কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করছেন, আবার কারো কারো বিশ্বাস সরকারের প্রতি। অনেকেই বলছেন, নির্বাচন হলে দেশ নিয়ন্ত্রণে আসবে। তবে সবারই দাবি, আগের সরকারের মতো যেন কেউ ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে না চায়।
সরকার প্রধানের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণার পরও কেন উঠছে এই বাক্যালাপ- এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, অতীতে সরকারের প্রতি আস্থাহীনতার রেশের ফলেই কেউ কেউ এমন চিন্তা করছেন। তিনি বলেন, বিগত ১৫ বছর যেহেতু মানুষ ভোট দিতে পারেনি, এজন্য সংশয় রয়ে গেছে। তবে আমরা বারবার বলছি, ভোট ভালো হবে। শান্তিপূর্ণভাবে উৎসবমুখর পরিবেশেই ভোট অনুষ্ঠিত হবে। এজন্য যে পরিমাণ নিরাপত্তা দরকার, আমরা সেটার ব্যবস্থা করছি।
সরকার ঘোষিত সময়েই হবে আসছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উল্লেখ করে শফিকুল আলম বলেন, আমরা আমাদের জায়গায় একদম ঠিক আছি। এ নিয়ে কোন নেতা কী বলছেন, তা বিষয় নয়। আমরা জানি, পুরো বাংলাদেশের মানুষ অধীর আগ্রহে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছেন। এজন্য আমরা বারবার বলছি- নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে, রোজার আগেই হবে। এরইমধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এবার সর্বোচ্চ সংখ্যক আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক থাকবেন নির্বাচনের সময়ে। তবে তারা ২০১৪, ২০১৮ কিংবা ২০২৪ সালের মতো সাজানো পর্যবেক্ষক হবেন না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে সামনে যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেটা একেবারে নতুন এক পরিস্থিতিতে হতে যাচ্ছে। একদিকে আছে ফ্যাসিবাদী সরকারের সময় ঘটে যাওয়া হত্যা, দুর্নীতি ও অন্য অপরাধগুলোর বিচার করা এবং যেসব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়েছে, সেগুলোকে আবার গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করা। আরেক দিকে আছে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মানুষের যেসব আশা-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, সেই চাওয়াগুলোর প্রতিফলন ঘটানো। এই দুদিক মিলিয়েই এ নির্বাচনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। সরকার যতই আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা তৈরির চেষ্টা করুক, আর রাজনৈতিক দলগুলো ভোট পেতে যত কৌশলই নিক না কেন; যদি সাধারণ মানুষের আসল সমস্যা ও চাওয়া-পাওয়া নিয়ে সমাজে খোলাখুলি আলোচনা না হয়, আর সে বিষয়ে জনমত না গড়ে ওঠে, তাহলে সেগুলো উপেক্ষিত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এ নিয়ে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলেছেন। তিনি বলেন, নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি, দৃশ্যমানের পাশাপাশি অদৃশ্য ষড়যন্ত্রও চলছে। তার ভাষায়, ‘ভোট গণনার আগ পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাবে না।’
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘শুধু সরকারের সদিচ্ছা থাকলেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরও আন্তরিকতা থাকা দরকার। এখনো নানা উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। বিচার সংস্কার নিয়ে যে নাটক হচ্ছে, তা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। এসব কারণেই নির্বাচন ঘিরে মানুষের মনে সন্দেহ ও অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সুলতান মাহমুদ রানা বলেন, আমরা লক্ষ করেছি যে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক প্রার্থী তাদের প্রচারণায় তৎপর হয়ে উঠেছে। কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় সকল পর্যায়ের নেতারা প্রচারণায় মনোযোগ দিয়েছে। আবার জোট গঠনের বিষয়েও যথেষ্ট তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। পরিস্থিতি এখন এমন হয়েছে যে, দেশের জনগণ সংস্কার প্রশ্নে নির্বাচন আটকে থাকুক এমনটি আর চায় না। নির্বাচন আগে নাকি সংস্কার আগে- এই প্রশ্নে নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গটি এখন আর গুরুত্ব পাচ্ছে না। দীর্ঘদিন থেকে বাংলাদেশের মানুষের যে প্রাণের আকাঙ্ক্ষা, ভোট কেন্দ্রে গিয়ে একটি ভোট দেয়া, সেটা সত্যিকার অর্থে পূরণ হওয়ার চ্যালেঞ্জটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ কথা সত্য যে, নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, তাদের কাছে যে শক্তি, সাহস ও দক্ষতা থাকবে তা দিয়ে দেশের বিদ্যমান কাঠামোগত সমস্যার স্থায়ী সমাধান করার মানসিকতা থাকতে হবে। যেগুলো এ সরকারের (অন্তর্বর্তীকালীন সরকার) পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না, সেগুলো নির্বাচিত সরকার করবে- এমন প্রত্যাশা সাধারণ মানুষের। যেসব দল এবং প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নেবে তাদের সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা পূরণে আন্তরিক হওয়া উচিত।
Comments