Image description

চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই আগামী সোমবার (১৮ আগস্ট) দু’দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে দিল্লিতে আসছেন। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শনিবার (১৬ আগস্ট) এ তথ্য নিশ্চিত করে জানিয়েছে, তিনি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকরের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করবেন। সফরটি মঙ্গলবার (১৯ আগস্ট) শেষ হবে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ ট্যারিফ নীতির প্রভাব মোকাবিলায় ভারত-চীন-রাশিয়া ‘ট্রয়কা’র নৈকট্য বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে এই সফর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটি ভারত-চীন সম্পর্কে নতুন উষ্ণতা আনতে পারে, যার প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে, বিশেষ করে বাংলাদেশের উপর, উল্লেখযোগ্য হতে পারে।

সফরের মূল এজেন্ডা ‘লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল’ (এলএসি) সীমান্ত ইস্যু। ওয়াং ই অজিত দোভালের সঙ্গে ‘স্পেশাল রিপ্রেজেন্টেটিভ’ পর্যায়ের ২৪তম রাউন্ডের আলোচনায় অংশ নেবেন। ২০২০ সালের গালওয়ান সংঘর্ষের পর এই আলোচনা থমকে ছিল। গত বছর কাজানে ব্রিকস সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বৈঠকের পর এটি পুনরায় শুরু হয়। গত ডিসেম্বরে দোভাল বেইজিং সফরে ওয়াং ই-কে দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।

ওয়াং ই’র সফরের পর জয়শংকর ২১-২৩ আগস্ট মস্কোয় রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এছাড়া আগস্টের শেষে এসসিও সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি বেইজিং যাবেন, যা সাত বছরের মধ্যে তার প্রথম চীন সফর। এই সফরের প্রস্তুতিও ওয়াং ই’র দিল্লি সফরে আলোচ্য হবে।

সাম্প্রতিক উন্নয়ন ভারত-চীন সম্পর্কে উষ্ণতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এ বছর পাঁচ বছর পর ভারতীয় তীর্থযাত্রীরা কৈলাস মানসরোবরে যেতে পেরেছেন। জুলাই থেকে ভারত চীনা পর্যটকদের ভিসা প্রদান শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতির কারণে বৈশ্বিক বাণিজ্য শৃঙ্খলা ব্যাহত হওয়ায় ভারত ও চীন সীমান্ত বাণিজ্য পুনরায় শুরুর বিষয়ে আলোচনা করছে, যা পাঁচ বছর আগে বন্ধ হয়েছিল।

দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব

ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক জোরাওয়ার দাউলত সিং মনে করেন, এই সমঝোতা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক উন্নয়ন। তিনি বলেন, “এটি ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের ঠাণ্ডা যুদ্ধের পরিকল্পনা থেকে আলাদা করতে পারে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন কৌশলগত সমীকরণ তৈরি করবে। বাংলাদেশের জন্য এটি ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষার একটি সুযোগ হতে পারে, তবে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জও বাড়বে।”

কৌশলগত বিশ্লেষক মোহন গুরুস্বামী ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা মেজর-জেনারেল হেমন্ত কুমার সিং সীমান্ত চুক্তির স্পষ্টতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেন, “২০২০ সালের সংঘর্ষের পর চীনের কিছু অঞ্চলে প্রভাবশালী উপস্থিতি এখনও অমীমাংসিত। এই চুক্তি ভারতীয় ভূখণ্ডে চীনা দখল থেকে মুক্তির নিশ্চয়তা দেয় কি না, তা অস্পষ্ট। বাংলাদেশের জন্য এটি অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা বাড়াতে পারে, যদি ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়।”

ভারতের কৌশলগত বিশ্লেষক অনিল ত্রিগুনায়েত মনে করেন, “এই সমঝোতা ভারত ও চীনের মধ্যে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের চেষ্টা, যা কৌশলগত উত্তেজনার মধ্যেও টিকে থাকবে। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি জটিল পরিস্থিতি, কারণ দেশটি ভারত ও চীন উভয়ের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। তবে ভারত-চীন সম্পর্কের উন্নতি বাংলাদেশকে ভূরাজনৈতিক চাপ থেকে কিছুটা মুক্তি দিতে পারে।”

ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ঝাং জিয়াডং বলেন, “চীন ও ভারতের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সহযোগিতা কেবল উভয় দেশের জন্যই উপকারী নয়, বরং এটি এশিয়া এবং বিশ্বের কৌশলগত দৃশ্যপটকে পুনর্গঠন করতে পারে। বাংলাদেশের জন্য এটি অর্থনৈতিক সুযোগ বাড়াতে পারে, তবে কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে।”

বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাব

চীন-ভারত সম্পর্কের উন্নতি বাংলাদেশের রাজনীতি ও কূটনীতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবে ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে, তবে চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত সহযোগিতাও ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান এই দুই প্রতিবেশী শক্তির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার উপর নির্ভর করে। অধ্যাপক সাহাব এনাম খান বলেন, “চীন-ভারত সম্পর্কের উষ্ণতা বাংলাদেশের জন্য কূটনৈতিক স্থান প্রশস্ত করতে পারে। এটি বাংলাদেশকে উভয় দেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার সুযোগ দেবে, তবে এটি একটি নির্দিষ্ট দেশের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা কমানোর ক্ষেত্রেও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।”

ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে ‘গুরুতর উদ্বেগ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, “চীনের প্রভাব বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।” তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে চীনের বিনিয়োগ বাড়ছে, যা ভারতের কৌশলগত স্বার্থের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।

ভারতীয় সাংবাদিক মহেন্দ্র বেদ বলেন, “চীন-ভারত সম্পর্কের উন্নতি বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন কৌশলগত অবস্থান তৈরি করতে পারে। তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং চীনের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা ভারতের জন্য উদ্বেগের বিষয়। এটি বাংলাদেশের কূটনৈতিক নীতিতে ভারসাম্য বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তাকে আরও জোরদার করে।”

থিংক ট্যাংক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক থমাস কিন বলেন, “চীন-ভারত সম্পর্কের উষ্ণতা বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সুযোগ তৈরি করতে পারে। তবে বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে যাতে এটি কোনো একটি শক্তির প্রভাবের অধীনে না পড়ে।” তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে, যা ভারতের জন্য কৌশলগত চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।”

অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাব

চীন-ভারত সম্পর্কের উন্নতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক কৌশলের উপর প্রভাব ফেলবে। চীন বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বড় বিনিয়োগকারী, যেমন পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল এবং চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন। অন্যদিকে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য, সীমান্ত চুক্তি এবং নিরাপত্তা সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ। চীন-ভারত সম্পর্কের উষ্ণতা বাংলাদেশকে উভয় দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ দিতে পারে, তবে এটি কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার চ্যালেঞ্জও তৈরি করবে।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফর এবং চীনা বিনিয়োগের প্রতি উৎসাহ বাংলাদেশের কৌশলগত পুনঃসংযোজনের ইঙ্গিত দেয়। তবে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি, বিশেষ করে শেখ হাসিনার পতনের পর, বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থানকে জটিল করে তুলেছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, চীন-ভারত সম্পর্কের উন্নতি বাংলাদেশকে ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েন থেকে কিছুটা মুক্তি দিতে পারে, তবে দেশটিকে উভয় শক্তির স্বার্থের মধ্যে সতর্কভাবে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। প্রশ্ন উঠছে, ‘ড্রাগন ও হাতি একসঙ্গে নাচলে বাংলাদেশ কীভাবে নিজের সুরে নাচবে?’