Image description

বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য আজ বিষের ফাঁদে বিপন্ন। প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা থাকলেও কিছু অসাধু জেলে বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকার করছে, যা বনের মাছ, জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। এর পেছনে রয়েছে প্রভাবশালী মহাজন ও বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশ, যারা ঘুষের বিনিময়ে এই অপকর্মে মদদ দিচ্ছে।

বিষ প্রয়োগে ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য
প্রতি বছর ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনে মাছ ধরা নিষিদ্ধ। এ সময় বনের নদী-খালে মাছ ও বন্যপ্রাণীর প্রজনন ঘটে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পূর্ণিমা ও অমাবস্যার সময় গহিন বনে বিষ ছিটিয়ে মাছ শিকার করা হচ্ছে।

খুলনার দাকোপ উপজেলার সুতারখালির জেলে মোজাম ফকির জানান, “সন্ধ্যা নামার আগে আমরা গহিন বনে অবস্থান নিই। জোয়ারের আগে কীটনাশক মিশ্রিত খাবার পানিতে ছিটিয়ে দিই। ভাটার সময় মাছ নিস্তেজ হয়ে জালে আটকে যায়।” এতে বড় মাছ সংগ্রহ করা হলেও ছোট মাছ ও জলজ প্রাণী ধ্বংস হয়ে যায়, যা খাদ্যচক্র ও জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।

মহাজনদের দাদনের ফাঁদ
সুন্দরবনের জেলেরা মহাজনদের কাছে দাদনের জালে জড়িয়ে পড়েছে। মহাজনরা বন বিভাগের সঙ্গে যোগসাজশ করে অভয়ারণ্যের নদী-খাল ইজারা নিয়ে জেলেদের বিষ দিয়ে মাছ ধরতে বাধ্য করছে।

কয়রার তেঁতুলতলার জেলে গফুর গাজী বলেন, “মহাজনরা বন বিভাগকে টাকা দিয়ে খাল দখল করে। আমরা না গেলে পেট চলে না। কিন্তু প্রতিবাদ করলে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়।”

মহাজনদের নিয়ন্ত্রণে থাকা জেলেদের বিএলসি (বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট) নিয়ন্ত্রণ করা হয়, যা তাদের আরও নির্ভরশীল করে তোলে।

দুর্বল প্রশাসন ও অপরাধী চক্র
বন বিভাগের দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামো এই অপকর্মকে উৎসাহিত করছে। ভাঙাচোরা টহল ফাঁড়ি, আধুনিক অস্ত্র ও জলযানের অভাব এবং জনবল সংকটের কারণে বন কর্মকর্তা-প্রহরীরা অপরাধীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না।

কয়রা সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি তারিক লিটু বলেন, “প্রভাবশালী মহাজনরা বন বিভাগকে ম্যানেজ করে সারা বছর বিষ দিয়ে মাছ শিকার করছে। এমনকি হরিণ নিধনও চলছে।” তিনি বনজীবীদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান ও কঠোর আইন প্রয়োগের দাবি জানান।

বিষাক্ত মাছের বাজার
বিষ দিয়ে ধরা মাছ স্থানীয় বাজারে বিক্রি না করে শুঁটকি করে ঢাকাসহ বড় শহরে পাঠানো হচ্ছে। কয়রার দক্ষিণ বেদকাশির জেলে আনোয়ার হোসেন বলেন, “বিষের গন্ধের কারণে এসব মাছ স্থানীয়রা খায় না। বনের গহিনে অবৈধ খটিঘরে শুঁটকি তৈরি করে চড়া দামে বিক্রি করা হয়।” এসব শুঁটকি রেস্তোরাঁ, সুপারশপ ও অনলাইনে ‘সুন্দরবনের মাছ’ হিসেবে বিক্রি হচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি।

বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, “কীটনাশকের বিষক্রিয়া খালে মাস থেকে বছর পর্যন্ত থাকে, যা জলজ প্রাণী ও খাদ্যচক্রকে ধ্বংস করছে।” ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক নাজমুল আহসান বলেন, “বিষ মাছের শরীরে থেকে যায়, যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক।” খুলনার ডেপুটি সিভিল সার্জন সৈকত মো. রেজওয়ানুল হক সতর্ক করে বলেন, “বিষাক্ত মাছ খেলে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে।”

বন বিভাগের দাবি
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ দাবি করেন, “জনবল সংকট থাকলেও আমরা অপরাধ দমনে সচেষ্ট।”

সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, “ড্রোন নজরদারির মাধ্যমে অবৈধ জেলেদের গ্রেপ্তার ও শুঁটকি কারখানা ধ্বংস করা হচ্ছে।” তবে জেলেরা অভিযোগ করেন, বন কর্মকর্তারা ঘুষ নিয়ে অপরাধীদের ছাড় দিচ্ছেন।

সমাধানের পথ
বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয়রা মনে করেন, সুন্দরবন সুরক্ষায় বন বিভাগের স্বচ্ছতা, জনবল বৃদ্ধি, আধুনিক সরঞ্জামের ব্যবহার ও বনজীবীদের বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা প্রয়োজন। সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের ওবায়দুল কবির সম্রাট বলেন, “মহাজন ও অসাধু কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।”

প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, “ডিজিটাল প্রযুক্তি ও কমিউনিটি সুরক্ষা বলয়ের মাধ্যমে বন অপরাধ কমানো হচ্ছে।”

সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কঠোর আইন প্রয়োগ ও সামাজিক সচেতনতা এখন সময়ের দাবি।