
দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের চিত্র ভয়াবহ- ব্যাংক খাতের অবস্থা এমন হয়েছে, ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন। খেলাপি ঋণে জর্জরিত দেশের আর্থিক খাত রীতিমতো ‘ক্যানসারে’ রূপ নিয়েছে। খেলাপি ঋণ অর্থনীতির জন্য এক ভয়াবহ সংকেত। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বর্তমানে যে সমস্যার সম্মুখীন, তার অন্যতম প্রধান কারণ হলো খেলাপি ঋণের উচ্চহার। ব্যাংকগুলোতে মোট বিতরণকৃত ঋণের একটি বড় অংশই এখন খেলাপি ঋণ হিসেবে চিহ্নিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে- চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত শীর্ষ একশ ঋণখেলাপির কাছে বিভিন্ন ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা ১ লাখ ৮ হাজার ১৩২ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের ২৬ শতাংশ। এর মধ্যে ৬২টি প্রতিষ্ঠান শতভাগ খেলাপি। এই ঋণের পুরোটাই আদায় অযোগ্য (কুঋণ)। এর বড় অংশই সরকারি ব্যাংকে। এই অর্থ দিয়ে তিনটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। সূত্র জানায়, শীর্ষ ১০০ খেলাপির তালিকায় উঠে এসেছে এস আলম গ্রুপের ১০ প্রতিষ্ঠান।
এই প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ৬১ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে মার্চ পর্যন্ত খেলাপি দেখানো হয়েছে ২২ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা। অন্যদিকে বেক্সিমকো গ্রুপের নামে-বেনামে গ্রুপটির ২৮টি প্রতিষ্ঠানের নামে ২৮ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে খেলাপি ২৫ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা।
বেক্সিমকোর এই ২৮ প্রতিষ্ঠানের ২৬টিই শতভাগ খেলাপি। আবার শীর্ষ খেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৪৫ শতাংশই বেক্সিমকো এবং এস আলমের। শুধু এই দুটি গ্রুপের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোয় ইতোমধ্যে যে কুঋণ হয়েছে, তা দিয়েই পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেলের ব্যয় মেটানো সম্ভব। কিছু প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের জন্য সংকটে পড়ছে পুরো দেশের মানুষ। ব্যাংকগুলোর সৃষ্টি হচ্ছে তারল্য সংকট- যা সাধারণ আমানতকারীদের আস্থার ঘাটতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে- বড় বড় ঋণখেলাপিদের অনেকেই প্রভাবশালী ও রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত। তাই আইনি বা প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রেও দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি ও নিয়মনীতি কঠোরভাবে প্রয়োগের ফলে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র একে একে সামনে আসছে।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে লুটপাটের ঋণ এখন খেলাপি হচ্ছে। এ কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে বেপরোয়া গতিতে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে যে অর্থ বের করে নেয়া হয়েছে, নিয়মনীতি সঠিকভাবে পরিপালন না করার কারণে এখন তা খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে। ফলে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে।
খেলাপি ঋণের এ চিত্র যে খুবই হতাশার ও আশঙ্কাজনক, তা বলাই বাহুল্য। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে যত্রতত্র দুঃসাহসিক পদক্ষেপের কারণে নিজেদের বিপদের মুখে ফেলেছে কয়েকটি ব্যাংক। ঋণ আদায় আটকে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনায় সৃষ্টি হয়েছে তীব্র আর্থিক সংকট, যা তাদের মূলধনের স্থিতিশীলতাকেও নড়বড়ে করে তুলেছে।
সময়মতো ঋণ আদায়ে ব্যর্থ হওয়ার পর এসব ব্যাংকের কাঁধে এখন খেলাপির বোঝা এতটাই চেপে বসেছে, যেখানে নতুন পরিকল্পনায় মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর সক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে। শুধু তাই নয়- সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, ভবিষ্যতে খেলাপি ঋণ আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। দলীয় প্রভাবের কারণে কয়েকটি ব্যাংকের আর্থিক কার্যক্রম মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়েছে। ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ দেশের ব্যাংক খাতের কোমর ভেঙে দিয়েছে। ব্যাংকগুলো থেকে ঋণের নামে অর্থ লুট হওয়ায় এ খাতে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
এ চিত্র একটি দেশের জন্য মোটেও ভালো সংবাদ নয়। দ্রুত এ অবস্থার উত্তরণ সম্ভব না হলে আরও ভয়াবহতা দেখা দেবে, এতে আমাদের দেশের তরুণ সমাজের স্বপ্ন ভেস্তে যাবে। ব্যাংকিং খাতে চরম অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়ায় সংকট তৈরি হয়েছে। ব্যবসা পরিচালনার নামে দেশের তফসিলি ব্যাংক থেকে বিশাল অঙ্কের টাকা নিয়ে হজম করে ফেলেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। যেহেতু ব্যাংকিং খাতের টাকা জনগণের কষ্টার্জিত অর্থের আমানত, তাই এ খাতের দুর্বৃত্তদের কোনো ধরনের ছাড় দেয়ার অবকাশ নেই।
রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে খেলাপি ঋণ কমানো সম্ভব নয়। যত আইন করা হোক, কোনো লাভ নেই, যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকে। ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে হলে প্রথমেই ঋণখেলাপিসহ প্রতিটি অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তা-পরিচালকদের সাজা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের মধ্য দিয়ে আর্থিক খাতের সংস্কার সময়ের দাবি। ব্যাংক খাতকে পুনরায় শক্তিশালী করতে এসব খেলাপি ঋণের অর্থ আদায়ে কঠোর ও কৌশলী পদক্ষেপের যে বিকল্প নেই। প্রয়োজনে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে ঋণের অর্থ লোপাটের এ সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে।
দেশের অর্থনীতির গতি বেগবান করতে অন্তর্বর্তী সরকার কার্যকর পদ্ধতি গ্রহণ করবে- এটাই প্রত্যাশা। ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে হলে প্রথমেই ঋণখেলাপিসহ প্রতিটি অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তা-পরিচালকদের সাজা নিশ্চিত করতে হবে। এ খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ছাড়া দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনা টেকসই হতে পারে না। এখনই সময় কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার। সর্বোপরি, কঠোর নীতিমালা গ্রহণ এবং কার্যকর বাস্তবায়নেই এ সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব বলে করছেন সবাই।
Comments