
একটা সময় ছিল, যখন মা-বাবারা সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করাতে চাইতেন কাছের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। শিক্ষক ও তার ছাত্রছাত্রীদের মন প্রাণ ঢেলে শিক্ষা দিতেন। শিক্ষক এবং ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে এত চমৎকার একটা সেতুবন্ধন তৈরি হতো যা সত্যিই অসাধারণ। এখন ভাবতে গেলে মনে হয় এটি ইতিহাসের গল্প। কোনো অলঙ্কার না থাকলেও সেখানে ছিল সাহিত্যের স্বাদ, ইতিহাসের গল্প, স্বাধীনতার গন্ধ, আর একটা আন্তরিক দেশি শেকড়।
দল বেঁধে পাঠশালায় যাওয়ার সে কি আনন্দ। আগের স্লোগান ছিল- ‘শিক্ষার জন্য এসো সেবার জন্য বেড়িয়ে যাও’ কিন্তু সময় বদলেছে। এখন বহু পরিবার, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের দিকেই ঝুঁকছে। বিশেষ করে যারা কিনা নব ধনী, নব টাকার মুখ দেখেছে। আগে কখনও ঘুষ কথাটি শুনিনি এখন এটা মামুলি ব্যাপার। মাঝে মাঝে মনে হয় এই মানুষগুলো অতীত ভুলে গিয়েছে। কীভাবে তার উঠে আসা এটা সে অহংকার না ভেবে হীনম্মন্যতায় ভুগে জীবন পাল্টাতে চায় অন্য পথে। কারও জন্য এটা স্ট্যাটাস, কারও জন্য ভবিষ্যতের বিনিয়োগ। তাদের যুক্তি সহজ, ‘আজকের বিশ্ব গ্লোবাল, ইংরেজি না জানলে পিছিয়ে পড়তে হবে।’
এটা তাদের জ্ঞানের অভাব বলবো না এটা তার অদক্ষতা। এসব মানুষের অনেক আত্মীয়স্বজন অনেক আগে থেকে বিদেশে থাকে কিন্তু কোনো যোগাযোগ তো করেই না বরং এই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে আপনজনরা থাকে তাদেরকে অশিক্ষিত, মূর্খ বলে খাটো করে। তারা কখনই এই আলো বাতাসে বড় না হয়েই বিদেশে গিয়েছে। সেখানে গিয়ে বড় বড় কথা বলে, নিজেদের সাথে দেশে বাস করা আপনজনদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে, সাহায্য সহযোগিতা করে না।
তাই এখন যাদের চলার মতো অবস্থা আছে সেও সন্তানদের নিয়ে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। বুঝলাম গোটা বিশ্ব হাতের মুঠোয়। এখানে বিদেশি ভাষা লাগবে, তার অর্থ এই নয় ইংলিশ মিডিয়ামে পড়তে হবে। প্রশ্নটা গভীরতর, ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষাব্যবস্থা কি আদৌ বাংলাদেশের আবহাওয়ায় যুগোপযোগী? এই ব্যবস্থায় বেড়ে ওঠা সন্তানরা কতটা প্রস্তুত এই দেশের বাস্তবতার জন্য? এখানে ছেলে-মেয়েরা না ভালো বাংলা পারছে না ইংরেজি। উচ্চারণে অনেক ভুল। নিজের কথার স্টাইল পাল্টে ফেলছে। অনেক বাবা মা গর্ব করে বলে আমার সন্তান বাংলা বলতে পারে না। অদ্ভুত বিষয়। আমি পরীক্ষিত আমি ইংলিশ মিডিয়ামের বাচ্চা কে বাংলা অক্ষর চিনিয়েছি, শিখিয়েছি।
সত্যি বলতে কি, ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষার্থীরা ইংরেজি ভাষায় স্বচ্ছন্দ হয়ে ওঠে, তাদের চিন্তা ও উপস্থাপন-ক্ষমতা অনেক ক্ষেত্রেই উন্নত হয়। তবে এদের সংখ্যা খুব কম।এরা বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় না। কিছু ছেলে মেয়ে সত্যি ভালো করতে চায় তারা আইবিএ, মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা বিদেশে উচ্চশিক্ষা, এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় এগিয়ে থাকে। গ্লোবাল কারিকুলাম যেমন O/A Level, CSE কিংবা ওই-তে প্র্যাকটিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট, গবেষণাধর্মী শিক্ষা ও বিশ্লেষণমূলক প্রশ্নের চর্চা থাকে, যা শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশে সহায়ক।
তবে সেটা চর্চায় থাকলেই হয়। এরজন্য ব্যাঙের ছাতার মতো কোচিং-এ দৌড়াতে হয় না। কিন্তু এই সুবিধার সাথে সাথে ছায়াও দীর্ঘ হয়। বাংলাদেশকে বোঝা, অনুভব করা, ভালবাসা শেখা, এই পাঠ কি তারা পাচ্ছে? কতজন ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষার্থী জানে ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটা কোথা থেকে এসেছে? কতজনের মুখে আমরা শুনি, ‘বাংলা খুব কঠিন লাগে’, কিংবা ‘আমি বাংলা ঠিকমতো লিখতে পারি না’? এটা নিছক ভাষার সমস্যা নয়, এটা এক সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতার লক্ষণ।
এটার জন্য সবার আগে পরিবার দায়ী। পরিবার হলো আসল পাঠশালা, সেখানে নড়বড়ে হলে সব শেষ। এই প্রজন্মের অনেক ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষার্থী আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে আত্মিকভাবে জড়িত নয়। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, গ্রামীণ সমাজ, কৃষি অর্থনীতি কিংবা প্রান্তিক মানুষের জীবনসংগ্রাম, এসব বিষয় অনেকটা অচেনা তাদের কাছে। অথচ এগুলোই আমাদের জাতিসত্তার মেরুদণ্ড।
শুধু ইতিহাস নয়, বাংলা সাহিত্যের রস-আহরণেও দুর্বলতা লক্ষণীয়। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ বা ‘দুর্জয় বাংলা’ শুধু বইয়ের লাইনে থেকে যাচ্ছে, হৃদয়ে জায়গা পাচ্ছে না।এটা বড়ই দুঃখের এবং পরিতাপের বিষয়। তবে ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যেখানে সর্বোচ্চ সংখ্যক কর্মসংস্থান, মিডিয়া, প্রশাসন, আইন, রাজনীতি, সবকিছুই এখনো বাংলাভাষায় চলে। আপনি যদি বাংলাদেশের পত্রিকায় কলাম লিখতে চান, আদালতে কাজ করতে চান, শিক্ষকতা করতে চান, সাংবাদিক হতে চান, তাহলে বাংলা জানা জরুরি। ইংরেজির পারদর্শিতা হোক না হোক, মাতৃভাষা না জানলে এই ভূখণ্ডে স্থায়ী অবদান রাখা কঠিন। তাই ইংরেজি শিক্ষা শিখতে হবে বিশ্বের সাথে তাল দিয়ে চলার জন্যে।
বেশিরভাগ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ব্যয়বহুল। একটি পরিবারের বড় একটি অংশের আয় এই শিক্ষার পেছনে ব্যয় হয়। কখনো কখনো দেখা যায়, বাবা-মা নিজেরা দেশীয় চাকরি করছেন, জীবনে বইপত্র ছুঁয়ে দেখার অবকাশ পাননি, অথচ সন্তানকে ইংরেজি মিডিয়ামে পড়াচ্ছেন ‘দূরদৃষ্টির’ নামে। সন্তান যখন বড় হয়, নিজের সমাজকে চেনে না, বাংলায় পড়তে-লিখতে কষ্ট হয়, তখন দূরত্ব তৈরি হয় নিজের পরিবার ও পরিবেশের সাথেই। তখন অনেক ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।
সন্তানের সাথে অভিভাবকদের নানান বিষয়ে জবাবদিহিতায় পড়তে হয়। এতে করে সমাজে বৈষম্যের ঘটনা রটনা বেড়েই চলেছে। এই disconnect ভবিষ্যতে জটিলতা তৈরি করতে পারে, পারিবারিক, মানসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে। অনেক তরুণ-তরুণী ‘আমি বাংলাদেশের নাগরিক, কিন্তু এই দেশে থাকতে চাই না’, এই মনোভাব নিয়ে বেড়ে ওঠে। এ যেন এক ধরনের শেকড় বিচ্ছিন্নতা। একটা উদ্ভিদ যেমন মাটি ছাড়লে টিকে থাকতে পারে না, তেমনি মানুষও শেকড়হীন হলে ভাসমান হয়ে যায়।
এই যে সন্তানের মধ্যে মূল্যবোধ তৈরি হচ্ছে না এটা কি রাজনৈতিক দল, সরকার, পাড়া প্রতিবেশী নাকি পারিবারিক অবকাঠামো দায়ী। সমাধান কিন্তু ইংলিশ মিডিয়াম বন্ধ করা নয়। বরং চাই দ্বিভাষিক, দ্বিমাত্রিক ও ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষা। ইংলিশ মিডিয়ামে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও ইতিহাস যেন বাধ্যতামূলক ও প্রাণবন্তভাবে শেখানো হয়। ‘বাংলাদেশ স্টাডিজ’ যেন শুধু একটি সাবজেক্ট না হয়ে, দেশের প্রতি ভালোবাসার শিক্ষায় রূপ নেয়। এ বিষয়ে সবাইকে যৌথভাবে এগিয়ে এসে কাজ করতে হবে।
শিশুরা যেন নিজেদের দেশের গ্রাম-গঞ্জ, কবি-সাহিত্যিক, সংগ্রামী ইতিহাস সম্পর্কে জানে, এইটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বাংলা সাহিত্যের আস্বাদন, গানের রসে ভেজা শৈশব, এগুলো একটি শিশুকে ‘সম্পূর্ণ মানুষ’ করে তোলে। এছাড়া, অভিভাবকদেরও চাই সচেতনতা। সন্তানকে শুধু ইংরেজি শেখানোই নয়, বরং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা তৈরি করাও তাদের দায়িত্ব। সন্তানদের বাংলা বই উপহার দিন, রবীন্দ্রনাথ-সুকুমার রায়ের গল্প শোনান, একুশে ফেব্রুয়ারি বা ১৬ ডিসেম্বরের মানে বোঝান। এদের মধ্যে চেতনা জাগ্রত করুন। সন্তানরা মিডিয়াতে যে ভুল উত্তর বলে এটা কি শুধু দেশের লজ্জা নাকি এ দায় সবার।
আমরা চাই আমাদের সন্তান হোক বিশ্বনাগরিক, তাকে হতে হবে ইংরেজিতে দক্ষ, প্রযুক্তিতে অগ্রসর, বিশ্বপরিসরে সক্ষম। কিন্তু এর মানে এই নয় যে সে নিজের দেশকে ভুলে যাবে, নিজের ভাষাকে অস্বীকার করবে, নিজের শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হবে।
একটি সুস্থ জাতি গড়ে ওঠে তখনই, যখন তার সন্তানরা একইসাথে গ্লোবাল চিন্তায় সমৃদ্ধ এবং দেশীয় মাটিতে দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত। আমরা চাই সেই প্রজন্ম, যারা রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে হার্ভার্ডে পড়তে যাবে, নজরুলের কবিতা মুখস্থ রেখেই নিউইয়র্কে কর্পোরেট প্রেজেন্টেশন দেবে, আর লাল-সবুজের পতাকা হাতে পৃথিবীর বুকে বলবে, ‘আমি বাংলাদেশি, আমি গর্বিত।’
লেখক: শিক্ষিকা ও কলামিস্ট
Comments