Image description

যার কাছে বাঙালির অশেষ ঋণ। যার প্রগতিশীল প্রণোদনায় বাঙালি প্রেম আর দ্রোহের ভাষা খুঁজে পেয়েছে, উদ্বুদ্ধ হয়েছে শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে। বাংলা সাহিত্য জগতের প্রবাদপ্রতিম পুরুষ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৬তম জন্মবার্ষিকী আজ। ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।

রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পর প্রথম বারের মতো জন্মজয়ন্তীর এ আয়োজন নিঃসন্দেহে গৌরবময়। এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান: কাজী নজরুলের উত্তরাধিকার।’

কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ ও দার্শনিক। সাহিত্যের সব শাখায় তার বিচরণ থাকলেও তিনি মূলত কবি হিসাবেই সবচেয়ে বেশি পরিচিত। কাজী নজরুল ইসলামের ডাকনাম ছিল ‘দুখু মিয়া’।

তিনি গ্রামের স্থানীয় মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করতেন। মক্তবে কুরআন, ইসলাম ধর্ম, দর্শন এবং ইসলামি ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৯০৮ সালে বাবার মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল মাত্র নয় বছর। পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে তার শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্ত হয় এবং মাত্র দশ বছর বয়সে জীবিকা অর্জনের জন্য তাকে কাজে নামতে হয়।

নজরুল মক্তব থেকে নিম্ন-মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সে মক্তবেই শিক্ষকতা শুরু করেন। আর্থিক সমস্যায় ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর তাকে আবার কাজে ফিরে যেতে হয়। প্রথমে তিনি যোগ দেন বাসুদেবের কবিদলে। এর পর একজন খ্রিষ্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা এবং সবশেষে আসানসোলের চা-রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন।

১৯১৭ সালের শেষদিকে তিনি সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসাবে যোগ দেন। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পথে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করেন। এ দুটি হচ্ছে বিদ্রোহী কবিতা ও ভাঙার গান সংগীত। একই সময় তিনি লিখেছিলেন আরেকটি বিখ্যাত কবিতা কামাল পাশা। ১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়।

নিজের লেখনীর মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্য, সম্প্রতি ও মানবতার জয়গান গেয়েছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ২৪ মে কবিকে সপরিবার বাংলাদেশে নিয়ে আসেন তৎকালীন সরকার। বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিদ্রোহী কবি নজরুলকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে।

১৯৭৬ সালে তৎকালীন সরকার কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি কবিকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (পিজি) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাঙালির চেতনার কবি নজরুল। ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই, যেন গোর থেকে মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই’ মৃত্যু চেতনার এমন গানে মসজিদের পাশে কবিকে সমাহিত করার আবেদন জানিয়েছিলেন বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।

জাতীয় পর্যায়ে কর্মসূচি: জাতীয় কবির জন্মবার্ষিকী উদযাপনে তিন দিনব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। শিল্পকলা একাডেমির সহযোগিতায় ঢাকাসহ কুমিল্লা, ত্রিশাল ও নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত হচ্ছে নানা অনুষ্ঠান।

রোববার বিকেল ৩টায় কুমিল্লা জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে তিন দিনের কেন্দ্রীয় আয়োজনের উদ্বোধন করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। এসময় ‘নজরুল পুরস্কার ২০২৩ ও ২০২৪’-এর মনোনীতদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে। আয়োজনজুড়ে থাকবে আলোচনা, আবৃত্তি, সংগীত, নৃত্য ও নাটক। ত্রিশালে তিন দিন এবং জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই দিনব্যাপী উৎসব অনুষ্ঠিত হবে।

অন্যান্য আয়োজন: বাংলা একাডেমি সকালে কবির সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। বিকেল ৪টায় একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হবে নজরুল বিষয়ক সেমিনার। এতে স্বাগত বক্তব্য রাখবেন মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম।

সংগীত সংগঠন ছায়ানট দুই দিনব্যাপী নজরুল উৎসবের আয়োজন করেছে। আজ সন্ধ্যায় শুরু হওয়া এই উৎসবে থাকছে একক ও সম্মেলন সংগীত, নৃত্য ও আবৃত্তি।

বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কর্মী সংঘও দুই দিনব্যাপী নজরুল উৎসবের আয়োজন করেছে। আজ সন্ধ্যায় জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে শুরু হবে তাদের অনুষ্ঠানমালা। কবির জীবন, সাহিত্য ও চেতনায় আগামী প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করতে এ বছরও নানা আয়োজনে উদযাপিত হচ্ছে নজরুল জয়ন্তী।