Image description

আমাদের দেশে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের মানুষের সবচেয়ে বড় ধর্মনিরপেক্ষ ও সার্বজনীন লোক-উৎসব হলো বাংলা বর্ষবরণ। এ দেশে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের রয়েছে আলাদা আলাদা সামাজিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান। একই পাড়া-মহল্লা বা এলাকায় বসবাস করেও এক সম্প্রদায়ের মানুষ অন্য সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন না। 

এতে অবশ্য শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ক্ষেত্রে কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি হতে দেখা যায় না। এই সহাবস্থানের ঐতিহ্যকে বাঙালি জাতি দীর্ঘদিন ধরেই লালন করে আসছে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা রাজ্যে আছে বিপুল সংখ্যক বাঙালির বসবাস। তাদেরও আছে আলাদা সামাজিক রীতি-নীতি। আবার বাংলাদেশের আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকেরাও বছর জুড়ে নানা সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব পালন করে। কিন্তু পহেলা বৈশাখে নববর্ষ উদযাপনের ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমানসহ সকল সম্প্রদায় একসঙ্গে উৎসবে মেতে ওঠে। এক্ষেত্রে ধর্ম-বর্ণ ও সামাজিক ভেদাভেদ কোনো বাধা সৃষ্টি করে না। 

এ কারণে পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণ উৎসবকে বাঙালির সার্বজনীন লোক-উৎসব বলে অভিহিত করা যায়। এটা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙালির প্রাণের উৎসব। এ উৎসবে বাংলার লোক-ঐতিহ্যকে তুলে ধরা হয়। শুধু বাঙালি জাতি নয়, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি জাতি নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে হৃদয়ে ধারণ করার জন্য বিশেষ বিশেষ দিনকে উদযাপন করে। যেমন, আরব জাতি প্রাচীন আরবীয় ঐতিহ্য ‘ওকাজের মেলা’, ইরানিরা ইরানী ঐতিহ্য ‘নওরোজ উৎসব’, ভারতীয়রা প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য ‘দোলপূর্ণিমা’ উদযাপনের মাধ্যমে নিজেদের ঐতিহ্যকে তুলে ধরে। একইভাবে বাঙালি জাতি বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ উদযাপনের মধ্য দিয়ে নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরে।  

দীর্ঘদিন ব্রিটিশ শাসনাধীনে থেকে বাঙালি জাতির যাপিত জীবনে যে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এসেছিল তার ফলে বাংলা সন-তারিখ গণনাকে বাঙালিরা ভুলেই বসেছিল। সেই ধারাহিকতায় এখনো বেশিরভাগ মানুষ বাংলা সন-তারিখ মনে রাখেন না। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত না হওয়ার কারণে মনে রাখাও সম্ভব হয় না। কিন্তু এই বাংলা সন-তারিখের পেছনে আমাদের যে অন্তরের যোগ-তা কিছুতেই মুছে যাবার নয়। ঋতু পরিবর্তনের সময় বাংলা মাসগুলোই আমাদের মনে আসে। বছরজুড়ে বাংলা নববর্ষ আমাদের জাতিসত্তার আত্মপরিচয় বহন করে চলে। তাই আমরা যতোই ইংরেজি সন-তারিখ ব্যবহার করি না কেন- বাংলা সন-তারিখ আত্মার আত্মীয় হিসেবে আমাদের যাপিত জীবনে ঘুরে-ফিরে আসে। বাঙালি জাতি বাংলা নববর্ষ যে উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে উদযাপন করে তাতেই বোঝা যায় বাংলা সনের সঙ্গে বাঙালির প্রাণের যোগ কতোটা গভীর।

বাংলা নববর্ষ বাঙালির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশেষ করে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামো ও কৃষি সংস্কৃতির সঙ্গে বাংলা সন-তারিখের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় ও গভীর। বাংলার কৃষকেরা এখনো বাংলা মাসের হিসেবেই জমিতে বীজ বোনে, ফসল কাটে। বর্তমানে প্রচলিত বাংলা সনের প্রবর্তন নিয়ে নানা মত ও ভিন্নমত থাকলেও অধিকাংশের মতে, শস্যের মাধ্যমে কৃষকের খাজনা প্রদানের সুবিধার্থে মোগল সম্রাট আকবর ‘ফসলি সন’ হিসেবে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তখন ফসলের মাধ্যমে রাজস্ব বা খাজনা আদায়ের প্রচলন ছিল। কখনো কখনো কৃষক ঘরে ফসল তোলার আগেই খাজনা আদায়ের দিনটি এসে যেতো। 

এতে কৃষক-প্রজারা খাজনা দিতে পারতো না বা খাজনা দিতে খুবই অসুবিধা হতো। সম্রাট আকবর প্রজাদের এই অসুবিধা দূর করার জন্যই নতুন বাংলা সন প্রবর্তন করেন। এই বাংলা সন বাংলা ও বাঙালি জাতির নামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে ‘বঙ্গাব্দ’ নামে পরিচিতি লাভ করে। বঙ্গাব্দ প্রবর্তনের মাধ্যমে ভারতের বিভিন্ন সুবা বা প্রদেশের খাজনা আদায়ের দিন-তারিখে একটি অভিন্নতা প্রতিষ্ঠা পায়।

এই বঙ্গাব্দের প্রথম মাস বৈশাখ। বৈশাখের প্রথম দিনটি ‘বাংলা নববর্ষ’ হিসেবে উদযাপন করা হয়। নবাবী শাসনামলে নবাব মুর্শিদকুলী খানের সময় বৈশাখ মাসকে বাংলার কৃষকের খাজনা আদায়ের মাস হিসেবে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। তখন কৃষকেরা চৈত্র-বৈশাখ মাসেই অধিকাংশ ফসল ঘরে তুলতেন। এতে কৃষকের খাজনা দেওয়া সহজ হয় এবং সরকারের রাজস্ব বেড়ে যায়। এভাবে মুর্শিদকুলী খান বাংলার রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি করেন। মুর্শিদকুলী খান ত্রুটিপূর্ণ ভ‚মিব্যবস্থার আমূল সংস্কার করে ভূমি রাজস্বের পরিমাণও বৃদ্ধি করেছিলেন। তিনি বাংলার সমস্ত আবাদি ও অনাবাদি জমি জরিপ করে জমির উৎপাদন ক্ষমতা অনুসারে রাজস্ব ধার্য করে দিয়েছিলেন। 

প্রজাদের অনুরোধে মুর্শিদকুলী খান বৈশাখের প্রথম দিনে ‘পুন্যাহ’ রীতি চালু করেন। পহেলা বৈশাখে প্রজারা খাজনা দিয়ে পরবর্তী নতুন বছরের জন্য জমি পত্তন নিতেন। এ উপলক্ষে জমিদারগণ প্রজাদের জন্য মিষ্টান্ন ও নানা ধরনের খাবারের আয়োজন করতেন। মুর্শিদকুলী খানের এই খাজনা ও ভ‚মি রাজস্ব ব্যবস্থা সফল হয়েছিল। রাজস্ব আদায় এতোটাই বেড়েছিল যে, তখন থেকে তিনি প্রতিবছর বাংলা প্রদেশ থেকে মোগল সম্্রাটকে এক কোটি টাকা করে রাজস্ব পাঠাতেন।

ইংরেজ শাসনামলে বাংলায় মধ্যবিত্ত শ্রেণির সৃষ্টি হয়। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি বড় অংশ ব্রিটিশ বেনিয়াদের আনুক‚ল্য পেয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাকি-বকেয়া একটি প্রচলিত ব্যবস্থা। এই বকেয়া আদায়ের জন্য ব্যবসায়ীরা পহেলা বৈশাখকেই বেছে নেয়। ‘হালখাতা’ খোলার নামে তারা পহেলা বৈশাখে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। ‘হালখাতা’ নামক এ অনুষ্ঠানে এসে ক্রেতারা পুরনো বছরের বকেয়া পরিশোধ করেন।

ব্যবসায়ীরাও এ দিনে ক্রেতাদের জন্য মিষ্টি ও সুস্বাদু খাবারের ব্যবস্থা করে। জমিদারদের ‘পুন্যাহ’ ও ব্যবসায়ীদের ‘হালখাতা’ একই সূত্রে গাথা এবং এটা পহেলা বৈশাখের একটি নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যা বাঙালির যাপিত জীবনকে নানাভাবে আলোড়িত করে। পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনধারার সঙ্গে এতোটাই গভীরভাবে সম্পৃক্ত যে, পহেলা বৈশাখে শুধু সরকারি ছুটি নয়; নববর্ষ উদযাপন করার জন্য সরকার নববর্ষ ভাতাও চালু করেছে। এতে চাকরিজীবীদের জীবনে নববর্ষ উদযাপন পেয়েছে নতুন মাত্রা। 

নববর্ষের আনন্দ-উৎসবকে মুখরিত করে তোলার অন্যতম একটি আকর্ষণ হলো ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। এবার এর নাম পরিবর্তন করে ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের এ আয়োজন এখন শুধু বাংলাদেশ নয়; বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। এ শোভাযাত্রায় সর্বস্তরের মানুষ তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে অংশগ্রহণ করে। এ শোভাযাত্রায় বাঙালি সংস্কৃতির পরিচয়বাহী নানা উপকরণ প্রতীকীভাবে উপস্থাপন করা হয়। এ শোভাযাত্রা ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান লাভ করে। 

এ বিশ্বস্বীকৃতির মাধ্যমেই আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেবার একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলার লোক-ঐতিহ্যকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার ক্ষেত্রে পহেলা বৈশাখের এ আয়োজন দিন দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। পাকিস্তান শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তান নামে অভিহিত এই বাংলাদেশে বাঙালি সংস্কৃতি বিকশিত হতে পারেনি। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী কবি-লেখক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মীগণ সংগ্রাম করেছেন। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের নীতি-নির্ধারণী মহলের অপতৎপরতায় বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ বার বার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। 

বাঙালি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতা রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রচারের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী বাঙালিরা রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করেছেন। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকী পালন করেছেন এদেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ। ষাটের দশকে যখন পাকিস্তানে বাঙালি সংস্কৃতি ও রবীন্দ্র-বিরোধিতা তুঙ্গে তখন পূর্ব পাকিস্তানে গঠিত হয়েছে ‘ছায়ানট’ ও ‘উদীচী’র মতো বিপ্লবী সাংস্কৃতিক সংগঠন। ‘ছায়ানট’ প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূলে বর্ষবরণ উৎসবের আয়োজন করে।

রবীন্দ্রনাথের ‘এসো হে বৈশাখ... এসো...এসো’ গানের মাধ্যমে স্বাগত জানায় নতুন বছরকে। ছায়ানটের এ আয়োজন ১৯৭২ সালের পর থেকে জাতীয় উৎসবের স্বীকৃতি পায়। ১৯৮৫ সালে যশোরের ‘চারুপীঠ’ নামক প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে প্রথম বর্ষবরণের শোভাযাত্রা শুরু হলেও ১৯৮৯ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের আয়োজনে এ শোভাযাত্রা হয়ে ওঠে বর্ষবরণের প্রধান আকর্ষণ।

পহেলা বৈশাখ উদযাপনের অংশ হিসেবে সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সংগঠনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় উন্মুক্ত কনসার্ট, বাউল গানের আসর, জারি-সারি, মুর্শিদী গানের আসর। বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতিতে পান্তা-ভাত কোনো দুর্লভ ও ব্যয়বহুল খাবার নয়। এক সময় ইলিশও দুঃপ্রাপ্য ছিল না। কিন্তু কালের বিবর্তনে এখন ইলিশ মাছ সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নেই। তবু পহেলা বৈশাখে অনেকেই পান্তা-ইলিশের স্বাদ নেয়। সঙ্গে কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ আর নারকেল যুক্ত করে ষোলোআনা বাঙালিয়ানার পরিচয় দেয়। ধুতি-পাঞ্জাবি পরে পোশাকে ফুটিয়ে তোলে বাঙালিয়ানার ছাপ। 

আনন্দ শোভাযাত্রায় অনেকে কামার, কুমার, ময়রা, জেলে, তাঁতি, মাঝি, কিষান-কিষানি- বাংলার ঐতিহ্যবাহী এসব পেশার সাজে নিজেকে উপস্থাপন করে। পশুপাখির মুখাকৃতি, রং-বেরঙের মুখোশ আর সারা গায়ে উলকি, আলপনা এঁকে ও রঙ মেখে সবাই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে। বর্ষবরণের আর একটি প্রধান অনুষঙ্গ হলো বৈশাখী মেলা। এক সময় এই মেলা শুধু গ্রামে-গঞ্জেই হতো। এখন বৈশাখী মেলার পরিধি বেড়ে গেছে। শহরেও এখন মহা ধুমধামে বৈশাখী মেলা হতে দেখা যায়। এসব মেলায় মাটির তৈরি, বাঁশ ও বেতের তৈরি নানা ধরনের ঐতিহ্যবাহী জিনিস-পত্র পাওয়া যায়। 

বাচ্চাদের খেলার সামগ্রী, বাঁশি ও নানা রকম মিষ্টি জাতীয় খাবার বৈশাখী মেলাকে করে তোলা উৎসবমুখর। এভাবে বাঙালির জাতীয় জীবনে বাংলা বর্ষবরণ উৎসব অসাম্প্রদায়িক চেতনার বার্তা নিয়ে আসে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এ লোক-উৎসবের চেতনা ছড়িয়ে পড়ুক সবার মাঝে। নববর্ষ হোক সকল প্রকার হিংসা, ঘৃণা, অমানবিকতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রদীপ্ত প্রতিবাদ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের মতো আমাদেরও একান্ত কামনা: ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও কলামিস্ট