
এ সময়ে সবচেয়ে বহুল আলোচিত ও ব্যবহৃত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক। ফেসবুক ছাড়া আমরা একটি দিনও ভাবতে পারি না। আজ থেকে ১৭ বছর আগে অর্থাৎ ২০০৪ সালে ৪ ফেব্রুয়ারি ফেসবুকের জন্ম হয়। বর্তমানে ফেসবুক সারাবিশ্বে ছোট-বড় অভেদে সবার জীবনের একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে অনলাইন মাধ্যমে আমরা কাছের-দূরের বন্ধু-বান্ধবদের জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে পারি, নিজেদের স্ট্যাটাস অন্যদের জানানোর চেষ্টা করি।
যেদিন ফেসবুক আবিষ্কার হয়েছে সেদিন থেকেই এ নিয়ে মানুষের ভেতরে জন্ম হয়েছে নানা ধরনের কৌতূহল। আসুন সব কৌতূহল দূর করে এখনই জেনে নিই ফেসবুক তৈরির কাহিনি।
মার্কিন দেশের নাগরিক কম্পিউটার প্রোগ্রামার ও সফটওয়্যার ডেভেলপার মার্ক ইলিয়ট জাকারবার্গ যার জন্ম ১৪ মে, ১৯৮৪ সালের নিউইয়র্কের হোয়াইট প্লেইনসে। যিনি হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া চলাকালীন তার সহপাঠী এডুয়ার্ডো স্যাভেরিন, এন্ড্রু ম্যাককলাম, ডাস্টিন মস্কোভিটজ এবং ক্রিস হিউজের সহায়তা নিয়ে ফেসবুক তৈরি করেন। বর্তমানে ৩৭ বছর বয়সী এই তরুণ ফেসবুকের চেয়ারম্যান, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও নিয়ন্ত্রক অংশীদার। তাছাড়া সৌর পাল মহাকাশযান উন্নয়ন প্রকল্প ব্রেকথ্রু স্টারশটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ওই বোর্ডের বিশেষ মেম্বার হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন।
ফেসবুক তৈরির আগে অর্থাৎ ২০০৩ সালের ২৮ অক্টোবর মার্ক ইলিয়ট জাকারবার্গ ‘ফেসম্যাশ ডটকম’ নামে একটি ওয়েবসাইট বানিয়েছিলেন। সেসময় তিনি এই ওয়েবসাইটের জন্য নিজের ইউনিভার্সিটির ডেটাবেজ হ্যাক করেছিলেন। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির হ্যাক করা ডেটাবেজ থেকে ছাত্রদের ছবি নিয়ে তা ‘ফেসম্যাশ ডটকমে’ ব্যবহার করে ভিজিটরদের ‘হট’ অথবা ‘নট’ ভোটিংয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। পরে জাকারবার্গ ইউনিভার্সিটি-শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে ‘ফেসম্যাশ ডটকম’ সাইটটি বন্ধ করতে বাধ্য হন। এ সাইটটি বন্ধ হয়ে গেলেও বাস্তবিকপক্ষে ওই ‘ফেসম্যাশ ডটকম’ ওয়েবসাইট থেকেই ফেসবুক বানানোর ভাবনা মাথায় আসে মার্ক ইলিয়ট জাকারবার্গের। আর সে ভাবনা থেকেই জাকারবার্গ ২০০৪ সালের ১১ জানুয়ারি ‘দ্য ফেসবুক ডটকম’ নামে একটি ডোমেইন ক্রয় করেন।
মার্ক জাকারবার্গ ‘দ্য ফেসবুক (The Facebook)’ নামে নতুন সাইটটি চালু করার পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ১২০০ জন ছাত্রছাত্রী এই সাইটে নিবন্ধন করে। শুরুতে ‘দ্য ফেসবুক’ সাইটটি শুধু হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকলেও মাত্র দুই মাসের মাথায় বোস্টন শহরের অপরাপর কলেজ, আইভি লীগ এবং স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। শুরু হওয়ার এক মাসের মাথায় প্রায় দেড় লাখ মানুষ ফেসবুক ব্যবহার শুরু করে এবং ইউজার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ মিলিয়নে। তবে ওই সময় যাদের বয়স ১৩ বছরের উপরে শুধু তারাই ‘দ্য ফেসবুক’ ব্যবহার করতে পারত। অবশ্য এখনকার মতো ফেসবুকে ছবি আপলোড দেয়া, ওয়াল, নিউজ ফিড, ইভেন্ট, পেজ এতকিছু ছিল না।
পরে ২০০৫ সালের আগস্ট মাসে মার্ক জাকারবার্গ ‘দ্য ফেসবুক’ নামটি ছোট করে ‘ফেসবুক (Facebook)’ রাখেন এবং এ নামে একটি ডোমেইন ক্রয় করেন। এ জন্য জাকারবার্গ খরচ করেছিলেন দুই লাখ মার্কিন ডলার। ২০১২ সালে এসে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০০ কোটিতে পৌঁছায়। এরপরে তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এভাবেই আমরা পেয়ে যাই অত্যন্ত লোকপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক। বর্তমানে ফেসবুক কর্পোরেটের নাম পাল্টে রাখা হয়েছে ‘মেটা’।
শুরুর দিকে কারো পোস্টে লাইক দেয়া মানে বোঝাতো ‘আমি এটা দেখেছি’, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ‘কে কত বেশি লাইক পাবে’-তার একটা প্রতিযোগিতা তৈরি হয়ে গেছে। তাও শুধুমাত্র বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সদস্যদের মধ্যেই নয়, বরং অপরিচিত যারা শুধুমাত্র আপনাকে লাইকই দেয় না, ফলোও করে। এই প্রতিযোগিতার পেছনে রয়েছে অর্থনৈতিক কারণ এবং একইসঙ্গে এটি একটি ‘ফলস স্ট্যাটাস’ তৈরি করে যে, যার যত বেশি ফলোয়ার ও লাইক রয়েছে সেই ব্যক্তি তত উচ্চ পর্যায়ের।
এই লাইক বাটনের স্রষ্টা হলেন প্রোডাক্টিভিটি অ্যাপ্লিকেশন ‘আসানার সহ-প্রতিষ্ঠাতা জাস্টিন রোজেনস্টাইন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, রোজেনস্টাইন নিজেই এখন আর ‘লাইক’ বাটন পছন্দ করেন না। এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমি ভেবেছিলাম মানুষ যা পছন্দ করে সেই অনুভূতি খুব সহজে প্রকাশ করার মাধ্যম হবে ‘লাইক’ বাটন। আমি সেই ইতিবাচকতা ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যেই এটাকে সহজ-সাদামাটা রাখতে চেয়েছিলাম, সেই চিন্তা থেকেই ‘লাইক’ বাটনের এরকম আকৃতি দেয়া হয়েছে। এই প্লাটফর্ম তৈরির উদ্দেশ্যই ছিল এমন একটা অবকাঠামো ডিজাইন ও প্রচার করা যেখানে মানুষ একে-অপরকে সহযোগিতার জন্য একটা জগত তৈরি করবে।
ফেসবুক সর্বপ্রথম ‘লাইক’ বাটনের সঙ্গে নেটিজেনদের পরিচয় করিয়ে দেয় ২০০৯ সালে। তখন থাম্বস-আপ এর মাধ্যমে লাইক দেয়া হতো। এই প্রতিষ্ঠানটি অন্যান্য ওয়েবসাইটকেও একই ধরনের লাইক বাটন ব্যবহারের অনুমতি দেয় যাতে করে ব্যবহারকারীরা ফেসবুক প্রোফাইলে নিজেদের আগ্রহের জায়গাগুলো শেয়ার করতে পারে এবং এর মাধ্যমে ফেসবুক নিজেদের সাইটের বাইরের মানুষদের অনুভূতি ও কার্যকলাপ সম্পর্কে তথ্য নিতে পারে। উদ্দেশ্য ছিল বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আরও প্রত্যক্ষভাবে তাদেরকে টার্গেট করা।
২০১৫ সালে মাইক্রো ব্লগিং সাইট টুইটারে গিয়ে এই লাইক বাটন হয়ে গেল ‘লাভ’ আকৃতির। আবার ইনস্টাগ্রাম এবং টিকটকেও লাইক বাটন ‘লাভ’ আকৃতির। বর্তমানে একই ধরনের ‘লাভ’ আকৃতির লাইক বাটন হিঞ্জ’র মতো ডেটিং অ্যাপগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে। ২০১১ সালে ইনস্টাগ্রামে স্ক্রিনে দুইবার ট্যাপ করেই ‘লাইক’ দেয়ার সুযোগ ছিল ব্যবহারকারীদের— যা সোশ্যাল মিডিয়ায় সংযোগ স্থাপন এবং দৈনন্দিন মিথস্ক্রিয়া বৃদ্ধি করেছে।
আপনি কিছু একটা দেখলেন, লাইক দিলেন এবং স্ক্রল করতে থাকলেন। যখন কেউ নিজের প্রোফাইল দিয়ে একটা বড় ফলোয়ার বেজ তৈরি করে ফেলেছে বলে ভাবে তখন মনে হয়, হাজার হাজার এমনকি লাখ লাখ মানুষ তাকে ফলো করে। কারণ তাদের ওই ইউজারকে ভালো লাগে, তারা তার প্রশংসা করে। কিন্তু সবসময় সেটা সত্যি নয়। ব্যবহারকারীরা হয়তো লাইকের মাধ্যমে বোঝাচ্ছে যে আপনি যেই ছবি বা ভিডিও শেয়ার করেছেন সেটা তাদের ভালো লেগেছে। একই কারণে আরও হাজারখানেক মানুষকে তারা যেমন ফলো করে, তেমনি আপনাকেও করে।
আমরা এতই অদ্ভুত যে কারো প্রোফাইলে ফলোয়ার কম থাকলে বা পোস্টে লাইক কম থাকলে আমরা সেই প্রোফাইলকে গুরুত্ব দেই না। অন্যদিকে প্রচুর ফলোয়ার এবং লাইক দেখলে আমরা সেই প্রোফাইল ঘুরে দেখতে আগ্রহী হয়ে উঠি এবং নিজেরাও ফলো দেই। যেহেতু অনেকেই এই প্রোফাইল ফলো করে— বিষয়টা হয়তো মজার বটে! আর এভাবেই বেশিরভাগ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর প্রোফাইল সমৃদ্ধ হয়, বলেন ডিজিটাল মার্কেটিং ও সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষজ্ঞ ফাতিমা মার্তিনেজ লোপেজ।
‘লাইক’-এর ব্যবহার খুবই সংবেদনশীল একটি বিষয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা কম আসেন তারা এই নেশার ফাঁদে পা নাও দিতে পারেন, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সক্রিয় ব্যবহারকারীদের জন্য। কারণ আমরা সাধারণত নিজের সমকক্ষ অন্যদের সঙ্গে তুলনা করি এবং এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বী মনোভাব দেখা যায়।
অন্যদিকে, সোশ্যাল মিডিয়া আপনাকে পারসোনাল ব্র্যান্ডিংয়ে এবং নিজের পেশায় এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। কারণ ‘লাইক’ যত বেশি হবে, আপনার কন্টেন্ট তত বেশি দৃশ্যমান হবে এবং পেশাগত ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকার ও স্বীকৃতি পাওয়ার সুযোগ বেড়ে যাবে।
মানবকণ্ঠ/এফআই
Comments