
আমরা এ বিশ্বকে বাসযোগ্য করে তুলছি না, বরং পৃথিবীকে বসবাসে অকার্যকর করতে নানারকম ফন্দি-ফিকিরের আয়োজন করছি প্রতিনিয়ত। আইপিসিসির রিপোর্ট অনুযায়ী- ১৯৫০ সালের পর থেকে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে পৃথিবীর জলবায়ু যেভাবে বদলে গেছে তার জন্য মূলত মানুষই দায়ী। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে জলবায়ু বিজ্ঞানীরা সতর্কবার্তা দিয়ে বলেছেন, ‘এখনই কিছু করুন, না হলে সংকটের ঝুঁকিতে থাকুন’। তাপমাত্রার বিপজ্জনক বৃদ্ধি রোধে পৃথিবীকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
জাতিসংঘের বৈশ্বিক উষ্ণতাবিষয়ক আন্তঃসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) গবেষণায় আরও দেখা যায়- আমাদের গ্রহটি আগামী ১০ বছরের মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধির চূড়ান্ত সীমা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করতে পারে। যা হবে প্রাক-শিল্পযুগের মাত্রার থেকেও বেশি। এতে জলবায়ু পরিস্থিতি অস্বাভাবিক রূপ নেবে। বিশেষ করে চরম দুর্ভিক্ষ, দাবানল, বন্যা ও সেই সাথে লাখ লাখ মানুষের খাদ্য সংকটের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেবে।
আইপিসিসির এই সতর্কবার্তার পরও আমরা কতটুকু সচেতন হতে পেরেছি? উত্তর হলো- না, পারি নাই। উল্টো সচেতন হওয়ার পরিবর্তে আমরা অসচেতনমূলক কাজ প্রতিনিয়ত করেই যাচ্ছি। সাম্প্রতিক চলমান দাবদাহ থেকে মুক্তি এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে দেশের একটি স্বনামধন্য ছাত্র সংগঠন ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’- ১০ দিনে পাঁচ লাখের অধিক বৃক্ষরোপণ করেছে। এজন্য ছাত্রলীগকে আন্তরিক সাধুবাদ জানাই। কিন্তু গবেষণায় দেখা যায়, গাছ লাগানো পরিবেশের জন্য যতটা সহায়ক, ব্যক্তিসচেতনতা এর চেয়ে শতগুণ সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। আমরা সচেতন নাগরিকেরা সবচেয়ে বেশি নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য পরিবেশের মর্মান্তিক ক্ষতি করছি।
সম্প্রতি দিনাজপুর টু ঢাকা রেলভ্রমণে আমরা এমন চিত্র দেখতে পেয়েছি। শহরগুলোর পাশে অবস্থিত বড় বড় পুকুর ও জলাশয়গুলো ভরাট করা হচ্ছে। গড়ে তোলা হচ্ছে বিশাল বিশাল ইমারত। নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর এসব সংশ্লিষ্ট কাজে কি কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না? রেললাইনের দু’ধারে খাস জমিতে অবস্থিত ছোট ছোট জলাশয়গুলো ভরাট করে দোকানপাট গড়ে তোলা হচ্ছে। এসব অসচেতনতামূলক কাজগুলো কি প্রশাসনের নজরে পড়ছে না? পড়ছে হয়তো; কিন্তু এসব কাজে জড়িত স্বয়ং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ভাষ্য অনুযায়ী- একটি বিশাল বাসা বা শপিংমল কমপ্লেক্স স্থাপনের সঙ্গে সংযুক্ত একটি পুকুর বা জলাশয় রাখতে হবে, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য। যাতে করে এই স্থাপনায় অগ্নি দুর্ঘটনা সংঘটিত হলে তাৎক্ষণিকভাবে এই জলাশয়কে ব্যবহার করা যায়। পক্ষান্তরে, নিকটস্থ জলাশয় থেকে বাতাসে প্রচুর জলীয়বাষ্প আসে, ফলে তাপদাহে মানুষ কিছুটা স্বস্তি বোধ করে।
আমাদের দেশ নদীমাতৃক দেশ। অভিন্ন নদীগুলোর পানির ন্যায্য হিস্যার সু®ু¤ বন্টননীতি তদারকির অভাবে শুকনো মৌসুমে আমাদের দেশের নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ে। ফলে প্রতিবছর বিভিন্ন জেলায় হাজার হাজার একর ফসলি জমি মরুভূমিতে পরিণত হয় এবং নদীগুলো পানি শূন্য হওয়ায় বাতাসে জলীয়বাষ্পের স্বল্পতাও দেখা দেয়। তাই নদীগুলো এখন আমাদের জন্য আশীর্বাদ না হয়ে অনেকটা অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আজ থেকে ৭/৮ বছর আগে গ্রামের লোকজন তীব্র তাপদাহে রাস্তার পাশে বড় বড় বৃক্ষের নিচে টং/চৌকি তৈরি করতো। সারারাত সেখানে লোকজন আড্ডার পাশাপাশি গল্প গুজবে মেতে উঠত। এভাবেই তারা গ্রীষ্মের দিনগুলো অতিবাহিত করতো। কিন্তু এখন গ্রামগুলোতে অসহনীয় পর্যায়ের তাপদাহ শুরু হয়েছে শুধুমাত্র এসব বড় বৃক্ষ নিধনের জন্য।
গ্রামে পল্লীবিদ্যুতের প্রসার ঘটানোর ফলে রাস্তার দু’ধারে বৃক্ষগুলো নির্মমভাবে কেটে ফেলা হয়েছে। এমনকি পরিবেশবন্ধু তাল গাছগুলোকেও উপড়ে ফেলতে হয়েছে-এই বিদ্যুৎ শিল্পের বিকাশ ঘটানোর জন্য। অথচ সরকারের উচিত ছিল গ্রামীণ জনপদের এই প্রাচীন বৃক্ষগুলোকে বাঁচানোর জন্য কভারযুক্ত তারের সংযোগ দেয়ার চেষ্টা করা। সেটাতো করা হয়নি। যার ফলে, অস্বাভাবিকভাবে বৃক্ষ নিধন করায় চলমান তাপদাহে এখন শহরের মতো ছোট ছোট গ্রামগুলোও ক্রমান্বয়ে বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে।
দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, আমরা অনুধাবন করছি; দেশের সার্বিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হচ্ছে, আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু দেশের চিরাচরিত সম্পদগুলোকে এভাবে ধ্বংস করে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা- আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে বলে আমরা আশঙ্কা করছি। সুতরাং এসব কিছুই যখন আমরা নির্দ্বিধায় করছি, তখন বলাই বাহুল্য যে, আমরা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছি।
লেখক: শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর।
মানবকণ্ঠ/এফআই
Comments