
ঐতিহ্য নিয়ে সবচেয়ে সুন্দর ও সহজবোধ্য কথা বলেছেন ইংরেজ কবি টি এস ইলিয়ট। বৃক্ষের সাথে তিনি তুলনা করেছেন ঐতিহ্যকে। বৃক্ষের সমস্ত শক্তি যেমন শেকড়ে সঞ্চিত থাকে, একটি সমাজেরও সকল নান্দনিক সৌন্দর্যের উৎস লুকিয়ে থাকে ঐতিহ্যের মধ্যে।
বৃক্ষ যেমন শেকড়চ্যুত হয়ে বেঁচে থাকতে পারে না, সমাজও ঐতিহ্য বিস্মৃত হয়ে পথ হারা হয়ে পড়ে। শুধু পথকেই হারায় না, ঐতিহ্য হারিয়ে সভ্যতার পথ থেকেও দূরে সরে আসে। আমরা মাটির উপর থেকে বৃক্ষকে নানা রূপে দেখতে পাই। পত্র-পল্লবে সুশোভিত। মাটির নিচে শেকড়ের সাহায্যে প্রাণরস সংগ্রহ করে বৃক্ষ সুশোভিত হওয়ার সুযোগ পায়। বৃক্ষের পত্র, পল্লব, ডালপালা দৃশ্যমান থাকে, তাই আমাদের প্রখর দৃষ্টি থাকে বৃক্ষের বহিরাঙ্গের দিকে। শেকড়চ্যুত হলে প্রাণরস সঞ্চয় করতে না পেরে ধীরে ধীরে প্রাণহীন হয়ে পড়ে বৃক্ষ। একটি সমাজ ততক্ষণই নিজেদেরকে সভ্য বলে দাবি করতে পারে যতক্ষণ গৌরবময় ঐতিহ্যকে বুকে ধারণ করে গতিশীল থাকে। ঐতিহ্য একটি জাতির প্রবহমান জীবনধারার গৌরবময় অনুভূতি, যা দিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম নিজেদেরকে সভ্যতার পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত বোধ করে। ঐতিহ্যকে ধারণ করে এগিয়ে যাওয়া অনেকটা রিলে রেসের মতো। রিলে রেসে যেমন হাতের বাটন একজনের কাছ থেকে আর একজনের হাতে হস্তান্তর করতে হয়, ঐতিহ্যকেও একইভাবে পূর্ব প্রজন্মকে উত্তর প্রজন্মের কাছে সযত্নে হস্তান্তর করতে হয়। কাজটি পূর্ব প্রজন্মকেই করতে হয়। নতুন প্রজন্ম যাতে নিজের পূর্বপুরুষের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারে। এতে করে আত্মপরিচয়ের সংকট দূরীভূত হয়ে আদর্শ জাতিসত্তার বিনির্মাণ সম্ভব হয়। এ কাজটি করতে ব্যর্থ হলে নব প্রজš§ তাদের গর্ব এবং অহংকারের অতীত ঐতিহ্য বিস্মৃত হবে। ঐতিহ্য নিয়ে এসব কথা বলার একটি উদ্দেশ্য আছে। মনটি বিষণ্ন হয়ে আছে একটি সংবাদ জেনে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সিলেটের মুরারিচাঁদ মহাবিদ্যালয়ের অনন্য স্থাপত্য শৈলী সম্পন্ন কিছু ভবনকে অযত্নে অবহেলায় এমনভাবে রাখা হয়েছে যাতে করে স্থাপনার প্রাণশক্তি ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এভাবেই আমাদের অতীত ঐতিহ্যকে নানারকম উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা ধ্বংস করতে উদ্যত হই। বাংলাদেশের প্রাচীন মহাবিদ্যালয়গুলোর অন্যতম সিলেট মুরারিচাঁদ কলেজ। হালের নাম মুরারিচাঁদ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সংক্ষেপে এমসি কলেজ। ১৮৯২ সালে রাজা গিরিশচন্দ্র রায়ের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও ঐকান্তিক আর্থিক আনুকূল্যে মুরারিচাঁদ কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ঐতিহ্যবাহী কলেজটি শতবর্ষ অতিক্রম করে এখন সার্ধ-শতবর্ষের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। যে কোনো ভৌতিক স্থাপনা নির্মাণের সময় খুব স্বাভাবিকভাবে এর নকশা প্রণয়ন করা হয় নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলের জলবায়ু, মাটির প্রকৃতির কথা বিবেচনা করে। নির্মাণ সামগ্রীও ব্যবহার করা হয় ওই ভৌগোলিক অঞ্চলের সামগ্রিক আবহাওয়া এবং জলবায়ুর কথা মাথায় রেখে। তৎকালীন শ্রীহট্ট, রবীন্দ্রনাথের শ্রীভূমি, বর্তমান সিলেটের জলবায়ু, মাটি এবং অন্যান্য ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য ভারতের আসাম রাজ্যের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। মূলত সিলেট এবং ভারতের আসাম প্রদেশ একই ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অঞ্চলে অবস্থিত। ১৭৭২ সালের ১৭ মার্চ সিলেট জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৭৪ সাল পর্যন্ত সিলেট জেলা ছিল ঢাকা বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। ওই বছরের ১২ সেপ্টেম্বর নবসৃষ্ট আসাম প্রদেশের সাথে সিলেটকে সংযুক্ত করা হয়। ১৯৪৭ এর পূর্ব (১৯০৫-১৯১১) পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গ সময়ের কাল টুকু বাদ দিয়ে সিলেট আসামের অংশ ছিল। মুরারিচাঁদ কলেজের ভবনগুলো নির্মাণের সময় খুব স্বাভাবিকভাবে “অনন্য” আসাম স্থাপত্য শৈলী অনুসরণ করে নির্মাণ করা হয়।
১৮৭২ সালে স্থাপিত ঐতিহ্যবাহী এই কলেজের স্থাপত্য শৈলী এই অঞ্চল তথা বাংলাদেশের শতাধিক বছরের গৌরবের স্মৃতি বহন করে চলছে। ছোট ছোট টিলার উপর মনোরম পরিবেশে স্থাপিত এই কলেজটির প্রাকৃতিক অবস্থান বাংলাদেশের অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী কলেজগুলো থেকে ভিন্ন। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য কলেজটিকে এক অনিন্দ্য সুন্দর রূপ প্রদান করেছে। এমসি কলেজের ভূমির পরিমাণ জানলে বিস্মিত হতে হয়। বাংলাদেশের নব প্রতিষ্ঠিত অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও এতোটুকু ভূমি নেই। কলেজটির মোট ভূমির পরিমাণ ১৪৪ একর। এই ১৪৪ একর ভূমির উপর স্থাপিত বিভিন্ন ভবনের মধ্যে দুটি ভবনকে ব্যবহার না করে অযত্নে অবহেলায় ফেলে রাখা হয়েছে। সংরক্ষণ কিংবা মেরামতের উদ্যোগ না নিয়ে অকার্যকর হিসেবে ভবন দুটি পড়ে রয়েছে। এই দুটি ভবন বাংলা ও সমাজবিজ্ঞানের ভবন হিসেবে পরিচিত। ভবন দুটি সিলেট অঞ্চলের অসাধারণ স্থাপত্য শৈলী যাকে আসাম ঘরানার ঐতিহ্যের অনন্য নিদর্শন বহন করে চলেছে। সভ্যতার, ঐতিহ্যের স্মারক এই ভবন দুটিকে যদি নির্মাণ শৈলী ঠিক রেখে সংরক্ষণ করা না হয় তাহলে অচিরেই আমাদের ঐতিহ্য ও গৌরবের স্মারক ভবন দুটি মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়বে। মুরারিচাঁদ কলেজের শুধুমাত্র এই দুটি ভবন নয়, এই কলেজের আরও অনেক নান্দনিক ভবন রয়েছে যেগুলো যথা শীঘ্রই সংরক্ষণ, মেরামতের প্রয়োজন রয়েছে। ভবনগুলো হলো ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত কলা ভবন ও লাইব্রেরি ভবন; উঁচু টিলার উপর স্থাপিত কলেজের দাপ্তরিক কার্যালয়, অধ্যক্ষের বাসভবন ও কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের গ্যালারি। এই স্থাপনাগুলোও শতবর্ষের ইতিহাস ধারণ করে এখনও দাঁড়িয়ে আছে। এই অনন্য নির্মাণ শৈলীর ভবনসমূহ মুরারিচাঁদ কলেজের নাদনিক সৌন্দর্যের অবিচ্ছেদ অংশ। এসব প্রাচীন স্থাপনাসমূহ যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা না হলে সিলেটের ইতোমধ্যে নিশ্চিহ্ন হওয়া অনেক ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার মতো এসব অমূল্য স্থাপনাগুলোকেও আমরা চিরতরে হারিয়ে ফেলবো।
ঐতিহ্য সংরক্ষণ নিয়ে বরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের খুব চমৎকার কিছু কথা আছে। অধ্যাপক সায়ীদ যাকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা করেন তিনি বলেছিলেন, ‘প্রতিটি প্রজন্মের কাছে সময়ের একটি দাবি থাকে। আর সে দাবিটি হলো ইতিহাসের অন্তরাল থেকে গৌরবের ও ঐতিহ্যের স্মৃতিগুলো তুলে এনে নতুনদের কাছে পৌঁছে দেয়া। কাজটি ঠিকভাবে করা গেলে বাঙালি সংস্কৃতি ভালোবাসতে আমাদের সন্তানদের ওপর আর বল প্রয়োগ করতে হবে না।’ সময়ের দাবি হিসেবে বহমানকালে আমাদের সকলের কর্তব্য হলো মুরারিচাঁদ কলেজসহ বাংলাদেশের অন্যান্য শিক্ষাঙ্গন এবং যে কোনো অঙ্গনে অতীত ঐতিহ্যের যত স্মারক আছে সব স্মারকগুলোকে যথাযথ সংরক্ষণ করা। ঐতিহ্য সংরক্ষণের বিষয়ে সচেতন নাগরিকবৃন্দ সবচেয়ে বেশি আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দিকে কারণ এই মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সংরক্ষণের কাজের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। যেহেতু ঐতিহ্যবাহী মুরারিচাঁদ কলেজটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন তাই তাদেরও জোর তৎপরতার প্রয়োজন রয়েছে। ইতিহাস, ঐতিহ্য মূল্যহীন বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে সভ্যতা বিমুখ জাতির কাছে। অসচেতন নাগরিক সমাজও ঐতিহ্য সংরক্ষণে নিস্পৃহভাব প্রদর্শন করে থাকেন। আনন্দের বিষয় সিলেটের নাগরিক সমাজ এ বিষয়ে যথেষ্ট তৎপর রয়েছেন। নাগরিক সমাজের অগ্রসর অংশ ইতোমধ্যে সংগঠিত হয়ে মুরারিচাঁদ কলেজের ঐতিহ্যবাহী ভবনগুলোকে সংরক্ষণের জন্য সচেতনতামূলক সভা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এছাড়াও দেশ-বিদেশে অবস্থানরত এমসি কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা ঐতিহ্যবাহী ভবনগুলো সংরক্ষণের জন্য কলেজ অধ্যক্ষের সাথে মতবিনিময় করেছেন। নাগরিক সমাজ বা সিভিল সোসাইটির পক্ষ থেকে এমসি কলেজের ঐতিহ্য সংরক্ষণের সকল কর্মকাণ্ডের সমন্বয় সাধনের কাজ করে যাচ্ছেন “পরিবেশ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ ট্রাস্ট,” সিলেট। মুরারিচাঁদ কলেজের ঐতিহ্যবাহী ভবনগুলো সংরক্ষণের জন্য ইতোমধ্যে নাগরিক সমাজের মধ্যে দল-মত নির্বিশেষে এক অসাধারণ ঐকমত্যের সৃষ্টি হয়েছে।
নাগরিক সমাজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অযত্নে পড়ে থাকা ‘আসাম ঘরানার অনন্য ঐতিহ্য’-এর নিদর্শন বহনকারী বাংলা ও সমাজবিজ্ঞানের ভবন দুটি দ্রুত সংরক্ষণের দাবি উত্থাপন করছেন। কারণ এই দুটি ভবনকে জরুরি ভিত্তিতে সংরক্ষণ করা না গেলে আমরা আমাদের গৌরব করার মতো স্থাপনাগুলো চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলবো। মনে রাখতে হবে ভবনগুলোকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অযত্নে অবহেলায় ফেলে রেখে, ধ্বংসের দিকে এগিয়ে দেয়া নাগরিক সমাজ এবং সরকারের উচিত হবে না। এমসি কলেজে নতুন ভবন নির্মাণের প্রয়োজন হলে কলেজটির বিপুল পরিমাণ অব্যবহƒত জায়গায় তা নির্মাণ করা যেতে পারে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং কলেজ কর্তৃপক্ষের উচিত এমসি কলেজের সকল ঝুঁকিপূর্ণ ঐতিহ্য বহনকারী ভবনগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে সংরক্ষণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা। ভবন সংরক্ষণের সময় নির্মাণ শৈলীকে অক্ষত রাখার কথা বিবেচনায় রাখতে হবে। আমরা সকলে মিলে এ কাজটি করতে পারলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম সভ্যতাকে আলোর পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। এ কাজটি করতে ব্যর্থ হলে ইতিহাস, প্রজন্ম এবং জাতির কাছে দায়িত্বশীল সরকার যেমন দায়ী থাকবেন একইভাবে সচেতন নাগরিক সমাজও এর দায় এড়িয়ে যেতে পারবেন না।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক
মানবকণ্ঠ/এসআরএস
Comments