Image description

নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের লীলাভূমি জাফলংয়ে অবৈধভাবে বালু-পাথর উত্তোলনের কারণে আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার পূর্ব জাফলং ইউনিয়নের জুমপাড় কালিবাড়ি মন্দির, জুমপাড় বাঁধ, বালির হাওর এবং পরিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ)ভুক্ত বাংলা বাজার এলাকায় লাগামহীনভাবে চলছে বালু ও পাথর উত্তোলনের মহোৎসব। অনুসন্ধানে জানা গেছে, অর্ধশতাধিক বোমা মেশিন ও পেলোডার ব্যবহার করে জুমপাড় এলাকা ক্ষতবিক্ষত করে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। এর ফলে ঐতিহ্যবাহী শ্রী শ্রী জুমপাড় কালিবাড়ি মন্দিরসহ শতাধিক একর ফসলি জমি, পান-সুপারি বাগান, চা বাগান, বসতবাড়ি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

প্রকৃতি কন্যা জাফলংকে বাঁচাতে পরিবেশ অধিদপ্তর একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করেছে এবং দুই শতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। তবে রহস্যজনক কারণে অবৈধ পাথর উত্তোলন কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না। স্থানীয়দের অভিযোগ, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা প্রভাবশালী একটি পাথরখেকো চক্র প্রশাসনের নীরবতাকে পুঁজি করে এই ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে লোক দেখানো অভিযান পরিচালিত হলেও, পাথরখেকো চক্র আগে থেকেই খবর পেয়ে যাওয়ায় সেসব অভিযান কার্যত কোনো ফল বয়ে আনে না। ফলে অভিযানের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, জাফলং ইসিএ ভুক্ত এলাকা হওয়া সত্ত্বেও পরিবেশের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে দানব আকৃতির পেলোডার মেশিন দিয়ে পাহাড় ও মাটি কেটে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। এর প্রত্যক্ষ প্রভাবে জুমপাড় কালিবাড়ি মন্দির, জুমপাড় বাঁধ, চাবাগান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং আশেপাশের গ্রামীণ অবকাঠামো এখন ধসের মুখে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের আগস্ট মাসে ছাত্র জনতার আন্দোলনের সুযোগে জাফলং ও বিছনাকান্দি পর্যটন স্পটের জিরো পয়েন্টসহ বিভিন্ন স্থানে পাথর লুটপাটের ঘটনা ঘটে। শুধু জাফলং পর্যটন স্পট এবং ইসিএ ভুক্ত এলাকার কোয়ারি থেকে শত কোটি টাকার পাথর লুট করা হয়েছে। এই পাথর লুটপাটের অভিযোগে স্থানীয় বিএনপির অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সিলেট পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. বদরুল হুদা বাদী হয়ে একাধিক মামলা দায়ের করেন। তবে ঘটনার কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও মামলার আসামিরা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। সচেতন মহলের অভিযোগ, স্থানীয় প্রশাসনের রহস্যজনক নীরবতার কারণেই পাথরখেকোরা নির্বিঘ্নে তাদের ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, জাফলং জুমপাড় কালিবাড়ি মন্দির এবং পাহাড়ি ঢলের পানি থেকে কয়েকটি গ্রাম রক্ষায় নির্মিত জুমপাড় বাঁধের দুই পাশে প্রায় অর্ধশতাধিক দানব যন্ত্র - বোমা মেশিন, শ্যালো মেশিন, পেলোডার ও এক্সকেভেটর ব্যবহার করে দিনরাত গর্ত করে অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয়দের অনেকেই জানিয়েছেন, স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা হেনরি লামিন ও আহাদের নেতৃত্বেই মন্দির ও জুমপাড় এলাকায় পাথর উত্তোলনের এই ধ্বংসলীলা চলছে।

জুমপাড় মন্দিরের পাশে পাথরের গর্তে কর্মরত শ্রমিক খোকন মিয়া জানান, তিনি এখানে শ্রমিক হিসেবে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করেন। তার কাজ শ্রমিকদের পাথর পরিবহনের ঝুড়ির হিসাব রাখা। এই গর্তের মালিক হেনরী লামিন ও আহাদ মিয়া। কালিজুড়ি থেকে আসা কয়েকজন পাথর শ্রমিক জানান, প্রায় এক মাস ধরে তারা হেনরী লামিনের গর্তে দৈনিক এক হাজার টাকা মজুরিতে কাজ করছেন। মন্দিরের গর্তসহ আরও চারটি গর্তের মালিক হেনরী লামিন। শ্রমিক খোকনের ভাই বকুল ম্যানেজারের দায়িত্বে পাথর উত্তোলনের কাজ তদারকি করেন।

পরিবেশবাদীরা বলছেন, এখনই কঠোর পদক্ষেপ না নিলে জাফলংয়ের প্রাকৃতিক ভারসাম্য সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়ে যাবে। তাদের অভিযোগ, একটি শক্তিশালী চক্র গত আগস্ট মাসের পর থেকেই ইসিএভুক্ত এলাকা জাফলং, বাংলা বাজার, বালির হাওর, পিয়াইন ও ডাউকি নদীর উৎস মুখ হয়ে জাফলং সেতু পর্যন্ত অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলন করে যাচ্ছে।

স্থানীয়রা আরও জানান, প্রশাসনের এই দায়সারা অভিযান স্থানীয়দের মধ্যে সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। প্রতিদিন শতশত ট্রাক বালু ও পাথর নিয়ে যাচ্ছে, অথচ নদী ও বাঁধের অস্তিত্ব ক্রমশ বিলীন হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্থানীয় বাসিন্দা ক্ষোভের সাথে বলেন, "নদী আর বাঁধের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে।"

পরিবেশবাদীদের দাবি, স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের দ্রুত এবং কার্যকর হস্তক্ষেপ ছাড়া জাফলংয়ের অস্তিত্ব রক্ষা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ব্যক্তি জানান, জাফলং জিরো পয়েন্টের টিকলী নামক স্থান, জুমপাড়, বরুনের জুং, বল্লাঘাট এলাকায় গোয়াইনঘাট উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এবং সিলেট জেলা বিএনপির বহিষ্কৃত কোষাধ্যক্ষ শাহ আলম স্বপন ও সিলেট জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য এবং বহিষ্কৃত বিএনপি নেতা শাহপরানের নেতৃত্বেই এই অবৈধ পাথর উত্তোলন চলছে। সচেতন মহল মনে করেন, জাফলং শুধু একটি পর্যটন কেন্দ্রই নয়, এটি এলাকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখানকার নদী, পাথর আর সবুজ পাহাড় আজ হুমকির মুখে।

সিলেট পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. বদরুল হুদা জানান, জাফলংয়ে অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলনের দায়ে ইতিমধ্যে ৬টি সিআর মামলায় ৯৮ জন এবং ২টি জিআর মামলায় ১২৩ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। বালু ও পাথর উত্তোলন বন্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তবে তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, স্থানীয় জনসাধারণ সচেতন না হলে এটি বন্ধ করা কঠিন, কারণ পুরো জাফলংয়ের বেশিরভাগ মানুষই এর সুবিধাভোগী। এসকল দানবীয় যন্ত্র যখন বসানো শুরু হলো, তখন তো কেউ প্রতিবাদ করেনি, বরং সুবিধা নিয়েছে।

গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রতন কুমার অধিকারী বলেন, জাফলংয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে তাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যে জাফলং ইসিএ এলাকায় অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের কারণে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কয়েকটি মামলা করা হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করেও পাথরখেকোদের থামানো সম্ভব হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, "আমরা আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।"