Image description

একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সোপান। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সেদিন অজস  শিক্ষার্থী যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, সে আন্দোলনের গতিধারা দেখে কেঁপে উঠেছিল তৎকালীন শাসকের সিংহাসন। তারা ছাত্র আন্দোলন ঠেকাতে ১৪৪ ধারা জারি করলেও ছাত্ররা মানেনি তা। পুলিশ ছাত্রদের উপর গুলি চালালে রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছে অনেকেই। কিন্তু আন্দোলনে পিছু হটেনি। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের সেই সময়ে মূলত কতজন মারা গিয়েছিল আজও কি তা জানা গেছে? শৈশবে আমরা পাঠ্যপুস্তকে পড়ছি, ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ২১ ফেব্রুয়ারির মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন সালাম, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ আরও অনেকে। এই আরও অনেকে মানে কারা? তারা কতজন তার সঠিক তালিকা এখনও পাওয়া গেছে কিনা আমরা জানি না।

 ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে আমরা পাঁচজন শহিদের নাম বেশি শুনতে পাই: সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিউর। এর বাইরে আর কে কে, কোথায় মারা গেছেন তা জানতে হলে আমাদের তখনকার পত্রিকা বা ভাষা আন্দোলন নিয়ে লেখা বইয়ের পাতা উল্টাতে হয়। মহান ভাষা আন্দোলনের  ৭২ বছর পার হলেও ১৯৫২ সালের ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি সরকারি বাহিনীর নির্বিচার গুলিতে কত লোক নিহত হয়েছে তা জানা যায়নি আজও। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে প্রথম স্মারকগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৩ সালের মার্চে। এর প্রকাশক ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম সভাপতি মোহাম্মদ সুলতান। সম্পাদক ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। সেই বইয়ে কবির উদ্দিন আহমেদ ‘একুশের ঘটনাপুঞ্জী’ নামে একটি প্রতিবেদনে লিখেছেন, ‘শহীদদের লাশগুলো চক্রান্ত করে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যায় ‘সীমান্ত’ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ শিরোনামে একটি দীর্ঘ কবিতা লেখেন। কবিতার প্রথম কয়েকটি লাইন ছিল এ রকম:

‘ওরা চল্লিশজন কিংবা আরও বেশি
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে রমনার রোদ্রদগ্ধ
কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায়...
চল্লিশটি তাজা প্রাণ আর অঙ্কুরিত বীজের খোসার মধ্যে
আমি দেখতে পাচ্ছি তাদের অসংখ্য বুকের রক্ত...’

উল্লেখিত কবিতায় কবি যে ৪০ সংখ্যাটি ব্যবহার করেছেন, তা কি শুধু কবিতার জন্য, নাকি এটি সত্য? সেটা জানা না গেলেও বিভিন্নসূত্র অনুযায়ী আটজন শহীদের নাম পাওয়া যায়। ভাষা সংগ্রামী আহমদ রফিক তার ‘একুশ থেকে একাত্তর’ নামের বইয়ে নিহতদের মধ্যে আবদুল আউয়াল, কিশোর অহিউল্লাহ ও সিরাজুদ্দিনের নাম উল্লেখ করেছেন। ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শনিবার প্রকাশিত ভাষা আন্দোলনের অন্যতম পত্রিকা ‘সৈনিক’-এর প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘শহীদ ছাত্রদের তাজা রক্তে রাজধানী ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত’। খবরে বলা হয়েছে, মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে ছাত্র সমাবেশে নির্বিচারে পুলিশের গুলিবর্ষণ বৃহস্পতিবারেই ৭ জন নিহত: ৩ শতাধিক আহত। তাছাড়া দৈনিক আজাদের ওই সময়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি গুলিতে ৯ ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছিল। বহু লাশ গুম করে ফেলা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারে ঘাতকের বুলেটে নিহত সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ২১ ফেব্রুয়ারি তার ডায়েরিতে লিখেছেন: গুলিতে চারজন ঘটনাস্থলেই নিহত হলো। আহত হলো ৩০ জন। জানা যায়, ৬২ জনকে জেলে ঢোকানো হয়েছে। আরো শোনা যায়, পুলিশ কয়েকটি মৃতদেহ সরিয়ে ফেলেছে। বেসরকারি সূত্রের দাবি, মৃতের সংখ্যা ১০ থেকে ১১ জন। ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি ডায়েরিতে লিখেছেন: আজ স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট অব্যাহত থাকল।

হাইকোর্ট, মানসী সিনেমা হল ও ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের আশপাশে গুলিবিদ্ধ হয়ে পাঁচজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেল। বেসরকারি সূত্র অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা ১২, আহত বহু। দৈনিক আজাদ পত্রিকার তথ্যানুযায়ী ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি গুলিতে ৯ জন নিহত হন। সংবাদে লাশ গুমের দায়ে সরকারকে অভিযুক্ত করা হয়। আসলে শহীদ কতজন এটা বের করতে বাংলা একাডেমি, ভাষা ইনস্টিটিউট উদ্যোগ নিলে কাজটি যথাযথ হতো। এই সংগ্রামে যারা আত্মদান করেছে তাদের নাম ও সময়ের পত্র-পত্রিকা খুঁজলে হয়তো পাওয়া যাবে। দ্রুত তালিকাটা করলে ইতিহাসের একটি দিগন্ত উন্মোচিত হবে।

মানবকণ্ঠ/এআরএস