Image description

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস একটি মহাকাব্য, যেখানে স্বাধীনতার গৌরব, ত্যাগের বেদনা ও গণতন্ত্রের জন্য অবিরাম সংগ্রামের গল্প একাকার হয়ে গেছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা ছিল এমন একটি সমাজ গড়ার স্বপ্ন, যেখানে প্রতিটি নাগরিক মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে পারবে, যেখানে রাষ্ট্র হবে জনগণের সেবক, আর গণতন্ত্র হবে ক্ষমতার প্রকৃত মালিক- জনগণের কণ্ঠস্বর। কিন্তু স্বাধীনতার পরের পথচলা সুগম ছিল না। 

স্বাধীনতার পর একদলীয় কর্তৃত্ববাদ, সামরিক শাসন, নির্বাচনী কারচুপি, রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও অস্থিরতা গণতন্ত্রের পথে বাধা সৃষ্টি করেছে। জনগণ রাজপথে নেমে রক্ত দিয়েছে, ত্যাগ স্বীকার করেছে, জীবন উৎসর্গ করেছে এবং অক্লান্ত সংগ্রাম চালিয়ে গেছে। তবুও গণতন্ত্রের পথ কখনো সুগম বা নির্বিঘ্ন ছিল না। এই দীর্ঘ, কঠিন, রক্তাক্ত ও আবেগময় যাত্রার প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালে ‘৩৬ জুলাই’ নামক একটি প্রতীকী ধারণা আবির্ভূত হয়েছে। 

এটি ক্যালেন্ডারের কোনো বাস্তব তারিখ নয়, বরং একটি কাব্যিক, রাজনৈতিক, দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক প্রতিবাদ, যা সেই অনাগত ভোরের স্বপ্নকে ধারণ করে- যেদিন বাংলাদেশ একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক, ন্যায়ভিত্তিক, স্বচ্ছ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মানবিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হবে। ‘৩৬ জুলাই’ বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম, সচেতন নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক, সাংবাদিক, শিল্পী, লেখক ও গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসী সকলের মধ্যে একটি শক্তিশালী প্রতিবাদ, আশা এবং অঙ্গীকারের প্রতীক। 

এটি কেবল একটি ধারণা নয়, বরং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের একটি মহাকাব্যিক প্রতীক, যা জনগণের হতাশা, আকাক্সক্ষা, সংগ্রাম ও স্বপ্নের প্রতিফলন ঘটায়। এটি সেই দিনের স্বপ্ন বহন করে, যেদিন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সুষ্ঠু নির্বাচন, আইনের শাসন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতা এবং নাগরিক অধিকার নিশ্চিত হবে। এই ধারণা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিশেষভাবে জনপ্রিয়, কারণ তারা সম্প্রতি ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের রাজনৈতিক ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা, অন্যায়, অসমতা, দমন-পীড়ন এবং অবিচারের প্রতি তীব্রভাবে সংবেদনশীল। 

‘৩৬ জুলাই’ তাদের কাছে একটি কল্পনা নয়, বরং একটি জীবন্ত স্বপ্ন, যা গণতন্ত্রের গান, প্রতিবাদের ছন্দ, পরিবর্তনের পূর্বঘোষণা ও মানবিক আকাক্সক্ষা হিসেবে কাজ করে। এই প্রতীকটি বাংলাদেশের ইতিহাসের সংগ্রামী চেতনার সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত হয়ে পড়েছে। এটি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মতো ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর প্রতিধ্বনি বহন করে। 

‘৩৬ জুলাই’ জনগণকে মনে করিয়ে দেয় যে গণতন্ত্র কোনো বিলাসিতা নয়, বরং একটি মৌলিক অধিকার; গণতন্ত্র কারো দয়া নয়- এটি ছিনিয়ে আনতে হয়, লালন করতে হয় এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত করতে হয়। এটি সেই স্বপ্নের কথা বলে, যেখানে বিরুদ্ধমত দেশদ্রোহ হিসেবে গণ্য হবে না, সাংবাদিকরা ভয় ছাড়া সত্য প্রকাশ করতে পারবে, নির্বাচন হবে স্বচ্ছ, অবাধ ও সর্বজনগ্রাহ্য, প্রশাসন সাংবিধানিকভাবে দায়বদ্ধ হবে, বিচার বিভাগ স্বাধীন থাকবে এবং নাগরিক অধিকার রাষ্ট্রের অহংকার হবে। এটি একটি এমন দিনের আশ্বাস, যেদিন কোনো গুম-খুন থাকবে না, কেউ রাজনৈতিক পরিচয় কিংবা কোটার কারণে চাকরি থেকে বাদ পড়বে না, সরকারি সেবা পাওয়ার জন্য দলীয় টোকেন লাগবে না, এবং সাংবাদিকরা সত্য প্রকাশের জন্য পুরস্কৃত হবে, নিপীড়িত নয়।

১৯৭১ সালে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ কেবল ভৌগোলিক স্বাধীনতাই অর্জন করেনি; বরং গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, সমতা ও মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রতি একটি অটল অঙ্গীকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে নানা ঘটনা স্বাধীনতার প্রেরণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র, শ্রমিক, শিক্ষক, সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ সামরিক শাসনের অবসান ঘটায় এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করে। 

তবে পরবর্তী দশকগুলোতে গণতন্ত্রের নামে দমনমূলক রাজনীতি, নির্বাচনকে ক্ষমতা ধরে রাখার কৌশল হিসেবে ব্যবহার, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দলীয়করণ এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণ গণতন্ত্রকে দুর্বল করে। বিশেষ করে পতিত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে নির্বাচনগুলো প্রায়শই একদলীয় আধিপত্যের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে, যা স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার অভাবে কলুষিত। ফলাফল আগে থেকে নির্ধারিত বলে জনগণের মধ্যে ধারণা প্রবল হয়েছে, যা ভোটারদের মধ্যে উৎসাহের অভাব সৃষ্টি করেছে। 

অনেকেই মনে করেন, তাদের ভোটের প্রভাব সীমিত। বিরোধী দলগুলো প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধার সম্মুখীন হয়, যার ফলে তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়েছিল। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয়েছিল, গণমাধ্যমের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হয়েছিল এবং প্রশাসন দলীয়করণের শিকার হয়েছিল। সংসদ প্রায়শই একদলীয় বিতর্কহীন মঞ্চে পরিণত হয়েছিল, যেখানে প্রকৃত বিরোধী কণ্ঠস্বর প্রায় শোনা যায়নি। 

এই পরিস্থিতি জনগণের মধ্যে গভীর হতাশা, ক্ষোভ, অবিশ্বাস ও বিচ্ছিন্নতার জন্ম দিয়েছিল। ফলে যে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার কথা ছিল গণতন্ত্রের, সেই জনগণই ক্রমেই দূরে সরে গেছে- নির্বাচন থেকে, রাজনীতি থেকে, এমনকি প্রতিবাদ থেকেও। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম, যারা একটি ন্যায়ভিত্তিক, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের স্বপ্ন দেখে, তারা বর্তমান ব্যবস্থার প্রতি এখনও তীব্রভাবে হতাশ। বিগত সরকারের আমলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ বাকস্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে সীমিত করেছিল। 

সাংবাদিক, লেখক, ছাত্রনেতা, শিল্পী ও সাধারণ নাগরিকরা মতপ্রকাশের জন্য নিপীড়ন, মামলা, হয়রানি এবং কারাদণ্ডের শিকার হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দলীয়করণ ও নিরপেক্ষতার অভাব জনগণের আস্থা ক্ষুণ্ন করেছিল। নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, প্রশাসন ও বিচার বিভাগের উপর আস্থার ঘাটতি গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই সংকটের মধ্যে জনগণের মনে একটি গভীর প্রশ্ন জেগেছিল: বাংলাদেশ কি কখনো সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হতে পারবে? এই প্রশ্নের উত্তরে ‘৩৬ জুলাই’ একটি শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা জনগণের হতাশা, আকাক্সক্ষা ও সংগ্রামের প্রতিফলন।

২০২৪ সালে দুঃশাসনের পতনের পরে ‘৩৬ জুলাই’ কেবল রাজনৈতিক প্রতীক নয়, এটি একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব করছে। এটি তরুণ প্রজন্মের মধ্যে একটি নতুন চেতনার জন্ম দিয়েছে, যারা বুঝতে পেরেছে যে গণতন্ত্র কেবল সংবিধানের শব্দ বা পাঁচ বছর পরপর ভোট দেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং একটি জীবনযাপনের ব্যবস্থা, যেখানে নাগরিকরা ক্ষমতার প্রকৃত মালিক এবং রাষ্ট্র তাদের সেবক। এই ধারণা তরুণদের মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক জাগরণ সৃষ্টি করেছে, যা কবিতা, গান, শিল্পকর্ম, সাহিত্য ও ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। 

এটি জনগণকে মনে করিয়ে দেয় যে, গণতন্ত্র কেবল রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়, বরং প্রতিটি নাগরিকের অংশগ্রহণের মাধ্যমে তৈরি হয়। ‘৩৬ জুলাই’ তরুণদের কাছে গণতন্ত্রের অর্থ পুনর্বিবেচনার একটি আহ্বান- যেখানে ভোটাধিকার মানে নিজের ভাগ্যনির্ধারণে সক্রিয় অংশগ্রহণ, রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে প্রভাব রাখার অধিকার এবং মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা। পতিত সরকারের নানা রকমের লোভ, ভয় আর নির্মম নির্যাতনের পরেও তরুণ প্রজন্ম থেমে যায়নি। 

তারা হয়েছে আরও সচেতন, সংযুক্ত ও প্রতিবাদী; দুই হাত উড়িয়ে হাসতে হাসতে জীবন দিয়েছে, কোনো আক্ষেপ ছিল না, ভয়ও না। মনে হয়েছিল, যেন এটাই তাদের চূড়ান্ত মুক্তি, শেষ হাসির ভেতর লুকিয়ে ছিল এক অমলিন সাহস। তারা দেখেছে- কীভাবে একচেটিয়া শাসনব্যবস্থা গণতন্ত্রের ভাষায় কথা বলে, অথচ এর আত্মাকে হত্যা করে। 

তাদের এই চেতনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রবলভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। ফেসবুক, এক্স, ইউটিউব, টিকটক, ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে তারা মতামত প্রকাশ করছে, সরকারের নীতির সমালোচনা করছে এবং রাজনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি করেছে। ডিজিটাল ক্যাম্পেইন, ভিডিও কনটেন্ট, মিম, তথ্যভিত্তিক প্রতিবেদন, সৃজনশীল প্রতিবাদ, শিল্পকর্ম, কবিতা ও গল্পের মাধ্যমে তারা বর্তমান ব্যবস্থার ত্রুটি তুলে ধরেছে। এই প্রচেষ্টাগুলো কেবল স্থানীয় নয়, বৈশ্বিক পরিসরেও প্রভাব ফেলেছে। 

তরুণরা হংকংয়ের ছাত্র আন্দোলন, মধ্যপ্রাচ্যের গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ, মিয়ানমারের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, আফ্রিকার গণতান্ত্রিক সংগ্রাম এবং লাতিন আমেরিকার নাগরিক আন্দোলনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছিল। এই আন্তর্জাতিক সংযোগ তাদের সংগ্রামকে একটি বৈশ্বিক মাত্রা দিয়েছিল। 

তারা শুধু প্রতিবাদ করেনি, বরং গণতন্ত্রের জন্য একটি নতুন, উদ্ভাবনী ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রস্তাব করছে। তাদের সৃজনশীলতা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা, আন্তর্জাতিক সংযোগ ও সাহস এই সংগ্রামকে একটি নতুন মাত্রা দিয়েছে। তারা প্রমাণ করছে যে তরুণ প্রজন্ম কেবল ভবিষ্যতের নেতা নয়, বর্তমানের পরিবর্তনের কাণ্ডারিও। তাদের কাছে ‘৩৬ জুলাই’ মানে জীবনের গুণগত উন্নয়ন, কণ্ঠের স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক।

২০২৪ সালে দুঃশাসনের পতনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও তার জনগণ সাময়িকভাবে ভারমুক্ত হলেও ‘৩৬ জুলাই’র স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে বাধা রয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ, সাংবাদিক, ছাত্রনেতা, শিল্পী ও সাধারণ নাগরিকদের উপর নিপীড়ন এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কণ্ঠরোধের চেষ্টা এই আন্দোলনকে ব্যর্থ করে তুলবে। তবুও, ‘৩৬ জুলাই’ একটি প্রতিবাদী কবিতার মতো নিষেধের বেড়াজাল ভেদ করে সাহসের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে। 

গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, পুলিশ এবং প্রশাসনের নিরপেক্ষতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের ভূমিকা নতুনভাবে বিবেচনা করতে হবে। গণতন্ত্র কেবল ক্ষমতায় যাওয়ার পথ নয়, বরং বিরুদ্ধমতের অস্তিত্ব নিশ্চিত করার ব্যবস্থা। 

একটি সহনশীল, সম্মানজনক ও নৈতিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, তরুণ প্রজন্ম, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক এবং শিল্পীদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রয়োজন। আমরা এখনও রাজনৈতিক সংস্কৃতির জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে শত্রুতা হিসেবে দেখি, ভিন্নমতকে দেশদ্রোহ বলি, আর ক্ষমতার বাইরে যাওয়াকে অবসানের শুরু হিসেবে ভাবি। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা এই মানসিকতা ভাঙতে পারব, ততদিন ‘৩৬ জুলাই’ কেবল প্রতীক হয়ে থাকবে। কিন্তু প্রতীক কখনো কখনো বাস্তবতার চেয়েও শক্তিশালী হয়, যদি তা মানুষের আশা ও চেতনার প্রতিফলন ঘটায়। এক বছর পরেও এই প্রতীক আমাদের মনে করিয়ে দেয়- আমরা একটি অসম্পূর্ণ যাত্রাপথে রয়েছি। এই যাত্রায় গন্তব্য হল এমন একটি বাংলাদেশ, যেখানে মানুষ নিজের অধিকার নিয়ে বাঁচে, ভয় নয়; প্রশ্ন করে, চাটুকারিতা নয়; মত দেয়, মৌনতা নয়।

‘৩৬ জুলাই’ কেবল একটি কল্পনা নয়, একটি বাস্তব, জীবন্ত ও অমর স্বপ্ন। এটি জনগণের মনে, চেতনায়, সংগ্রামে, রাজপথে, কবিতায়, গানে ও শিল্পে বেঁচে থাকবে। এই ধারণা বাংলাদেশের জনগণকে একটি নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখায়- যেখানে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের মর্যাদা ও অধিকারকে মৌল ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করবে। এই স্বপ্নে নাগরিকরা শুধু করদাতা বা প্রজা নয়, ক্ষমতার প্রকৃত মালিক। এখানে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত নয়, বরং বিকেন্দ্রীকৃত। 

গণতন্ত্র কেবল পাঁচ বছর পরপর ভোট দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং প্রতিদিনের জীবনে নাগরিকদের অধিকার, মর্যাদা এবং সম্মানের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য তরুণ প্রজন্ম, নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দল, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক এবং শিল্পীদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রয়োজন। যখন জনগণ সাহসের সঙ্গে কথা বলে, ছাত্ররা যুক্তি দিয়ে প্রশ্ন তোলে, সাংবাদিকরা নির্ভীকভাবে সত্য উচ্চারণ করে, শিল্পীরা তাদের শিল্পের মাধ্যমে সমাজের আয়না ধরে, তখন রাষ্ট্র বাধ্য হয় পরিবর্তন গ্রহণ করতে।

‘৩৬ জুলাই’ এই পরিবর্তনের পথে একটি আলোকবর্তিকা, যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎকে আলোকিত করবে এবং জনগণকে সাহস, আশা ও অধ্যবসায়ের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দিবে। বাংলাদেশের ইতিহাস বলে, মানুষ যখন জাগে, দুঃশাসন তখন পালায়। অতএব, ‘৩৬ জুলাই’র প্রকৃত বাস্তবায়ন নির্ভর করছে সেই মানুষের উপর- যারা লড়ছে, স্বপ্ন দেখছে, প্রশ্ন তুলছে। 

গণতন্ত্রের সেই প্রত্যাশিত সকাল একদিন আসবেই, যদি আমরা সবাই মিলে তা সম্ভব করার সাহস দেখাই। ৩৬ জুলাই সেই দিনের আশ্বাস, যেদিন আমরা আর বলব না- ‘ভোট দিতে পারিনি’, ‘বলতে পারিনি’, ‘লিখতে পারিনি’। বরং বলব- ‘আমি স্বাধীনভাবে বেঁচে আছি’। এই দিনটি যতদিন না আসে, ততদিন আমাদের দায়িত্ব হবে এটি নিয়ে কথা বলা, লেখা, ভাবা ও সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। ‘৩৬ জুলাই’ সেই প্রবাহের এক সাহসী ধ্বনি। আজ আমরা যারা লিখি, বলি, স্বপ্ন দেখি- তাদের সবার কণ্ঠে এই ধ্বনি ধ্বনিত হোক।

লেখক: কলামিস্ট ও সমাজকর্মী