Image description

পদ্মা সেতু প্রকল্পের দক্ষিণ প্রান্ত শরীয়তপুরের জাজিরা এলাকায় নদীভাঙনের ভয়াবহতা আরও জটিল রূপ নিচ্ছে। বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) সকাল থেকে নতুন করে অছিমদ্দিন মাদবর কান্দি এলাকায় শুরু হওয়া ভাঙনে আরও ১১০ মিটার রক্ষাবাঁধ পদ্মা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এতে এ পর্যন্ত পুরো প্রকল্প এলাকায় মোট ধস গিয়ে দাঁড়াল প্রায় ৭০০ মিটারে। নদীগর্ভে হারিয়েছে বহু বসতঘর, দোকানপাট ও মূল্যবান সম্পদ।

নতুন ভাঙনে অছিমদ্দিন মাদবর কান্দির অন্তত ১৭টি বাড়ি সম্পূর্ণ বিলীন হয়েছে। আতঙ্কে পুরো এলাকা খালি হয়ে গেছে। বাঁচার তাগিদে বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই শতাধিক ঘরবাড়ি ও দোকানপাট সরিয়ে নেওয়া হয়। ভাঙনের আতঙ্কে কাঁদছেন নারী-শিশু, মাথায় মালপত্র নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছেন মানুষ। ভাঙনে শেষ হয়ে যাচ্ছে জীবনসংগ্রাম

ভিটেমাটি হারানো আমেনা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “দিনে দিনে নদী গিলতেছে সব কিছু। সরকার শুধু এসে দেখে যায়, ছবি তোলে, আশ্বাস দেয়, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয় না। এখন আমরা কোথায় যাবো? কীভাবে বাঁচব?”

এই একদিনেই নিঃস্ব হয়েছেন অনেকে। ছোট শিশুদের নিয়ে উদ্বিগ্ন শতাধিক পরিবার এখন খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছেন স্থানীয় স্কুলে, মসজিদে বা আত্মীয়ের বাড়িতে। প্রতিদিনই এগোচ্ছে পদ্মা নদী, পিছু হটছে মানুষ।  

জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কাবেরী রায় জানান, “পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। ভাঙনের কারণে অনেক পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করছি এবং তাৎক্ষণিক সহায়তা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি।”

পদ্মার দক্ষিণ তীরে ২০১২ সালে নির্মাণকাজ শুরুর সময় থেকেই সেতু এলাকার পাশে নদীভাঙন শুরু হয়। এরপর দীর্ঘদিন ধরে স্থায়ী বাঁধের দাবি জানিয়ে আসছে স্থানীয়রা। সেতু কর্তৃপক্ষ প্রথম পর্যায়ে ১১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তীররক্ষা বাঁধ নির্মাণ করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রতিবছরই এই বাঁধ ধসে যাচ্ছে এবং নদীর গতি-প্রকৃতিতে স্থায়ী সমাধান এখনও অধরা। এক বছরে ৫ দফা ধস, ১ লাখের বেশি জিও ব্যাগেও মিলছে না প্রতিকার।  

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত অন্তত ৫ দফায় বড় ভাঙনের ঘটনা ঘটেছে। ৭ জুন: ১০০ মিটার, ৭ জুলাই: ২০০ মিটার, ৯ জুলাই: ১০০ মিটার, ২৩ জুলাই: ১০০ মিটার, ৩১ জুলাই: ১১০ মিটার
এই পাঁচ দফায় মোট ৬১০ মিটার রক্ষাবাঁধ পদ্মা নদীতে বিলীন হয়েছে।
ভাঙন রোধে ৫০০ মিটার এলাকায় এখন পর্যন্ত ১ লাখ ১৯ হাজার বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হলেও কার্যকর কোনো ফল পাওয়া যায়নি। বরং নদীর পানির প্রবল স্রোতে নতুন নতুন এলাকা ভাঙনের কবলে পড়ছে।

পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলী তারেক হাসান বলেন, “নদীতে পানি ও স্রোতের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ভাঙন আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। আপাতত জিও ব্যাগ ফেলার মাধ্যমে ক্ষয়রোধের চেষ্টা চলছে। একইসঙ্গে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণে একটি প্রকল্প প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন মিললে দ্রুত কাজ শুরু করা হবে।”

ভাঙন আতঙ্কে ঝুঁকিতে হাজারো পরিবার, ২৫০টি দোকান-প্রতিষ্ঠান:
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে জাজিরার সাত্তার মাদবর বাজার এলাকার অন্তত ২৫০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং অছিমদ্দিন মাদবর কান্দি, আলম খার কান্দি ও উকিল উদ্দিন মুন্সি কান্দি গ্রামের প্রায় ৮০০ পরিবার। ইতোমধ্যে বহু পরিবার তাদের বাড়িঘর অন্যত্র সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন।

ব্যবসায়ী শরীফ মাদবর বলেন, “আমার দোকানঘর সরিয়ে এনেছি, কিন্তু কতদিন এভাবে চলা যাবে? এভাবে ভাঙতে থাকলে ব্যবসা, সংসার, জীবন—সবই শেষ হয়ে যাবে।”

নিরাপত্তাহীনতায় পদ্মা সেতুর অবকাঠামোও:
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকার নাওডোবা পয়েন্ট থেকে মাত্র ৫০০ মিটারের মধ্যেই রয়েছে সার্ভিস এরিয়া-২, সেনানিবাস, পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো। ভাঙন থামানো না গেলে সেগুলোও ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।

বিশ্লেষকদের মতে, নদীর গতিপথ ও স্রোতের প্রকৃতি বিবেচনায় দীর্ঘমেয়াদে সমন্বিত ও টেকসই নদীশাসন ছাড়া এই ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে প্রাকৃতিক ও প্রযুক্তিগত সমাধানের পথ খুঁজে বের করাই এখন সবচেয়ে জরুরি।