
গত জানুয়ারিতে গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আনাস আল-শরিফ টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের মধ্যেই তাঁর প্রতিরক্ষামূলক পোশাক খুলে ফেলেন। আনন্দিত লোকজন উল্লাস প্রকাশ করতে রাস্তায় নেমে আসেন। তারা আনাসকে কাঁধে তুলে নেন। তখন তারা মনে করেছিলেন, গাজা উপত্যকার ২০ লাখ ফিলিস্তিনির দুর্ভোগের হয়তো অবসান ঘটতে যাচ্ছে। প্রায় সাত মাস পর ইসরায়েল গাজা সিটিতে আলজাজিরার সেই সাংবাদিক আনাসকে তাঁর চার সহকর্মীসহ হত্যা করেছে।
সাংবাদিক আনাসের মৃত্যুতে পুরো বিশ্ব ক্ষোভে ফুঁসছে, জানাচ্ছে নিন্দা। দাবি উঠেছে জবাবদিহির। আনাস ছিলেন গাজার সবচেয়ে সুপরিচিত ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের একজন। গাজায় আগ্রাসন চলাকালে ইসরায়েলের কয়েক ডজন সাংবাদিককে হত্যা করে। তাদের তালিকায় যুক্ত হলো আনাসের নাম।
গতকাল মঙ্গলবার সিএনএনের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, ইসরায়েল যখন গাজায় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোকে প্রবেশে বাধা দিচ্ছিল, তখন ২৮ বছরের আনাস লাখ লাখ মানুষের কাছে গাজার গল্পের মুখ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। যুদ্ধের আগে খুব কম পরিচিত হলেও তিনি সংঘাত ও এর মানবিক ক্ষয়ক্ষতির দৈনিক খবর তুলে ধরে দ্রুত আরব বিশ্বে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তাঁর প্রতিবেদনে সংঘাতের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোর সরাসরি বিবরণ পাওয়া যেত। এর মধ্যে রয়েছে ভূখণ্ডে স্বল্পস্থায়ী যুদ্ধবিরতি, ইসরায়েলের জিম্মিদের মুক্তি ও বিশ্বকে হতবাক করে দেওয়া দুর্ভিক্ষের মর্মান্তিক গল্প।
আনাসের নিজ শহর জাবালিয়ায় ইসরায়েল ব্যাপক বিমান হামলা চালায়। এ হামলার ফুটেজ সামাজিকমাধ্যমে শেয়ারের পর তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। পরে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আনাসকে প্রতিনিধি নিয়োগ দেয় আলজাজিরা। ছিলেন পেশাদার ক্যামেরাম্যান। তাই ক্যামেরার সামনে যেতে ইতস্তত করছিলেন। কিন্তু সহকর্মীরা তাঁকে ক্যামেরার সামনে থেকে প্রতিবেদন তৈরিতে রাজি করান। এ অভিজ্ঞতাকে ‘অবর্ণনীয়’ বলেছিলেন আনাস।
গত ফেব্রুয়ারিতে সোটুর মিডিয়া আউটলেটে তিনি বলেন, ‘আমি কখনও কোনো স্থানীয় চ্যানেলে হাজির হইনি, আন্তর্জাতিক চ্যানেল তো দূরের কথা। এতে সবচেয়ে খুশি ব্যক্তি ছিলেন আমার প্রয়াত বাবা।’ আনাস আলজাজিরায় যোগদানের পরপরই জাবালিয়ায় ইসরায়েলের বিমান হামলায় তাঁর বাবা নিহত হন।
আনাস ছিলেন ছোট্ট দুই সন্তানের জনক। চাকরি শুরুর পর থেকে প্রতিদিনই সংবাদ তুলে ধরতেন। তিনি বলেন, ‘আমরা (সাংবাদিকরা) হাসপাতালে, রাস্তায়, যানবাহনে, অ্যাম্বুলেন্সে, বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয়কেন্দ্রে, গুদামে, বাস্তুচ্যুতদের সঙ্গে ঘুমাতাম। আমি ৩০ থেকে ৪০টি ভিন্ন জায়গায় ঘুমাতাম।’
আনাস আল-শরিফসহ আলজাজিরার পাঁচ সাংবাদিক হত্যার ঘটনায় বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় বইছে। এ ঘটনায় গতকাল মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, উত্তর আয়ারল্যান্ড, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, তিউনেসিয়া, নরওয়ে, সুইডেনসহ বিশ্বের নানা দেশে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। ওয়াশিংটন ডিসিতে বিক্ষোভকারীরা এনবিসি, ফক্স নিউজ, আইটিএন ও দ্য গার্ডিয়ানের অফিস ভবনের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেন।
আলজাজিরা জানায়, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা সংগঠন পেন আমেরিকা বলেছে, পাঁচ সাংবাদিককে হত্যা গভীর উদ্বেগজনক বিষয়। এটা যুদ্ধাপরাধের শামিল। নিন্দা জানিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার সাংবাদিক ইউনিয়ন। জাতিসংঘ এ হামলার নিন্দা জানিয়েছে। সংস্থার মহাসচিব আন্তোনি গুতেরেস এ ঘটনায় স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।
Comments