
বরগুনার বেতাগী উপজেলার প্রত্যন্ত পল্লী হোসনাবাদ ইউনিয়নের দক্ষিণ হোসনাবাদ গ্রামে অতিদরিদ্র পরিবারে জন্ম গনঅভ্যুত্থানে শহীদ ৩৫ বছর বয়সি যুবক মো. টিটু হাওলাদার। গনঅভ্যুত্থানে শহীদ হওয়ার এক বছর পেরুলেও সন্তান টিটুকে হারিয়ে আজও শোকে পাথর বাবা আব্দুর রহিম হাওলাদার।
বাবার কথা স্মরণ করে টিটু ও আয়েশা দম্পতির তিন শিশুসন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে ১১ বছর বয়েসী মোসা. তানজিলার কান্না দেখে চোখের পানি ধরে রাখা যায়না। সাইমুনের বয়স আজ ৮ বছর ও ছোট্ট মেয়ে তামান্নার বয়স এখন ১ বছর চার মাস।
ঢাকার ধানমন্ডিতে কাজে বের হওয়ার সময় ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই গুলিতে নিহত প্রাইভেটকার চালক মো. টিটু হাওলাদারের মা রাশেদা বেগম সাপের কামড়ে মারা যান তার শহীদ হওয়ার আরও চার বছর আগে।
অভাবের সংসারে একটু স”ছলতা আনতে ২০২৪ সালের ১১ জুলাই বাড়ি থেকে গ্রাম ছেড়ে ঢাকার ধানমন্ডির গ্রিন লাইফ হাসপাতালের চিকিৎসক মো. সাখাওয়াৎ আলমের অধীনে প্রাইভেটকার চালানোর চাকরি নিয়েছিলেন শহীদ টিটু হাওলাদার, কিন্তু হলো তার উল্টো। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান টিটু। এতে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। গোটা পরিবারকে অথৈ সাগরে ফেলে দিয়ে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরছেন তিনি।
গনঅভ্যুত্থানে শহীদ হওয়ার এক বছর পর সরেজমিনে দেখা যায়, একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে শোকে কাতর গোটা পরিবারের সদস্যরা। সন্তানের কবরের পাশে বৃদ্ধ বাবা আব্দুর রহিম হাওলাদার নীরবে বসে আছেন, যেন ছেলের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছেন।
এসময় তিনি বলেন, ‘ আমাগো তো সব কিছু শেষ হয়ে গেছে। আমার বুকের মানিক ছেলেকে পক্কির (পাখির) ন্যায় গুলি করা হয়েছে। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই।’
টিটু হাওলাদারের স্ত্রী আয়েশা বেগম এক বছরেও কিছুতেই স্বামীর এ মৃত্যূকে মেনে নিতে পারছেনা। স্বামীকে হারিয়ে সন্তানদের নিয়ে অথৈ সাগরে পড়েছেন। তিনি জানান,টিটু হাওলাদার সর্বশেষ গত ১১ জুলাই বাড়ি থেকে কর্মস্থল ঢাকায় যান। ১৯ জুলাই রাজধানী ঢাকায় কোটাবিরোধী আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষ চলছিলো। দুপুরে খাবার খেয়ে কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন টিটু। বাসা থেকে বের হতেই ধানমন্ডি এলাকায় সংঘর্ষের মধ্যে পেেড় যান তিনি। সেখানেই মাথায় গুলিবৃদ্ধ হয়ে মরা যান।
বাড়িতে থাকা অবস্থায় ঘরে বাজার ছিল না। এরই মধ্যে ৮ দিনের মাথায় ফোন করে তাদের এক নিকটাত্মীয় মর্মান্তিক এ ঘটনার কথা জানান, সে ধানমন্ডির গ্রিন লাইফ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। মগজ বের হয়ে গেছে। পরে পরিবারের সদস্যরা টিুটুর মরদেহ বাড়িতে নিয়ে আসেন এবং পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
তিনি আরো বলেন, এ পর্যন্ত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সর্বপ্রথম দুই লাখ টাকা প্রদান করেছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ১০ লাখ এফডিআর, এর পর জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পাচঁ লাখ টাকা দিয়েছে। আর বিএনপির পক্ষ থেকে ৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।
এ ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে কোন হত্যা মামলা দায়ের করেন। অশ্রুসিক্ত চোখে স্বজনরা বলেন, আমরা এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না টিটু আর নেই। তার স্মৃতি বারবার চোখে ভাসে। মনে হলে চোখের পানি থামাতে পারেন না। যারা তাকে হত্যা করেছে, দ্রুত তাদের বিচার দাবি করেন।
টিটুর ভাই মো: রাকীব হাসান বলেন, স্বৈরাচারের একটি বুলেটে এতিম হয়ে গেছে আমার ভাইয়ের সন্তানরা। সাজানো সংসারের সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। সরকারের কাছে আবেদন, যারা আমার ভাইকে গুলি করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
শহীদ লিটন মাতুব্বর: রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় টাইলস মিস্ত্রীর কাজ করতেন উপজেলার হোসনাবাদ ইউনিয়নের মেহের গাজী করুণা গ্রামের গনঅভ্যুত্থানে শহীদ লিটন মাতুব্বর। টগবগে এই তরুণের মৃত্যুতে যে শূণ্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা কখনোই পূরণ হবেনা। শহীদ হওয়ার এক বছর অতিবাহিত গেলেও আজও কোন কিছুতেই ভুলতে পারছে না। আজও পরিবারে শোক বইছে। শহীদদের আত্মত্যাগ যেন মূল্যহীন না হয়ে পরে এমনই প্রত্যাশা তাদের।
রোববার সকালে সেখানে গেলে তার স্বজনরা বলেন, ২০ বছর ধরে লিটন মাতুব্বর বাড্ডা এলাকায় বসবাস করেন। ১৮ জুলাই দুপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ চলছিলো। এসময় লিটন মাতুব্বর রাস্তা পার হয়ে কাজের উদ্দেশ্যে একটি বাসায় যাচ্ছিলেন। সেখানেই গুলিবিদ্ধ হন।
শহীদ লিটনের বড় ভাই বশির মাতুব্বর জানান, গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হওয়ার পর লিটনকে ঢাকার কুর্মিটোলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। পরে পুলিশ তার লাশ ময়না তদন্তের জন্য সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরের দিন লাশ হস্তান্তর করলে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসেন তারা। সেখানেই পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় তার লাশ।
স্বজনরা বলেন, ৬ সদস্যর পরিবারে উপর্জনের একামাত্র ভরসা ছিলেন তিনি। লিটনের আয়ে চলতো প্রতিবন্ধী বাবার চিকিৎসা। ৩৫ বছর বয়স হলেও বাবার চিকিৎসার কথা চিন্তা করে তিনি বিয়ে কর ছিলেন না। লিটনের আর ও তিন ভাই- বোন রয়েছে।
লিটনের বাবা তৈয়ব আলী (৭১) বলেন, ‘দেশের জন্য ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে শহীদ হয়েছে আমার ছেলে। স্বপ্ন ছিল বিয়ে করবে, একসময় পরিবারের দায়িত্ব নিয়ে ব্যয়ভার বহন করবে এবং পরিবারকে স্বাবলম্বী করে তুলবে।’
Comments