
গাজীপুরে দৈনিক প্রতিদিনের কাগজের স্টাফ রিপোর্টার আসাদুজ্জামান তুহিনকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যার ঘটনার মূলে রয়েছে একটি ‘হানিট্র্যাপ’ চক্রের কারসাজি। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার ড. নাজমুল করিম গত শনিবার (৯ আগস্ট) এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, হানিট্র্যাপের একটি ঘটনার ভিডিও ধারণ করায় এবং তা মুছে ফেলতে অস্বীকৃতি জানানোয় তুহিনকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে ছিনতাইকারী চক্রটি। এই চক্রের নেতৃত্বে ছিলেন কেটু মিজান ও তার স্ত্রী পারুল আক্তার ওরফে গোলাপী।
জিএমপি কমিশনার জানান, গত বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) সন্ধ্যায় শেরপুরের বাদশা মিয়া নামে এক যুবক চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় একটি এটিএম বুথ থেকে ২৫ হাজার টাকা তুলে বাড়ি ফিরছিলেন। এ সময় গোলাপী তাকে হানিট্র্যাপে ফেলার চেষ্টা করেন। বিষয়টি টের পেয়ে বাদশা তার সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়ান এবং তাকে ধাক্কা ও ঘুসি মেরে সরে আসার চেষ্টা করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে গোলাপীর সহযোগী ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা ধারালো অস্ত্র নিয়ে বাদশার ওপর হামলা চালায়। প্রাণ বাঁচাতে বাদশা দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে তারা তাকে ধাওয়া করে।
এই ঘটনা ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিক তুহিন মোবাইল ফোনে ধারণ করছিলেন। ভিডিও ধারণের বিষয়টি দুর্বৃত্তরা দেখে ফেললে তাকে ভিডিও মুছে ফেলতে বলে। তুহিন তা মানতে অস্বীকৃতি জানালে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে ধাওয়া করে। তিনি ঈদগাহ মার্কেটের নিচতলায় একটি চায়ের দোকানে আশ্রয় নিলেও হামলাকারীরা সেখানে তাকে ধরে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে। ঘটনার একটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে হামলার দৃশ্য স্পষ্ট দেখা যায়।
কেটু মিজান ও গোলাপীর অপরাধ রাজ্য
পুলিশ জানায়, কেটু মিজান ও তার স্ত্রী গোলাপী গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় একটি শক্তিশালী ছিনতাই ও প্রতারণা চক্র পরিচালনা করতেন। মিজান জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার মাহমুদপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা। প্রায় ২৫-৩০ বছর আগে তার পরিবার রংপুরে চলে যায়। পরে গোলাপীকে বিয়ে করে তিনি গাজীপুরে এসে এই অপরাধ চক্র গড়ে তোলেন। গোলাপী এই চক্রের দ্বিতীয় প্রধান হিসেবে কাজ করতেন এবং হানিট্র্যাপের মাধ্যমে যুবকদের ফাঁদে ফেলে তাদের সম্পদ লুট করতেন।
গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের মধ্যে রয়েছেন পাবনার ফরিদপুর উপজেলার মো. স্বাধীন (২৮), খুলনার সোনাডাঙ্গার আল আমিন (২১), কুমিল্লার হোমনা থানার শাহ জালাল (৩২), পাবনার চাটমোহরের ফয়সাল হাসান (২৩), শেরপুরের নকলার সাব্বির সুমন (২৬), এবং ময়মনসিংহের ত্রিশালের শহীদুল ইসলাম (২৮)। এছাড়া মিজান ও গোলাপীও গ্রেপ্তার হয়েছেন। এদের মধ্যে স্বাধীনকে র্যাব-১ গ্রেপ্তার করে, এবং শহীদুল ইসলামকে কিশোরগঞ্জ থেকে র্যাব-১৪ গ্রেপ্তার করে।
জিএমপি কমিশনার জানান, এই আট আসামির বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় হত্যা, ধর্ষণ, মাদক ও ছিনতাইয়ের ২৯টি মামলা রয়েছে। শুধু মিজানের বিরুদ্ধেই ১৫টি মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তারের পরও মিজানের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ অব্যাহত ছিল। আদালতে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা নাটক-সিনেমা-ছবি করেন, আমি করি রিয়েল।’ তিনি সাংবাদিকদের চোখ পাকিয়ে দেখে নেওয়ার হুমকিও দেন।
গ্রেপ্তার ও আইনি ব্যবস্থা
ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে পুলিশ আটজন আসামিকে শনাক্ত করে। এর মধ্যে সাতজনকে গ্রেপ্তার করে জিএমপি, এবং একজনকে কিশোরগঞ্জ থেকে র্যাব-১৪ গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতদের গতকাল শনিবার গাজীপুরের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. আলমগীর আল মামুনের আদালতে হাজির করা হয়। পুলিশ ১০ দিনের রিমান্ড চাইলেও আদালত প্রত্যেকের জন্য দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
জিএমপি কমিশনার বলেন, ‘গ্রেপ্তার আসামিরা অপরাধ স্বীকার না করলেও সিসিটিভি ফুটেজ এবং অন্যান্য প্রমাণ তাদের অপরাধ প্রমাণ করবে।’ তিনি ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর আগামী ১৫ দিনের মধ্যে চার্জশিট দাখিলের কথাও জানান। তিনি তুহিনের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে পুলিশের ব্যর্থতার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।
মামলা ও তদন্ত
বাসন থানার ওসি শাহীন খান জানান, তুহিন হত্যার ঘটনায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। একটি মামলার বাদী তুহিনের বড় ভাই মো. সেলিম, এবং অপর মামলার বাদী বাদশা মিয়ার ভাই। গ্রেপ্তার সাতজনকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এই ঘটনা গাজীপুরে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সাংবাদিক সমাজ ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। পুলিশ কমিশনার জানান, এই অপরাধের পেছনে অর্থনৈতিক দুরবস্থাও একটি কারণ। গত ৫ আগস্ট থেকে অনেক গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ থাকায় বেকার শ্রমিকরা অপরাধের দিকে ঝুঁকছেন। তিনি অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
Comments