Image description

শ্রীমঙ্গলের ভোর। ঘন কুয়াশার চাদর ভেদ করে সারি সারি চা-গাছের নিচে দেখা যায় মাথায় বাঁশের ঝুড়ি নিয়ে হাঁটছেন নারীরা। শিশিরভেজা পাতার ভেতর দিয়ে তাদের হাত ছুটে চলে। প্রতিটি সবুজ পাতা যেন জীবিকার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা স্বপ্নের প্রতীক।

তাদেরই একজন ভাড়াউড়া চা-বাগানের শ্রমিক চামটি রায় ঘটাওয়ার। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত টানা পরিশ্রমের পর মজুরি হাতে পান মাত্র কয়েকশ’ টাকা। “এই টাকায় সংসার চলে না। তার চলার মতো জীবন তো দূরের কথা। সন্তানদের পড়ানোর ইচ্ছে থাকলেও অভাব-অনটনে মাঝপথে থেমে যায় সবকিছু,”—কণ্ঠে অভিমান ঝরে পড়ে চামটি রায় ঘটাওয়ার।

চা-শ্রমিকদের এই বঞ্চনা নতুন কিছু নয়। তারা যুগের পর যুগ বঞ্চিত থেকেছেন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন ও সামাজিক সুরক্ষা থেকে। অথচ দেশের অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলো সরকারি স্বীকৃতির ফলে পাচ্ছেন বৃত্তি, কোটা সুবিধা ও সামাজিক নিরাপত্তা।

কিন্তু চা-বাগানের বহু জনগোষ্ঠী এখনও সেই তালিকার বাইরে। ফলে তাদের জন্য রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা অধরাই রয়ে গেছে।

বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) বলছে, চা-বাগান এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তি হার তুলনামূলক ভালো হলেও মাধ্যমিক স্তরে ঝরে পড়ার হার প্রায় ৫০ শতাংশ। কারণ, অর্থনৈতিক সংকট, বৈষম্য ও সুযোগের অভাব।

চা-শ্রমিক সমাজের ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনধারা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সঙ্গে মিল থাকলেও তাদের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই। তাই সরকারি সুবিধা থেকেও তারা বঞ্চিত।

স্থানীয় মানবাধিকার কর্মী ফারুক খানের ভাষায়, “চা-বাগানবাসীরা বহু প্রজন্ম ধরে এই দেশে বসবাস করছে। তারা স্বতন্ত্র একটি সম্প্রদায়। অথচ স্বীকৃতি না থাকায় দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বের হতে পারছে না।”

শ্রীমঙ্গল আইডিয়াল স্কুলের প্রধান শিক্ষক এহসানুল হক মনে করেন, “চা-শ্রমিক সমাজকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা শুধু মানবিক দায়িত্ব নয়, বরং রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন তখনই সম্ভব, যখন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকেও সমানভাবে সুযোগ দেওয়া হবে।”


শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবি অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৪ লাখ চা-শ্রমিক কাজ করছেন। তাদের অনেকেই ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা জনগোষ্ঠীর বংশধর। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই মাটিতে কাজ করেও আজও বৈষম্যের শেকল থেকে মুক্ত হতে পারেননি তারা।

চা-শ্রমিক ইউনিয়নের এক নেতা বলেন, “আমরা চাই আমাদেরও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হোক। তাতে আমাদের সন্তানরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে। রাষ্ট্র তখনই এগোবে, যখন কেউ পেছনে পড়ে থাকবে না।”

দিনশেষে চামটি রায় ঘটাওয়ার নামের এক নারী শ্রমিক ঘরে ফেরেন। ক্লান্ত শরীর, তবুও আহার তুলে দেন পরিবারের মুখে। চোখে স্বপ্ন, “হয়তো একদিন আমার বাগানের সন্তানরা ভালো অবস্থানে যাবে। আমাদের মতো বৈষম্যের শিকার হতে হবে না তাদের।”

চা-বাগানের অগণিত পরিবারে প্রতিদিনই এমন স্বপ্ন জন্ম নেয়, আবার ভেঙেও যায়। এখন সময় এসেছে সেই স্বপ্নগুলোকে রক্ষা করার, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সুরক্ষার মাধ্যমে।