
আগামী জাতীয় নির্বাচন ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে। এমন ঘোষণা আসার পর নির্বাচনী আমেজ শুরু হয়ে গেছে দেশের অন্যতম বড় দল বিএনপিতে। নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ হিসেবে প্রার্থী বাছাইয়ের কাজে এবার মনোনিবেশ করতে চায় দলটি। অবশ্য নির্বাচনের কর্মকৌশল আগ থেকে চলমান রেখেছে তারা। এখন ৩০০ আসনে উপযুক্ত প্রার্থী খুঁজতে শিগগিরই মাঠে নামার ইঙ্গিত দিয়েছেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা।
দলটির বেশ কয়েকজন নেতা মানবকণ্ঠকে জানিয়েছেন, আগামী সপ্তাহে সারাদেশের জেলা, উপজেলা ও বিভাগীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে পারেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তবে বৈঠকের তারিখ এখনো চূড়ান্ত হয়নি। বৈঠকের পর শিগগিরই মাঠে নামবে দলটির কেন্দ্রীয় নেতাসহ দলের নির্বাচনী টিম। এর আগে ৮ আগস্ট শুক্রবার ১২ দলীয় জোটের সঙ্গে বৈঠকে বসেন তিনি। গত জুন মাসে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন আয়োজন করার কথা বলেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা।
তবে ১৩ জুন লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে তার বৈঠকের পর এক ‘যৌথ ঘোষণায়’ বলা হয়, সব প্রস্তুতি শেষ হলে ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগেই নির্বাচন হতে পারে। তাতে সন্তুষ্ট হলেও বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা ও তফসিলের দাবি জানিয়ে আসছিল। গত মঙ্গলবারের ভাষণে ভোটের নির্দিষ্ট কোনো তারিখ না থাকলেও যৌথ বিবৃতির সময়সীমা ঠিক থাকায় প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে বিএনপি।
গত বুধবার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এ বিষয়ে দলের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানান মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, বিএনপি আশা করে, এই নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য সরকার, নির্বাচন কমিশন সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। একটি কার্যকরী জাতীয় সংসদ গঠনের জন্য বিএনপি সকল রাজনৈতিক দল ও জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছে। এ নির্বাচনকে ‘অতি জরুরি’ হিসেবে বর্ণনা করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, এখন এই নির্বাচনটা দেশের জনগণই চায়। জনগণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সবচেয়ে বড় প্রহরী হয়ে দাঁড়াবে।
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পর মঙ্গলবার রাতে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়। লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি আলোচনায় যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এর আগে জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার বিকালে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের পাশে নিয়ে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেন প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণ এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে যে, ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান ২০২৪-এর উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হবে এবং পরবর্তী নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারের সংস্কারকৃত সংবিধানের তফসিলে এ ঘোষণাপত্র সন্নিবেশিত থাকবে।
এ বিষয়ে বিএনপির প্রতিক্রিয়া তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, বিএনপি এই ঘোষণাপত্রকে স্বাগত জানায়। বিএনপি বিশ্বাস করে, এই ঘোষণাপত্রে রাজনৈতিক দলগুলো যে অঙ্গীকার করেছে, তা পালনের মধ্য দিয়ে এক নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের রূপান্তরের কাজ শুরু হবে। সুযোগ সৃষ্টি হবে একটি সাম্য, মানবিক মূল্যবোধ ও ন্যায়বিচার ভিত্তিক সত্যিকারের প্রগতিশীল সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের। যে সকল রাজনৈতিক দল, ছাত্র, কৃষক, শ্রমিকসহ সকল স্তরের জনগণ এই সংগ্রামে অংশ নিয়েছে, শহীদ হয়েছে, আহত হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে, বিএনপি তাদের জানাচ্ছে কৃতজ্ঞতা, ধন্যবাদ ও অভিনন্দন।
অধ্যাপক ইউনূসের প্রশংসা করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, প্রফেসর ইউনূস এখন পর্যন্ত যতগুলো কাজ করেছেন, তাতে করে উনি প্রমাণ করেছেন যে, তিনি এমন কিছু করবেন না, যা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
জুলাই ঘোষণাপত্রের পর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ রয়ে গেল কিনা এমন প্রশ্নে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এখন নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করবে যথাসময়ে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে যে একটি দোদুল্যমানতা ছিল, তা আর রইল না। এখন গোটা জাতি নির্বাচনমুখী পরিবেশের মধ্য দিয়ে যাবে।
তিনি বলেন, ‘আগামী দিনের নির্বাচন ইনশাআল্লাহ অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে প্রশংসিত একটা নির্বাচন হবে বলে আমরা আশা করি। সেই লক্ষ্যে সমগ্র জাতিকে প্রস্তুতি নেয়ার জন্য আমরা আহ্বান জানাচ্ছি।’
সালাহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘আমরা মনে করি, এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আরও বেশি প্রতিষ্ঠিত হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগে কোনো রকমের অনিশ্চিত পরিবেশ আর থাকবে না। সবকিছু সচল হবে এবং গতিশীলতা পাবে।’
এদিকে গত বুধবার বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা জানান, আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার পর এখন থেকে নির্বাচনী প্রস্তুতি পুরোদমে চালিয়ে যাবে বিএনপি। এর আগে নির্বাচনী চূড়ান্ত কর্মকৌশল প্রণয়ন করা হয় অনেক আগে। দলের হাইকমান্ড অত্যন্ত গোপনে তিন স্তরে যাচাই-বাছাই কার্যক্রম চালিয়েছে। ৩০০ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের একটি খসড়া তালিকার কাজ শেষ করেছে দলটি। এ তালিকায় অধিকাংশ আসনেই একাধিক প্রার্থী রয়েছে। খসড়া তালিকার প্রার্থীদের আমলনামাও পৌঁছে গেছে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে। প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ের পর তিনি প্রার্থীদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য নিচ্ছেন। তাদের মধ্যে যোগ্য ও ক্লিন ইমেজের নেতাদের গ্রিন সিগন্যাল দেয়াও শুরু করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত দুই সপ্তাহ থেকে তারেক রহমান মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সাথে ভার্চুয়ালি কথা বলছেন। প্রায় প্রতিদিন এ সাক্ষাৎ অব্যাহত রয়েছে। গড়ে প্রতিদিন চার থেকে পাঁচজনের সাথে কথা বলছেন তিনি।
এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, প্রতিটি আসনে সার্ভে করা হচ্ছে। সম্ভাব্য প্রার্থীদের বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। বিএনপির তৃণমূলের নেতারা যাদের চাইবেন তাদের সবচেয়ে বেশি প্রায়োরিটি দেয়া হবে। চূড়ান্তভাবে বিএনপির যে মনোনয়ন বোর্ড আছে, সেখানে সম্ভাব্য প্রার্থীদের ইন্টারভিউ হবে। তারপরই যাচাই-বাছাই শেষে যোগ্য প্রার্থীকে দেয়া হবে দলীয় মনোনয়ন। জুলাই আন্দোলনসহ যুগপৎ আন্দোলনে যারা সম্পৃক্ত ছিলেন এবং আছেন তাদেরও সেই কার্যক্রমও মূল্যায়ন করা হবে বলে জানান তিনি।
এদিকে দলীয় শৃঙ্খলা লঙ্ঘন, সংঘাত-হানাহানি সৃষ্টি, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত থাকার অভিযোগে এই পর্যন্ত সারাদেশে বিএনপি ৭ হাজার নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর দেশের বিভিন্ন জেলায় সংগঠনের কিছু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, তদবির বাণিজ্য ও প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ উঠেছে। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা এ বিষয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে কাজ করছেন। দলটি প্রথমে কারণ দর্শানোর নোটিশ, ক্ষেত্রবিশেষে বহিষ্কার কিংবা পদ স্থগিতের মতো কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিচ্ছে। পাশাপাশি বিশৃঙ্খল নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিএনপির পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অনুরোধ জানানো হচ্ছে। যাতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে হাইব্রিড নেতাকর্মীদের এ বিশৃঙ্খলা বন্ধ করা যায়, সে জন্য দলীয় হাইকমান্ড নানা কৌশলে বিরামহীনভাবে কাজ করছে বলে জানা গেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, দলের কোনো কোনো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নভাবে বিশৃঙ্খলা-অপরাধের অভিযোগ আসছে। তবে অভিযোগ প্রমাণের সঙ্গে সঙ্গে তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে। অপরাধ করে কেউ পার পাচ্ছেন না। দলের নাম ভাঙিয়ে যারাই কোনো অপকর্মে জড়িত হচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে সারাদেশে দ্রুত সাংগঠনিক কমিটিগুলোকে পূর্নাঙ্গ কমিটি করতে নির্দেশ দিয়েছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
Comments