জুলাই সনদ ব্যর্থ হলে জুলাই যোদ্ধা-শহীদরা সন্ত্রাসী হয়ে যাবে: ডা. শফিকুল ইসলাম মাসুদ

'জুলাই সনদ' নিয়ে চলমান আলোচনা ও সংস্কারের প্রতিফলন প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি ডক্টর শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকেই তারা কয়েকটি মৌলিক কথা বলে আসছিলেন। তিনি জুলাই সনদকে বিচার সংস্কারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক এবং একটি 'রক্ষাকবচ' হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
তিনি বলেন, "যে গণ-অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে আমি শফিকুল ইসলাম মাসুদ আজকে আপনার সঙ্গে বা এখানে এসে কথা বলতে পারছি।" এই মন্তব্য ইঙ্গিত দেয় যে, জামায়াত মনে করে জুলাই সনদ তাদের জন্য বাকস্বাধীনতা ও রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করেছে, যা গণ-অভ্যুত্থানের ফসল।
তিনি আরও বলেন, এই জুলাই সনদের প্রতি যদি আমাদের কোনো অবহেলা থাকে, উপেক্ষা থাকে বা এটাকে যদি যথাযথভাবে ধারণ না করতে পারি, তাহলে এই গণ-অভ্যুত্থান আমাকে সন্ত্রাসী বানাতে সক্ষম।
সম্প্রতি একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের টক শো অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
মাসুদ আরো বলেন, জুলাই সনদ ব্যর্থ হলে এই গণ-অভ্যুত্থানে যাদের বীর বলা হচ্ছে, জুলাইযোদ্ধা বলা হচ্ছে, শহীদ বলা হচ্ছে বা শহীদ পরিবার বলা হচ্ছে, এই পরিবারগুলোই একটা সন্ত্রাসী পরিবার হয়ে যাবে। আমি শফিকুল ইসলাম মাসুদ জুলাইযোদ্ধাদের একজন সহযোগী। আমাকেও সন্ত্রাসী হিসেবে মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় রাখা হবে এবং খুঁজে বের করা হবে।
তিনি বলেন, জুলাই সনদ আগামীতে জাতীয় নির্বাচনের একটি গ্যারান্টিপত্র। যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো তার মৌলিক জিনিসগুলো সেখানে উপস্থাপন করবে। কারণ সংবিধানের বাইরে তো আমাদের এটা ছাড়া আর কিছু নেই। আমাদের এই সরকার গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী কেয়ারটেকার সরকার না বা তত্ত্বাবধয়ক সরকার না।
এটাকে কোন কোন অর্থে আপনি অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটা বিপ্লবী সরকার বলতে পারেন।
তিনি আরো বলেন, জনগণের মধ্যে একটা এক্সপেক্টেশন ছিল। এই বিপ্লবী সরকার বা এই গণ-অভ্যুত্থানের সরকারকে একটা স্ট্রাকচারে নিতে পারলে আমরা আরো অনেক কিছু করতে পারতাম। কিন্তু আমরা করতে পারিনি। এই সনদে আমাদের করণীয় কী বা বর্জনীয় কী বা সংযোজন কী? বিয়োজন কী? আমি অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে বলছি, সনদের স্টেকহোল্ডার কারা? স্টেকহোল্ডার কিন্তু কোনো একটা-দুইটা পার্টি না।
ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলনে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, তাদের প্রত্যেকের কাছেই এই জুলাই সনদের গুরুত্ব সমানভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।
মাসুদ বলেন, কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, আমরা শুনতে পাচ্ছি যে ১০ দিন আগে, সাত দিন আগে, ১৫ দিন আগে কোনো কোনো দলকে এর খসড়াটা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো দলকে সাত দিন আগে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। যখন আমরা জানতে পেরেছি অমুকের কাছে, অমুক দলের কাছে বা অমুক ব্যক্তির কাছে জুলাই সনদের কপি পৌঁছে গেছে। তাদের দেখার জন্যও বলা হয়েছে। এমনকি তারা পরামর্শও দিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু তখনো জামায়াতে ইসলামীর মতো একটা সংগঠনের কাছে জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়াটা আসেনি। চেয়ে নেওয়ার মতো দেউলিয়া সংগঠন জামায়াতে ইসলামী নয়।
তিনি বলেন, জুলাই সনদ তো আপনারা (সরকার) করছেন। ওখানে জামায়াতে ইসলামীর কোনো স্বাক্ষর দরকার হবে না বা আমাদের প্রয়োজন হবে না। এটা হয়ে গেলে খুশি হব। এটা হয়ে যাওয়া দরকার।
তিনি মাইলস্টোন স্কুলের ঘটনা নিয়ে বলেন, ঘটনার দিন রাতে চার দলকে ডাকা হলো। এই মিটিংয়ে মূল আইডিয়াটা ছিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ। যাতে মাইলস্টোনের ঘটনার পরবর্তী সময়ে কেউ যেন এটাকে অন্যদিকে নিতে না পারে। অর্থাৎ পলিটিক্যালি যেন এটাকে কেউ ব্যবহার করতে না পারে। পরের দিন ১৪ দলের মিটিং শেষ করে আমরা একটা ব্রিফ দেখলাম।
তিনি বলেন, একজন রাজনৈতিক নেতা ব্রিফ করছেন যে আমরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি এবং তিন-চার দিন বা চার-পাঁচ দিনের মাথায় একটা নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হচ্ছে। কী একটা আজব দেশে আমি বাস করছি! প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে মাইলস্টোন রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে। সেখানে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার মতো ব্যাপার ওনাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং এই দায়িত্ব ওনাদের দেওয়া হয়েছে। এতটা এলোমেলো অগোছালো অবস্থা।
তিনি আরো বলেন, তারিখ নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি হয়নি, এই ক্লারিফিকেশন দেওয়ার দায়িত্ব আমারও না, কোনো পলিটিক্যাল পার্টিও না। ক্লারিফিকেশন দেওয়ার দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের এবং প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয়ের। এখন পর্যন্ত ক্লারিফিকেশন আসেনি বিধায় আমাকে ধরে নিতে হচ্ছে যে এ রকম করে আলোচনা হয়েছে।
মাদুস বলেন, জুলাই সনদটা আমাদের কাছে যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে, আসলেই এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার স্টেকহোল্ডারগুলোকে সমন্বয় করে কাজটা আদৌ করতে চায় কি না? একটা নতুন পরিস্থিতি তৈরি করে আসলে এগুলোকে তারা (সরকার) ইগনোর করতে চায়।
সন্দেহ-সংশয়ের মধ্য দিয়ে জুলাই সনদ কেমন হবে মনে হচ্ছে? এই প্রশ্নের জবাবে টক শোতে উপস্থিত সিনিয়র সাংবাদিক আশরাফ কায়সারও বলেন, প্রথমত মাইলস্টোন স্কুলের দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রধান উপদেষ্টা যেভাবে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ করেছেন, তা বেশ দৃষ্টিকটু লেগেছে। বিশেষ করে দেশের প্রধান দল কারা? চারটি প্রধান দল কারা? এগুলো ঠিক করার দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের না এবং বৈঠকের ভেতরে আমরা এমন দলকেও দেখেছি, যারা শেখ হাসিনার তিনটি পচা নির্বাচনে অংশ নিয়ে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনকে বৈধতা দিয়েছিলেন।
তিনি আরো বলেন, পরবর্তী সময়ে আমরা যেভাবে চার-পাঁচ দিনের মধ্যে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবেন বলে আরেকজন নেতাকে বলতে শুনলাম, এটিও দৃষ্টিকটু লেগেছে। কেননা এভাবে তো বলা যাবে না। বলতে হবে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে। সেটা প্রেস হোক বা অন্য কোনো উপদেষ্টা হোক। তার মানে তারা এই বিষয়গুলো ডিল করতে গিয়ে অপেশাদারি হয়েছেন এবং ব্যালান্স রাখতে পারছেন না। মানুষের কাছে খুব বিশ্বাসযোগ্য জায়গায় নেই তারা।
তিনি বলেন, মাইলস্টোন দুর্ঘটনার পরেই এই আলোচনাগুলো আরো দৃষ্টিকটু লেগেছে। এখনই ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য বজায় রাখতে হবে, যখন আমাদের ছেলে-মেয়েরা পুড়ে মারা যাচ্ছে। অনেকটা অমানবিকভাবে রাজনৈতিক আলোচনা।
আশরাফ কায়সার বলেন, জুলাই সনদ হচ্ছে আমাদের রক্ষাকবচ এবং ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা। এখন আপনি যদি রক্ষাকবচের অর্থে দেখেন, তাহলে সরকারের বৈধতাও এই সনদের ওপর নির্ভর করছে। কারণ সরকার তো বিপ্লবী সরকার না। এই সরকারটি একটা ভজঘট সরকার। সরকার গঠনের ওই ৭২ ঘণ্টা আমার পরিষ্কার জানতে হবে। প্রতি মিনিটে কী ঘটেছে। কী করে সিদ্ধান্ত হলো, বিপ্লবের পরপরই এ রকম একটা প্রতিবিপ্লবী সরকার গঠন হলো। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আপনি ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই আরো পাবেন।
তিনি বলেন, পরবর্তী সময়ে সরকারের চরিত্র, প্রকৃতি এবং আচরণ দেখে আমাদের ধারণা হয়েছে, প্রতিপক্ষ বিপ্লবটি সংঘটিত হয়েছে। যেভাবে বিপ্লবী সরকার বা গণ-অভ্যুত্থানের সরকার আচরণ করে সে রকম আচরণ করতে দেখিনি।
তিনি আরো বলেন, সংস্কারের যে ন্যূনতম প্রত্যাশা সচিবালয়ের ভেতরে এবং পুলিশের ভেতরে, সেগুলো আমরা আমরা দেখিনি। আজকে যে ইস্যুগুলো নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, ঐকমত্য কমিশনের সমস্যা হচ্ছে এবং দেশের ভেতরে মানুষের হতাশা তৈরি হয়েছে, সেগুলোরও ভ্রূণ কিন্তু ওই গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। কাজেই যারা একসময় বলেছে আমরা একটি সরকার গঠন করলাম, কেউ দৌড়াদৌড়ি করল উপদেষ্টা হওয়ার চেষ্টায়, কে কাকে চিনি এগুলো, তাদের বিবেক থাকলে প্রায়শ্চিত্ব করতে হতে পারে। কারণ আমরা সময়ের দাবি পূরণ করতে পারিনি। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার দাবি পূরণ করতে পারিনি।
তিনি বলেন, এখন কেন জুলাই সনদ গুরুত্বপূর্ণ? এখন যা যা ভুল হয়েছে, যা যা ভিন্নপথে প্রবাহিত হয়েছে, এগুলোকে আপনার দায়মুক্তি দিতে হবে। আপনাকে সরকারটির বৈধতা নিশ্চিত করতে হবে। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার সময় যে তিনি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন এবং কিছু পুলিশ সদস্যসহ কেউ কেউ মারা গেছেন। তাদের ব্যাপারেও আপনার একটা অবস্থানে আসতে হবে।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, মোর ইম্পরটেন্টলি আপনাকে সংস্কারের ব্যাপারগুলো পরিষ্কার করতে হবে। কেননা আমরা বলছি, একটি গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে এবং প্রত্যাশাটি হচ্ছে— সংস্কার করে রাষ্ট্রকে ঠিক করা। এটি যদি কোনো সনদে বা ঘোষণাপত্রে লেখা না থাকে তাহলে, ইতিহাসে কে দাঁড়িয়ে বলবে যে এটি মানুষের প্রত্যাশা ছিল?
Comments