
বিচারপতির গাম্ভীর্য আর নিরপেক্ষতার মুখোশ পরে বাংলাদেশের ইতিহাসে যারা সবচেয়ে নগ্ন দলীয় আনুগত্যের প্রদর্শন করেছেন, তাদের শীর্ষে যার নাম উঠে আসে, তিনি হলেন এবিএম খায়রুল হক। মুখে সংবিধান, হাতে কাঠের হাতুড়ি, কিন্তু হৃদয়ে দলীয় পতাকা। এ দেশে বহু বিতর্কিত মানুষ জন্মেছেন, কিন্তু বিচার বিভাগের চেয়ারে বসে যিনি ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক বর্ম হয়ে উঠলেন, এমন নজির বিরল।
বিচারক হিসেবে শপথ নেয়ার পর থেকে অবসান পর্যন্ত এবং পরবর্তীতে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হয়ে তার কর্মকাণ্ড সবকিছুতেই ছিল এক আশ্চর্য রকমের পক্ষপাত। খায়রুল হকের সবচেয়ে বড় ‘অর্জন’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায়। দেশের লাখো মানুষের বিশ্বাস, ভোটাধিকার ও নিরাপদ নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হলো একমাত্র এই রায়ের মাধ্যমে। এই রায় আওয়ামী লীগের জন্য ছিল রাজকীয় উপহার, আর খায়রুল হকের জন্য রাজনৈতিক আনুগত্যের নিঃশর্ত প্রমাণপত্র। দেশের ইতিহাসে এমন কোনো ‘রায়ে’র কথা স্মরণ করা কঠিন, যেটা দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্যকে এমনভাবে একতরফা করে দিয়েছিল।
খায়রুল হক দেশের সবচেয়ে স্পর্শকাতর রাজনৈতিক ইস্যু, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেন যখন জনগণের আস্থা এই ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল ছিল। ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে বিচারপতি খায়রুল হক শুধু একটি রাজনৈতিক পক্ষকে সুবিধা দেননি, বরং গণতন্ত্রের ন্যূনতম ভারসাম্য রক্ষার পথটিও রুদ্ধ করে দিয়েছিলেন। পরিণতিতে দেশের নির্বাচনব্যবস্থা হয়ে ওঠে দলনির্ভর, প্রশ্নবিদ্ধ এবং সহিংস। তবে এটাই তার একমাত্র বিতর্ক নয়।
তার রায়ে উঠে এসেছে এমন সব পর্যবেক্ষণ, যা ইতিহাসকেও মিথ্যা বলার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। তিনি আরেক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত হলো শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়া। শুধু স্বীকৃতি না দেয়া নয়, তার অবদানকে খাটো করে, বিকৃত করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে আদালতের মঞ্চ ব্যবহার করেছেন। তিনি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক স্বীকার না করে, ইতিহাসের ধারাবাহিকতা নাকচ করে দিয়েছেন তিনি।
অথচ এটা দিনের আলোকের মতোই স্পষ্ট চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্পষ্ট কণ্ঠে ‘আমি মেজর জিয়া বলছি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলাম’ বলে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। যার ঘোষণায় দেশের আপামর জনসাধারণ মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। খায়রুল হক তার রাজনৈতিক প্রভুদের সন্তুষ্ট করতেই কি এই বিচারিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন নাকি ইতিহাসকে দলীয় রঙে রাঙানোর উদ্দেশ্যেই এমন রায় দেয়া হয়েছিল সেই প্রশ্ন এখন বাংলাদেশপ্রেমী তরুণ প্রজন্মের মুখে মুখে।
খায়রুল হক এতটাই একপাক্ষিকতায় নিমজ্জিত ছিলেন যিনি একসময় আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হয়েও দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে সক্রিয় ছিলেন। বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার যেই প্রবণতা বাংলাদেশের জন্য সর্বনাশ ডেকে এনেছে, তার সূচনায় এই মানুষটির ভূমিকা অনস্বীকার্য। তার বহু রায় ও মন্তব্য পরবর্তীকালে আইনের শিক্ষার্থীদের কাছেও ‘কেস স্টাডি ফর ব্যাড জাজমেন্ট’ হয়ে আছে।
এই রায় শুধু বিতর্কিত নয়, এটি ছিল সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের বিচারালয়িক মোড়ক। আদালতের রায় হয় আইন ও সংবিধান অনুযায়ী, খায়রুল হকের রায় হয়েছিল আওয়ামী লীগকে চিরস্থায়ী ক্ষমতার সিঁড়ি বানানোর মানসিকতা থেকে। তিনি নিজেকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠা করলেন যেন শেখ হাসিনা যদি আওয়ামী লীগ হন, খায়রুল হক যেন তার চেয়েও বড় একজন আওয়ামী লীগার। এক কথা বলা যেতে পারে- ‘মোর ক্যাথলিক দ্যান পোপ’।
ইতিহাসের রক্তঝরা অধ্যায়গুলোকে গুঁড়িয়ে দিয়ে যেভাবে তিনি আওয়ামী লীগের বক্তব্যের সাথে শব্দ মিলিয়ে রায় দিয়েছিলেন, তা এক ভয়ঙ্কর উদাহরণ হয়ে থাকবে, একজন বিচারপতি কীভাবে সত্যের বিপরীতে দাঁড়িয়ে মিথ্যার পাহারাদার হতে পারেন তার অন্যতম দৃষ্টান্ত এই বিচারপতি খায়রুল হক।
তিনি যতটা না বিচারপতি ছিলেন, তার চেয়েও বেশি ছিলেন সরকারের পৃষ্ঠপোষক। এমনকি আইন কমিশনের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থাতেও দলীয় অবস্থান ছাড়তে পারেননি। তার মুখের বুলি ছিল দলীয় ম্যানিফেস্টো। তিনি যেন আওয়ামী লীগের অঘোষিত মুখপাত্র, যার কথায় না ছিল ভারসাম্য, না ছিল বিচারিক শালীনতা।
খায়রুল হকের আচরণ ছিল এমন যে, মনে হতো তিনি বিচারপতি হিসেবে নয়, আওয়ামী লীগের কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজনৈতিক কমিশনার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। তার কথাবার্তা, রায়, বক্তব্য, সবকিছুর ছাপেই ছিল দলানুরাগ, আর আওয়ামী কর্তৃত্বের প্রতি অন্ধ আনুগত্য। একজন রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারপতির মুখে যখন দলীয় দম্ভ ঝরে পড়ে, তখন সে শুধু নিজের মর্যাদাকেই ছোট করে না, গোটা বিচারব্যবস্থাকেই করে অপমানিত।
তার পুরো বিচারিক জীবন ছিল একেকটি পর্ব, যেখানে ‘বিচার’ ছিল পর্দার পেছনের জাস্টিফিকেশন, আর সামনে চলত রাজনৈতিক হুকুম তামিলের খেলা। সাধারণ মানুষ যখন আদালতের দিকে চেয়ে থাকে ন্যায়বিচারের আশায়, তখন খায়রুল হকের আদালত ছিল ক্ষমতার দরজায় লাইন দেয়া মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মতো কে কাকে খুশি করতে পারে, সেই প্রতিযোগিতা। তিনি প্রমাণ করেছেন, কেউ কেউ গায়ে জজের গাউন পরে হলেও ভেতরে ভেতরে রাজনৈতিক কর্মী হয়েই থেকে যান।
এই মানুষটি এমন এক সময়ে আদালতের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন, যখন জাতিকে সবচেয়ে বেশি নিরপেক্ষতার প্রয়োজন ছিল। সেই সময়ে তার পক্ষপাতদুষ্ট রায় শুধু একটি রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখেনি, বরং গোটা জাতিকে ঠেলে দিয়েছে দীর্ঘ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার দিকে। ফলাফল? নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি জনআস্থার ভাঙন, এবং বিরোধী মতকে রাষ্ট্রশত্রুতে পরিণত করার এক নিষ্ঠুর প্রক্রিয়া, যার সূচনা হয়েছিল বিচারপতির আসন থেকেই।
যারা খায়রুল হককে ‘দক্ষ আইনবিদ’ বলে গর্ব করতেন, আজ তারাই নীরব। কারণ একজন প্রকৃত আইনবিদ ইতিহাসের সাথে যুদ্ধ করে না, বরং সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ায়। কিন্তু খায়রুল হক ইতিহাসকে নিজের ইচ্ছেমতো বাঁকাতে গিয়ে প্রমাণ করেছেন, ক্ষমতার প্রতি আনুগত্য থাকলে মেরুদণ্ড কত সহজে বিক্রি করা যায়। আজ তিনি কাঠগড়ায়, কাল তিনি সাজাপ্রাপ্ত হতে পারেন, কিন্তু তার সবচেয়ে বড় সাজা হচ্ছে ইতিহাসে একজন বিকৃত ন্যায়ের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাওয়া।
এবিএম খায়রুল হক এতটাই আত্মবিশ্বাসে ভোগ করতেন, মনে হতো আইন, সংবিধান, বিচার, সবই তার হাতের খেলনা। আজ সেই ‘সর্বশক্তিমান’ খায়রুল হক গ্রেপ্তার। যিনি এক সময় আদালতের আসনে বসে দেশবাসীর ভবিষ্যৎ ও মানুষের নিয়তি নির্ধারণ করতেন, তিনিই আজ আসামির কাঠগড়ায়। জনগণের বহুদিনের প্রশ্ন ছিল, তিনি কি কখনো তার বিতর্কিত ভূমিকার জবাব দেবেন? শেষ পর্যন্ত সেই উত্তর এসেছে হাতকড়ায়। ইতিহাস চুপ করে বসে ছিল, কিন্তু সময় তার জবাব দিয়ে দিলো।
এবিএম খায়রুল হকের বিরুদ্ধে শুধু বিচারিক পক্ষপাতের অভিযোগই নয়, সরাসরি আর্থিক দুর্নীতিরও গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। তিনি বিচারপতির পদ ছাড়ার পর আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হয়ে যেসব বিদেশ সফর ও প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়েছিল, তার বেশিরভাগই ছিল লোকদেখানো, উদ্দেশ্য ছিল বিদেশি ভাতা ও টাকার অপব্যবহার। তদন্ত প্রতিবেদনে এসেছে, একাধিক ভুয়া কর্মশালা ও ভ্রমণ বিল তৈরি করে তিনি রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। প্রধান বিচারপতি থাকাকালে চিকিৎসার কথা বলে শেখ হাসিনার ত্রাণ তহবিলের টাকা গ্রহণ করেন। তার দুর্নীতির এ দৃষ্টান্ত শুধু নিন্দনীয় নয়, এটি বিচারবিভাগের নামেও কলঙ্ক।
খায়রুল হকের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের নেপথ্যের কারিগরও বলা হয়। যেসব বইকে স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান লেখা আছে তিনি সেসব বইকে বাজেয়াপ্তও করেন। এই গ্রেপ্তার কেবল একটি ব্যক্তির নয়, এটি একটি ধূর্ত, দলবাজ, বিকৃত বিচারব্যবস্থার মুখোশ উন্মোচন। আজ এই ব্যক্তি যদি বিচারের সম্মুখীন হন, তবে সেটি কেবল একটি প্রজন্মের প্রতিশোধ নয়, এটি একটি জাতির ন্যায্য হিসাব চাওয়ার সময়।
এবিএম খায়রুল হক নিজেকে যতটা বিচারের ধারক ভাবতেন, ইতিহাস আজ তাকে ততটাই কলঙ্কিত রূপে চিহ্নিত করছে। সময় এসেছে বলতে, বিচারপতির আসনে বসে দলের দালালি করে যিনি দেশের গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করেছেন, তার স্থান ইতিহাসের জঞ্জালে। শেখ হাসিনার দলীয় অনুগত হিসেবে তিনি সফল হতে পারেন, কিন্তু বিচারপতি হিসেবে? ইতিহাস তাকে কলঙ্কের মুখে রাখবে, এবং এই কলঙ্ক কোনো আইনি পদমর্যাদায় ধুয়ে মুছে ফেলা যাবে না।
বিচারব্যবস্থায় পক্ষপাত এক ভয়ঙ্কর ব্যাধি। আর সেই ব্যাধিকে যদি প্রধান বিচারপতি পর্যায়েই ধারণ করেন কেউ, তবে তা শুধু একটি সরকারের নয়, পুরো প্রজন্মের বিশ্বাসকে ধ্বংস করে দেয়। এবিএম খায়রুল হক তার কর্মকাণ্ড দিয়ে বিচারপতিত্বের আসনকে যেমন কলুষিত করেছেন, তেমনি দেশের বিচারব্যবস্থাকে বানিয়েছেন রাজনৈতিক একপক্ষের খেলাঘর। শেষ কথায় এটা বলা যায়, হাসিনার মতো একজন স্বৈরাচাররের বিদায়ের জন্য তার ‘অবদান’ স্মরণীয়। কারণ তিনিই হাসিনাকে স্বৈরাচার করে তুলেছেন। আর স্বৈরাচারী হওয়ার কারণেই হাসিনার বিদায় হয়েছে লজ্জাজনকভাবে।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট, লন্ডন, যুক্তরাজ্য
Comments