Image description

রাজধানীর উত্তরা, যেখানে প্রতিদিন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিশুরা আসে ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনতে, সেই চেনা প্রাঙ্গণ ২১ জুলাই বেলা সোয়া একটায় হঠাৎ এক মর্মান্তিক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান আকস্মিকভাবে আছড়ে পড়ে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর। এই ভয়াবহ ঘটনায় অন্তত ৩৫টি শিশুর জীবন স্বপ্নযাত্রা থেমে যায়। দুই শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন, যাদের অনেকেই এখনো হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন।

এই হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনার পর উন্মোচিত হয়েছে আরও এক নির্মম সত্য—বিধ্বস্ত বিমানের ছিল না কোনো বিমা। বিমার আওতায় ছিল না স্কুলটিও, ছিল না শিক্ষক-শিক্ষার্থী কিংবা প্রতিষ্ঠানটির সম্পদের কোনো সুরক্ষাও। একমাত্র বিমানের পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম ছিলেন রাষ্ট্রায়ত্ত সাধারণ বীমা করপোরেশনের (এসবিসি) ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা বিমা কাভারেজের আওতায়। সেই বিমার ১২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ তাঁর পরিবারের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এসবিসির জেনারেল ম্যানেজার (পুনর্বিমা বিভাগ) এস এম শাহ আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে প্রশিক্ষণ বিমানের বিমা করা হয় না। তবে বাহিনীর সদস্যদের জন্য আলাদা ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা বিমা পলিসি থাকে। তৌকির ইসলামের ক্ষেত্রে সেই বিমার আওতায় ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে।’ এসবিসির জিএম বলেন, অতিমাত্রায় ঝুঁকি এবং গোপনীয়তা রক্ষায় যুদ্ধ বিমানের বিমা করা হয় না।

শাহ আলম আরও জানান, তৌকিরের পরিবার আবেদন করলেই দ্রুত পরিশোধ সম্পন্ন হবে। তবে নিহত শিক্ষার্থী, শিক্ষক কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত স্কুলের বিষয়ে এসবিসি কোনো দায়িত্ব নিচ্ছে না। তাঁর ভাষায়, ‘আমাদের সঙ্গে তাদের কোনো বিমা চুক্তি নেই। ব্যক্তিগতভাবে কেউ বিমা করে থাকলে তা আলাদাভাবে প্রমাণ করতে হবে।’

মাইলস্টোন কর্তৃপক্ষও স্বীকার করেছে, তাদের কোনো সম্পত্তি, শিক্ষক বা শিক্ষার্থীর জন্য বিমা ছিল না। কলেজের জনসংযোগ কর্মকর্তা শাহ বুলবুল এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বাংলাদেশে এখনো কোনো স্কুল বা কলেজ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য গ্রুপ বিমা করে না। আমাদের প্রতিষ্ঠানেও এমন কিছু করা হয়নি।’

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) মিডিয়া পরামর্শক সাইফুন্নাহার সুমি বলেন, ‘আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি, দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের কেউ বিমার আওতায় ছিলেন না। যদি থাকতেন, তাহলে ক্ষতিপূরণ মিলত।’

আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, বিমানবাহিনীর একটি এফ-৭ বিজেআই মডেলের প্রশিক্ষণ বিমান ওইদিন বেলা ১টা ৬ মিনিটে উড্ডয়ন করে এবং কিছুক্ষণের মধ্যে মাইলস্টোন স্কুলে বিধ্বস্ত হয়। দুর্ঘটনার সময় স্কুলে ক্লাস চলছিল পুরোদমে। দোতলা ভবনের ছাদ, দেয়াল, সিঁড়ি—সবকিছু ভেঙে পড়ে। নিচতলায় ছিল তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ক্লাস, ওপরে দ্বিতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির কক্ষ। কাছেই অধ্যক্ষের কক্ষ এবং একটি কোচিং সেন্টার। ভবনের বড় অংশই ধসে পড়ে ভয়াবহ রূপ নেয় দুর্ঘটনাটি।

ফায়ার সার্ভিস ও বিভিন্ন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত ৩১ জনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করা গেছে। আহত হয়েছে দুই শতাধিক মানুষ, যাদের মধ্যে ১৬৪ জন রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

এই বিপর্যয়ের পর প্রশ্ন উঠেছে, রাষ্ট্রীয় প্রস্তুতি কি এতটাই দুর্বল যে শত শত শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মচারী কোনো ঝুঁকির নিরাপত্তা ছাড়া একটি জনবহুল ভবনে প্রতিদিন সময় কাটাচ্ছেন? একটি যুদ্ধবিমান নগর আকাশে ওড়ানো হবে, সেটি যদি নিয়ন্ত্রণ হারায়, তাহলে তার পতনের দায় শুধুই কি ‘বিমা ছিল না’ বলে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব?

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিমাকাঠামোর এই ভয়াবহ শূন্যতা শুধু একটি নীতিগত ব্যর্থতা নয়, এটি একটি রাষ্ট্রীয় অবহেলার প্রতীক। যখন পাইলটের জন্য নির্ধারিত আর্থিক সুরক্ষা থাকে, তখন কেন শিশুদের জীবনের জন্য কোনো প্রস্তুতি থাকে না?

এই দুর্ঘটনা শুধু একটি যুদ্ধবিমান পতনের গল্প নয়। এটি আমাদের বিমা-সংস্কৃতির সংকট, ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়ে রাষ্ট্রের নীরবতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক উদাসীনতার নগ্ন প্রদর্শন। প্রশ্ন উঠেছে, আগামীতে কি কিছু পাল্টাবে? নাকি এই মৃত্যুর মিছিলও হারিয়ে যাবে আরেকটি ‘দুর্ঘটনার’ স্তূপে—এমন প্রশ্ন বিশেষজ্ঞদের।

তাঁরা বলেন, এখনই সময় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বাধ্যতামূলক বিমা কাভারেজের আওতায় আনার, বিশেষত শহুরে জনবহুল এলাকায়। তা না হলে আরেকটি মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি হয়তো সময়ের অপেক্ষা মাত্র।