Image description

হঠাৎ করে নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারের আলোচনা বেশ জমেছে। বিস্ময়করভাবে মধ্য ও ছোট দলগুলোর বেশ টান আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন বা পিআর পদ্ধতির দিকে। জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, সিপিবি, ইসলামী আন্দোলন এ পদ্ধতির প্রতি প্রায় একাট্টা। এর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান দেশের প্রধান দল বিএনপির।  তারা চায় প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতিতেই নির্বাচন। 

পিআর বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে মুক্ত, গোপন ও মিশ্র তিনটি আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা রয়েছে বিশ্বের কিছু দেশে। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর হচ্ছে নির্বাচনী ব্যবস্থার এমন একটি পদ্ধতি যেখানে আসন বণ্টন হয় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে। কোনো দল মোট প্রদত্ত ভোটের শতকরা ১০ শতাংশ পেলে সেই দল আনুপাতিক হারে সংসদের ১০ শতাংশ বা ৩০টি আসন পাবেন। এর পক্ষে যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে, এ পদ্ধতিতে একটি নির্বাচনে দেয়া প্রত্যেকটি ভোট কাজে লাগে এবং প্রতিটি ভোট সংসদে সমানভাবে প্রতিনিধিত্ব করে। 

তাছাড়া একটি নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা ও হারের ভিত্তিতে সংসদে আসন বণ্টন হয়। তাই সব ভোটারদের মতামতের প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব এই পদ্ধতিতে ভোটের মাধ্যমে। কারণ অনেক সময় খুব সামান্য পার্থক্য থাকলেও অনেক দল সংসদে একটি আসনও পায় না। কিন্তু এই পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে তাতে ন্যূনতম ভোট পেলে সব রাজনৈতিক দলেরই প্রতিনিধিত্ব থাকার সুযোগ রয়েছে সংসদে। বাংলাদেশে নির্বাচন হয় ৩০০টি আসনে আলাদা আলাদা প্রার্থী দিয়ে। 

যে পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনে একটি আসনে মোট চারজন প্রার্থী চারটি দল নির্বাচন করলে দেখা গেল ভোট পড়েছে ৮৫ শতাংশ। এর মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তিনজন প্রার্থীই ২০ শতাংশ করে ভোট পেল। আর চতুর্থ প্রার্থী পেল ২৫ শতাংশ ভোট। প্রচলিত পদ্ধতি অনুযায়ী চতুর্থ প্রার্থীই এই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন। আর ওই তিনটি দলের ৬০ শতাংশ ভোট তেমন কোনো কাজে আসছে না। 

একইভাবে সারাদেশের অন্তত ২৯০ আসনে যদি একই হারে ভোট পেয়ে চতুর্থ দলটির প্রার্থীরা জয়লাভ করে, তাহলে মাত্র ২৫ শতাংশ ভোট নিয়ে তারা সরকার গঠনসহ সংসদে একচ্ছত্রভাবে আধিপত্য করবে। বাকি তিন দল মিলে ৬০ শতাংশ ভোট পেলেও তাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব থাকলো না সংসদে। প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে পদ্ধতি হিসেবে এটি আলোচনা হিসেবে চমৎকার।

কিন্তু, বাস্তব এবং অভ্যস্ততার সঙ্গে বেমানান। এবারের পট পরিবর্তনের পর নির্বাচন ব্যবস্থাসহ রাষ্ট্র ব্যবস্থা সংস্কারে বিভিন্ন কমিশন গঠন করা হয়েছে। সেখানেই ছোট দলগুলোর ইউনিটিতে গুরুত্ব পেয়ে বসেছে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন বা পিআর পদ্ধতির বিষয়টি। তারা এরইমধ্যে রাজনীতির ময়দানে এটিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে পেরেছে। 

সুশীল সমাজের কিছু প্রতিনিধিও এতে সমর্থন জোগাচ্ছেন। দীর্ঘদিন রাজতন্ত্রের পতনের পর নেপালে এই পদ্ধতি চালুর উদাহরণ টেনে তারা বলতে চান, দীর্ঘমেয়াদি স্বৈরশাসন বা একনায়কতন্ত্র রোধে সমাধান হতে পারে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা। এ ধরনের যুক্তি ও রহস্য বুঝতে পেরে বিএনপি এই পদ্ধতির বিরোধিতা করে প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে। বিএনপির মতো একটি বড় দলের আপত্তিতে এই পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব কী না সেটি নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে। 

বিএনপি শুরু থেকেই বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থাকে সমর্থন করে আসছে জাতীয় নির্বাচনে। আগেও মাঝেমধ্যে এই প্রস্তাব এসেছিল। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো বড় দুটি দল না চাওয়ায় পদ্ধতিটি চালু হয়নি। আর এ পদ্ধতিতে মূলত ব্যক্তিকে নয়, ভোট দিতে হবে দলকে। পদ্ধতিটি চালু হলে দেশে নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, তা আর থাকবে না। 

ভোটাররাও দলের বাইরে কাউকে ভোট দেয়ার সুযোগ পাবেন না। দেশের আগের সব সংসদ নির্বাচনেই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন এবং নির্বাচনে জয়ী হয়ে জাতীয় সংসদে আসন লাভ করেন। সংসদ নির্বাচনগুলোর মধ্যে প্রথমটিতে পাঁচজন, দ্বিতীয়টিতে ১৬ জন, তৃতীয়টিতে ৩২ জন, চতুর্থটিতে ২৫ জন, পঞ্চমে তিনজন, ষষ্ঠতে ১০ জন, সপ্তমে একজন, অষ্টমে ছয়জন এবং নবমে চারজন স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচিত হন। বিতর্কিত দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও অনেক স্বতন্ত্রপ্রার্থী অংশ নেন।

দলে অন্যায় অবমূল্যায়নের শিকার হয়েও অতীতে অনেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে লড়েছেন এবং বিজয়ীও হয়েছেন। কিন্তু পিআর পদ্ধতি চালু হলে সে সুযোগ থাকবে না। এ পদ্ধতিতে কিছু মন্দ দিকের কথাও রয়েছে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে। নেতিবাচক দিক সম্পর্কে বলা হয়েছে যে এর ‘একটি বড় দুর্বলতা হলো সরকারের সম্ভাব্য অস্থিতিশীলতা’। 

বাংলাদেশের তুলনামূলকভাবে কম বিতর্কিত পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম ও নবম সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর ভোট প্রাপ্তির হার এবং সে অনুসারে পিআর পদ্ধতিতে বণ্টনযোগ্য আসনসংখ্যা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হলে উল্লিখিত চারটি নির্বাচনে যেহেতু কোনো দলের পক্ষেই এককভাবে সরকার গঠন করা সম্ভব হতো না, তাই বড় দলগুলো ক্ষুদ্র দলগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে যেতে পারত এবং ‘টিরানি অব দ্য স্মল মাইনরিটি’ বা ছোটদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেতে পারত। এ ছাড়া সরকার গঠনে ভাঙাগড়ার খেলা প্রকট হয়ে উঠতে পারত। এমনকি সরকার গঠনে লেনদেনের প্রভাবও ঘটতে পারত। এ ছাড়া সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে দলের আধিপত্য বেসামাল পর্যায়ে পৌঁছতে পারে।’ 

‘ছোটদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা’র নেতিবাচক উদাহরণ হিসেবে ইসরায়েলের কথা উল্লেখ করে কমিশনের প্রতিবেদনের ফুটনোটে বলা হয়েছে, ‘এ প্রসঙ্গে গাজায় ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যকার চলমান যুদ্ধের উদাহরণ টানা যেতে পারে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, গাজায় যুদ্ধ এত প্রলম্বিত হওয়ার একটি বড় কারণ হলো আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের কারণে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু কিছু অতি ক্ষুদ্র উগ্র ধর্মান্ধ দলের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছিলেন।’

প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়েছে, ‘সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির আরো অনেক দুর্বলতা রয়েছে, যা অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় উঠে এসেছে। মতবিনিময়ের সময় একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ করা গেছে, অনেক ব্যক্তি ও দল যারা নীতিগতভাবে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির পক্ষে, তাদের অনেকেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটির প্রবর্তনের বিপক্ষে। তাদের আশঙ্কা, বর্তমান সময়ে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি গৃহীত হলে বিতাড়িত স্বৈরাচারের পুনর্বাসনের আশঙ্কা দেখা দেবে। 

প্রতিবেদনে সংস্কার কমিশন সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির সমস্যা হিসেবে আরো উল্লেখ করেছে, ‘সংসদের আসনসংখ্যা ভাগ হয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভোটপ্রাপ্তির অনুপাতের হারে। এ ব্যবস্থায় ভোটাররা ভোট প্রদান করেন রাজনৈতিক দলকে, কোনো নির্দিষ্ট প্রার্থীকে নয় এবং রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত আসনসংখ্যা নির্ভর করে দলের প্রাপ্ত ভোটের হারের ওপর। তবে কোনো আসন পেতে হলে দলকে ন্যূনতম হারের ভোট পেতে হয়। 

উদাহরণস্বরূপ, কোনো দল যদি সারা দেশে মোট প্রদত্ত ভোটের ৫ শতাংশ ভোট পায়, তাহলে সেই দল সংসদের মোট আসনের ৫ শতাংশ আসন পাবে। প্রসঙ্গত, সংসদীয় আসনের ভাগ পাওয়ার মানদণ্ড যদি ন্যূনতম ৫ শতাংশ হলে আমাদের দেশের ছোট ছোট দলগুলোর, যাদের প্রায় সবারই ভোটপ্রাপ্তির হার ৫ শতাংশের কম, তারা কোনো আসন পাবে না।’ প্রতিবেদনে পদ্ধতিটির ভালো-মন্দ উভয় দিক উল্লেখ করে এ সম্পর্কে কোনো সুপারিশ করা থেকে বিরত থাকাই উত্তম মনে করেছে কমিশন।

জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল, ফিনল্যান্ড, ইসরায়েল, ইন্দোনেশিয়া, বেলজিয়াম, ডেনমার্কের মতো বিশ্বের প্রায় ৮৫টিরও বেশি দেশে বর্তমানে সংখ্যানুপা?তিক নির্বাচনী পদ্ধতি চালু রয়েছে। নানা ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রথাগত এবং পিআর দুটি পদ্ধতিই বলতে গেলে ‘মিক্সড ব্লেসিং’ বা মিশ্র আশীর্বাদ। 

এ বিবেচনায় অনেক দেশেই এখন মিশ্র পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকে। মিশ্র পদ্ধতিতে সংসদের একাংশ এফপিটিপি পদ্ধতিতে, আরেকাংশ সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়ে থাকে। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিও বহু রকমের হয়ে থাকে। এ ছাড়া সংসদের দুই কক্ষে দুই ধরনের পদ্ধতিও থাকতে পারে। কমিশনের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ‘এমনি প্রেক্ষাপটে অংশীজনের পক্ষ থেকে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি প্রচলনের পক্ষে-বিপক্ষে দাবি উঠেছে। তবে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় অনেক অংশীজন একটি মিশ্র পদ্ধতি ব্যবহারের সুপারিশ করেছে। অনেকে আবার সংসদে উচ্চকক্ষ স্থাপিত হলে সেখানে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি প্রচলনের দাবি তুলেছে। 

তবে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চরম মতবিরোধ রয়েছে।’ সামগ্রিক বিবেচনায় পিআর নিয়ে কেউ উৎসাহী, কেউ শঙ্কিত, কেউবা দ্বিধাগ্রস্ত। কিন্তু রাস্তাঘাট থেকে সোশ্যাল মিডিয়া- সবখানে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে: আদর্শের পথে হেঁটে কি সত্যিই বদলাবে বাংলাদেশের রাজনীতি, নাকি আবারও পুরনো কৌশলের ফাঁদেই বন্দি থাকবে ভোটের ভাগ্য? পিআর পদ্ধতির পক্ষে-বিপক্ষে চলমান এ আলোচনা কি কেবল মঞ্চের গর্জনেই থাকবে, না কি নতুন সমীকরণে কোনো নতুন রাজনৈতিক যুগের সূচনা করবে- এ অপেক্ষা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে?

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট