Image description

নীলফামারীর সৈয়দপুর বিহারী অধ্যুষিত জনপদ হওয়ায় প্রতি বছর অত্যন্ত জাঁকজমকভাবে এখানে পালিত হয়ে থাকে পবিত্র আশুরার সকল আনুষ্ঠানিকতা। পবিত্র আশুরার দিনটি মুসলিম উম্মাহর কাছে শোক ও ত্যাগের দিন হিসাবে পরিচিত হলেও সৈয়দপুরে আশুরা পালনে শিয়া ও সুন্নী সম্প্রদায়ের একটি অংশ আলাদা আলাদাভাবে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে তাদের তরিকানুযায়ী পালন করে থাকেন পবিত্র আশুরা। তাই মহররম মাসে এক অন্যরকম শহরে রুপান্ত্রিত হয় গোটা সৈয়দপুর। এর আনুষ্ঠানিকতার জন্য সারা দেশে নীলফমারীর সৈয়দপুরের নাম ছড়িয়ে পড়েছে। যা দেখার জন্য আশপাশের জেলা শহর থেকেও মানুষজন আসেন এখানে।

মহররম মাসের চাঁদ দেখার সাথে সাথে শুরু হয়ে যায় এর আনুষ্ঠানিকতা। শহরে ৫০ টিরও অধিক ইমামবাড়া থাকায় অনেকটা তখন তাজিয়ার শহরে রুপান্ত্রিত হয় গোটা সৈয়দপুর। শহরের বিভিন্ন ইমামবাড়ায় তৈরি করা হয় বড় বড় তোরণ। রঙ্গীন কাপড়ে বানানো তোরণের গায়ে জ্বলে হরেক রং এর বাতি। তাজিয়া নির্মাণে ব্যস্ত সময় পার করেন কারিগররা। 

গত ৩৪ বছর ধরে তাজিয়া নির্মাণ করে আসছেন এখানকার তাজিয়া শিল্পী আইনুল হক। তিনি জানান, মূলত ইমাম হোসেন (রাঃ) এর মাজারকে স্মরণে রেখে তা নির্মাণ করা হয়।

মহররম কমিটির অন্যতম শাহিদ চিশতী জানান, বিশ্বনবী (সাঃ)  দৌহিত্র ইমাম হোসাইনের মহব্বতে এ পাইকওয়ালারা তিন দিন ইমাম হোসেনের প্রতিকী দুলদুল সেজে মানত করে থাকেন। চাঁদ ওঠার সাথে সাথে এ প্রতিকী কারবালার মাটি নিয়ে প্রতি ইমামবাড়ায় দেওয়া হয়। পরে শেষ দিনে এ কারবালায় এসে পাইক খুলে ও নিয়ে যাওয়া মাটি ফেরত এনে এর আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়। মহররম উদ্যাপনে ব্যতিক্রম সৈয়দপুরে বিভিন্ন মহল্লার প্রতিটি ইমামবাড়ায় তাজিয়া বানানো হয়। আলোকসজ্জার পাশাপাশি তালে তালে বাজানো হয় ঢোল। আর এই ঢোলের শব্দে রাতের সৈয়দপুরে বিরাজ করে এক নির্ঘুম আবহ।

সুন্নী সম্প্রদায়ের একটি অংশ এভাবে শহরের বিভিন্নস্থানে নির্মাণ করেন বড় বড় তোরণ। ঈমামবাড়াগুলোতে ইমাম হোসেনের মাজারকে স্মরণ করে তৈরি করা হয় তাজিয়া। সেখানে মানতের পাশাপাশি চলে ফাতেহা পাঠ।

শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোয় চলে ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলা, তলোয়ার ও আগুনের বিভিন্ন ধরনের খেলা। একই সঙ্গে মুখে উচ্চারিত হয় ‘ইয়া হোসেন, ইয়া হোসেন’। কেউবা অঝোর নয়নে কাঁদেন আর ইমাম হোসেনের স্মরণে মাতম গীত গেয়ে থাকেন। প্রতি ইমামবাড়ায় সারারাত ঢোল বাজনা, তাজিয়া মিছিল, লাঠি খেলা, ইমাম হোসেনের ঘোড়ার প্রতিকৃতি হিসাবে মানত করে পাইকবাধা, ইমামবাড়ায় ফাতেহা পাঠ, নিশান চড়ানো হয়ে থাকে। 

আরবি মাসের ৯ তারিখে রাত ১১ টার দিকে ইমামবাড়ায় বসানো হয় তাজিয়া। এবং মহররম মাসের ১০ তারিখ পর্যন্ত দলবেধে প্রত্যেক ইমামবাড়ায় ইয়া হোসাইন ইয়া হোসাইন বলে কাসিদা পাঠ করেন থাকেন পাইকওয়ালারা। শহরের অনেক জায়গায় বসে মেলা আবার বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় কাসিদা পাঠের জন্য ঝর্না আসরও বসে। সব মিলে মহররম মাসের আনুষ্ঠানিকতা পালনে সৈয়দপুর পেয়ে আসছে এক আলাদা পরিচিতি। এবং এসব আনুষ্ঠানিকতা দেখতে আশপাশের শহর থেকে প্রতি বছর ছুটে আসেন প্রচুর মানুষ।

ইমামবাড়ায় মানত করতে দলবেধে আসা মানুষদের মধ্যে অনেক হিন্দুকেও মানত করে ইমামবাড়ায় ফাতেহা দিতে দেখা যায় যা অসম্প্রদায়িকতার এক নিদর্শন বহন করে বটে। শহরের রসুলপুর ইমামবাড়ায় ফাতেহা দিতে আসা অমুসলিম গীতা রানী বলেন, ইমাম হোসেনের আদর্শ আমরাও লালন করি, উনাকে মানি, মূলত তিনি সবার। তাই প্রতি বছর এখানে ইমাম হোসেনের নামে ফাতেহা দিতে আসি।

সৈয়দপুর হাতিখানায় অবস্থিত কেন্দ্রীয় প্রতীকী কারবালার আয়োজক কমিটির সদস্য ফিরোজ জানান, মহরমের ১ম তারিখ থেকে শুরু হয়ে যায় এর আনুষ্ঠানিতা। প্রতিটি ইমামবাড়া ধোয়া মোছা করা হয়। আবার মহররমের ৭ তারিখে কারবলা থেকে কিছু মাটি শহরের প্রতিটি ইমামবাড়ায় নিয়ে যান সেখানকার খলিফারা। বিশেষ নিয়ম অনুযায়ী সে মাটি একটি পাত্রে করে তাজিয়ার নিচে সংরক্ষিত রাখা হয়। এরপর তাজিয়াকে কেন্দ্র করে চলে অন্যান্য রীতিনীতি পালন। 

তিনি আরও জানান, ‘শহর জুড়েই দর্শনার্থীদের ভিড় থাকে। তারা দেখতে আসেন, দোয়া পড়েন, ভক্তি করেন। মহরমের ১০ তারিখ অর্থাৎ আশুরার দিন মাটি যেখান থেকে আনা হয়েছিল সেখানেই রেখে আসা হয়। সে মাটি রাখার জন্যও যেতে হয় শোকাবহ মিছিল সহকারে। কারও কারও শরীর রঙিন রশি, জরির ফিতা এবং ছোট ছোট ঘুণ্টির মালা দিয়ে পেঁচানো। প্রত্যেকের মাথা সাদা ও সবুজ কাপড়ের টুকরো দিয়ে ঢাকা। হাতে লাল সবুজ আর সাদা রংয়ের পতাকা। হাজার হাজার লোকের মিছিলে কারবলায় (সৈয়দপুর শহরে) তিল ধরনের জায়গা থাকে না। পরে শেষ মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হয় সুন্নী সম্প্রদায়ের একটি অংশের এ আনুষ্ঠানিকতা।

এদিকে শিয়া সম্প্রদায় সৈয়দপুরে তাদের মার্কাজ পাবর্তীপুর রোডে অবস্থিত শিয়া মসজিদ থেকে বের করে থাকে শোক শোভাযাত্রা। মাতম করে হায় হুসাইন হায় হুসাইন বলে তাদের এই শোক মিছিলে অংশগ্রহন করেন সৈয়দপুরের বিভিন্ন শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন সহ নীলফামারী, রংপুর, দিনাজপুরের শিয়া সম্প্রদায় লোকেরা। তাদের সাথে যোগ দেন বিভিন্ন সম্প্রদায়ে মানুষ। শোক মিছিলে নওহা, কাসিদা, মর্সিয়া, শোকগাথা ও ইমাম হোসাইনের জীবনী পাঠ সহ এসময় কালেমা খচিত বিভিন্ন পতাকা বহন করে শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা। 

সৈয়দপুর শিয়া সম্প্রদায়ের নেতা ও সৈয়দপুর শিয়া মসজিদ আঞ্জুমানে আব্বাসীয়ার সেক্রেটারী সৈয়দ শাহিদ হোসেন রেজভী জানান, প্রতি বছর এ কেন্দ্রীয় মসজিদে মাতমে রংপুর বিভাগের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিয়া সম্প্রদায় যোগ দেন। বিশাল এ শোক শোভাযাত্রাটি দেখতে পার্বতীপুর রোডে জমায়েত হন শহরের অনেক মানুষ। 

কথা হয় শহরের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রইচ উদ্দিনের সাথে। তিনি জানান, মহররমের আনুষ্ঠানিকতা পালনে সৈয়দপুরের এক আলাদা পরিচিতি রয়েছে। এই আনুষ্ঠানিকতা দেখতে বিভিন্ন উপজেলা শহর থেকে শত শত মানুষ আসেন আমাদের সৈয়দপুর। আমরা প্রতিটি সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি পালনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

এদিকে পুরো আনুষ্ঠানিকতাকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে নেওয়া হয় কঠোর নিরাপত্তা। শহরের ৫০টির অধিক ইমামবাড়ায় মোতায়েন করা হয় পুলিশ। 

সৈয়দপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ফইম উদ্দিন জানান, সৈয়দপুরে মহররমের আনুষ্ঠানিকতা যাতে সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন হয় সে জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেওয়া হয় সার্বিক ব্যবস্থা। পুরো কারবালার মাঠকে নিরাত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়া হয়। পাশাপাাশি শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে মোতায়েন থাকে পুলিশ। পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব-১৩ এর পক্ষ থেকে টহল ব্যবস্থা করা হয় জোরদার।