
অন্তর্বর্তী সরকারের নিকট প্রত্যাশা ছিল নিরাপদ জীবন বিধানে কঠোর হবে। কিন্তু কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না অপরাধ, কাটছে না আশঙ্কা। সামাজিক অস্থিরতার কারণে মানুষ সংঘর্ষে জড়িয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। হত্যার তালিকা দীর্ঘ হলেও আইনি ব্যবস্থার তৎপরতা চোখে পড়ছে না। দুঃখজনক হলেও সত্য- বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে দেশে ক্রমেই বাড়ছে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। রাজধানীসহ সারা দেশে বাড়ছে খুন, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতির মতো ঘটনা। এতে নতুন করে আতঙ্কিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
এরই মধ্যে হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ডাকাতির ঘটনায় জনমনে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজধানীর মগবাজারে দিন-দুপুরে চাপাতি দিয়ে এক যুবকের কাছ থেকে ছিনতাইয়ের ঘটনা। এ ছাড়া ফিল্মি স্টাইলে রাজধানীর বাড্ডায় হত্যা করা হয়েছে বিএনপির এক নেতাকে। ঘটনা দুটির ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার পর রাজধানীসহ সারা দেশে আতঙ্কের মাত্রা আরেক দফা বাড়ল।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী গত এপ্রিল মাসে শুধু রাজধানীতেই ১৭টি ভয়াবহ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ সদর দপ্তরের মতে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে খুনের ৩০০টি ঘটনা ঘটেছে। গত মার্চ মাসে ৩১৬টি এবং গত এপ্রিল মাসে তা বেড়ে ৩৩৬টিতে দাঁড়িয়েছে। তবে ডাকাতির ক্ষেত্রে গত ফেব্রুয়ারিতে ৭৪টি, মার্চ মাসে ৬০টি এবং গত এপ্রিল মাসে ৪৬টি ঘটনা ঘটেছে। এ পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এই অবনতির নেপথ্যে ইন্ধন জোগাচ্ছে কারা- এমন প্রশ্নও চলে আসে?
তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীতে কর্মরতদের বেশির ভাগই আওয়ামী শাসনামলে নিয়োগপ্রাপ্ত। এখানেই প্রশ্ন ও আশঙ্কা চলে আসে। ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থানে দেশে পটপরিবর্তন হলেও তারা ঘাপটি মেরে থেকে নেপথ্যে ইন্ধন জোগাচ্ছে কীভাবে সরকারকে বেকায়দায় ফেলা যায়। সম্প্রতি দেশে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় এ বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে।
পুলিশে সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকার যে ‘পুলিশ সংস্কার কমিশন’ গঠন করেছে এরই মধ্যে তারা প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কমিশনের প্রস্তাব কার্যকর হলে পুলিশ বাহিনী অনেকটাই সংশোধন হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। কিন্তু তার অগ্রগতি কতদূর? মানুষ আশায় বাঁচে, তবে নিরাপত্তা কি মিলবে- এমন প্রশ্ন সবার হৃদয়ে। প্রকাশ্যে না বললেও আলোচনা হচ্ছে এমন সব খবর নিয়ে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর, হামলা, ডাকাতি ও প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যার মতো ঘটনাও ঘটেছে। একদিকে সেই রেশ, অন্যদিকে নতুন ঘটনা জনমনে ভয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে আতঙ্কে দিন কাটছে সাধারণ মানুষের। এভাবে কেন মানুষ বারবার আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এসব ঘটনাকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা যাই বলি না কেন- সরকার দায় এড়াতে পারে না। এ ক্ষেত্রে দ্রুত এসব অপকর্ম নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে।
দেশজুড়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড জনমনে আতঙ্ক তৈরি করছে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জানান দিচ্ছে- যা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আইন প্রয়োগে দুর্বলতা, সামাজিক অসাম্য, রাজনৈতিক উত্তেজনা, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং মিথ্যা তথ্যের প্রসারের কারণেই অপরাধকাণ্ড বাড়ছে- যার পরিণতি খুবই ভয়াবহ। বাংলাদেশে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা আগেও দেখা গেছে, কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন।
জনতা দ্বারা নিজ হাতে বিচার, একটি গুরুতর সমস্যা যা অনেক দেশেই দেখা যায়। এটি হলো যখন একটি উত্তেজিত জনতা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপ ছাড়াই কাউকে শাস্তি দেয়। এসব ঘটনা আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ করে এবং সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে, যা জনমনে অস্থিরতা বিরাজ করছে। অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তাদের বড় চ্যালেঞ্জ ছিল দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা, যা এখনও সম্ভব হয়নি।
দুঃখজনক হলেও সত্য- সরকার জননিরাপত্তার জন্য বিকল্প পথ অবলম্বন করেও সামলাতে পারছে না। বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টি গুরুত্বসহকারে আমলে নেয়ার কোনো বিকল্প নেই। জননিরাপত্তায় কঠোর না হলে দেশের মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। দেশের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং দেশের সুনাম রক্ষায় কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে বিচারের প্রতি জনতার আস্থা সৃষ্টি এবং অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। সর্বোপরি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হয়ে- জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
Comments