তিস্তার চরের শ্রমজীবী নারীদের জীবনযুদ্ধ: ৯ ঘণ্টার শ্রম, ৩০০ টাকার মজুরি

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে সূর্য উঁকি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় এক নীরব জীবনযুদ্ধ। তিস্তার বুক চিরে জেগে ওঠা একেকটি চর যেন একেকটি কর্মক্ষেত্র। এখানকার নারীদের জীবন বাঁধা পড়েছে এই চরগুলোর সাথেই। কেউ ঘর সামলে ছুটে যান অন্য চরের জমিতে কাজের সন্ধানে। সকাল সাড়ে আটটা থেকে শুরু হয় তাদের ক্লান্তিহীন কর্মযজ্ঞ, চলে একটানা বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। নয় ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে হাড়ভাঙা খাটুনি, আর এর বিনিময়ে দিনের শেষে জোটে মাত্র ৩০০ টাকা। অথচ একই মাঠে, একই সময়ে, একই ধরনের কাজ করে পুরুষ শ্রমিকরা রোজগার করেন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, যা প্রায় দ্বিগুণ।
মে দিবস প্রতি বছর শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেও, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি এই কৃষি শ্রমিকরা যেন আলোচনার বাইরেই থেকে যান। ভুট্টা তোলা, মরিচ পারা কিংবা মাটির কঠিন কাজ – সব ক্ষেত্রেই পুরুষের পাশাপাশি সমানতালে কাজ করে যান এই নারীরা। কিন্তু তাদের শ্রমের ন্যায্য মূল্য যেন অধরাই থেকে যায়। দিনের শেষে ক্লান্ত শরীর, পোড়া ত্বক আর হাতে গোনা কয়েকটি টাকা – এটাই যেন তাদের দৈনন্দিন জীবনের নির্মম বাস্তবতা।
স্থানীয়দের ভাষ্য, পুরুষদের মতোই পরিশ্রম করেও মজুরির ক্ষেত্রে আকাশ-পাতাল পার্থক্য চোখে পড়ার মতো। কেউ কেউ তো এমনও অভিযোগ করেন যে, কাজের ধরনের অজুহাতে পুরুষদের অতিরিক্ত অর্থ দেওয়া হলেও, নারীরা সেই সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হন।
তিস্তা নদীর বুকে এই উপজেলায় ছোট-বড় প্রায় ৬৩টি চর জেগে রয়েছে। উর্বর এই চরের মাটি কৃষিকাজের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। আর এই মাঠগুলোতে কর্মরত শ্রমিকদের একটি বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছেন নারী শ্রমিকরা। সরেজমিনে বেলকা ইউনিয়নের বিভিন্ন চর ঘুরে দেখা যায়, ভুট্টা ও মরিচ তোলার ভরা মৌসুমে কর্মব্যস্ততা চোখে পড়ার মতো। এখানকার শ্রমিকদের প্রায় ৯০ শতাংশই নারী। এমনকি মরিচ ও ভুট্টার ক্ষেতে শতভাগ শ্রমিকই নারী। পুরুষ শ্রমিকদের দেখা মেলে কালেভদ্রে, কেবল ভুট্টা ভাঙার মেশিনের কাছে।
কথা হয় ভুট্টা তুলতে ব্যস্ত শরিতন বেগমের সাথে। ক্লান্ত স্বরে তিনি জানান, “আমরা সকাল আটটা সাড়ে আটটার মধ্যে আসি। ভুট্টা তুলি আর বিকেল পাঁচটার পরে ছুটি পাই। আমাগোরে ৩০০ টাকা কামলা দেয়।”
একই চিত্র কুলসুম বেগমের কণ্ঠেও। তিনি বলেন, “এহন ভুট্টা আর মরিচের কাম। পুরুষের সাথে আমরাও ভুট্টা ভাঙি। এই রোদের মধ্যে সারাদিন কাম করি, ৩০০ টাকা পাই। আর ওই যে তিনজন পুরুষ কাম করে, তারা ৬০০ টাকা পায়। একই কাম, একই সময়, অথচ আমরা পাই অর্ধেক দাম।”
জীবনের কঠিন বাস্তবতা ফুটে ওঠে কুলসুমের অসহায় প্রশ্নে, “কি কর্ম (করবো) কন দেহি? না করলে খামু কি? আমরা গরীব মানুষ।”
জমির মালিক তাজুল ইসলামও স্বীকার করেন এই বৈষম্যের কথা। তিনি বলেন, “তিন বিঘা জমিতে ভুট্টা লাগিয়েছি। ফলন ভালো হয়েছে। নারীদের দিয়ে ভুট্টা তোলানো হচ্ছে, কারণ তাদের মজুরি কিছুটা কম। পুরুষদের দ্বিগুণ টাকা দিতে হয়। অথচ নারীরাও সমান কাজ করে।”
সচেতন নাগরিকরা মনে করছেন, এই মজুরি বৈষম্য কেবল অর্থনৈতিক অবিচারই নয়, এটি সমাজের নারীদের প্রতি অবমূল্যায়নেরও প্রতিফলন। তাদের মতে, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে এই নারী শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। প্রশ্ন জাগে, এই অমানবিক শ্রম, এই নীরব কান্না আর কতদিন নীতিনির্ধারকদের কানে পৌঁছাবে না? চরের এই নারীরা শুধু বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম মজুরিই চান না, তারা চান সম্মান, চান তাদের ন্যায্য অধিকার।
এ বিষয়ে নারীমুক্তি কেন্দ্রের গাইবান্ধার সাধারণ সম্পাদক নিলুফার ইয়াসমিন শিল্পী মুঠোফোনে বলেন, “সর্বত্রই নারীদের সাথে বৈষম্যের চিত্র আজও বিদ্যমান। নারী শ্রমিকদের শ্রমের এই বৈষম্য দূর করতে সরকার এবং প্রশাসনকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু কাগজে-কলমে নীতিমালা প্রণয়ন করলেই হবে না, মাঠ পর্যায়ে তার সঠিক বাস্তবায়ন জরুরি।”
উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, এই উপজেলায় প্রায় ৯৮ শতাংশ পরিবারই কৃষির উপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে ৩৮ শতাংশ প্রান্তিক কৃষক, ৩১ শতাংশ ক্ষুদ্র কৃষক, ২০ শতাংশ ভূমিহীন কৃষক, ৯ শতাংশ মাঝারি কৃষক এবং মাত্র ২ শতাংশ বড় কৃষক পরিবার রয়েছে। এই বিপুল সংখ্যক কৃষি নির্ভর জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ নারী শ্রমিক হলেও, তাদের শ্রমের ন্যায্য অধিকার আজও অধরা। তিস্তার চরের এই নারীদের জীবন কবে আলোর মুখ দেখবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
Comments