Image description

গত বছরের জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঠেকাতে নির্বিচারে দমন পীড়ন চালায় শেখ হাসিনা সরকার। এতে সহস্রাধিক মানুষের প্রাণের বিনিময়ে তৈরি হয়েছে নতুন ইতিহাস। ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। এরপর থেকে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ আসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ বিভিন্ন মহল থেকে জোড়ালো দাবি ওঠে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়েও। 

কিন্তু শপথ গ্রহণের ছয়মাস পেরিয়ে গেলেও অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক মতানৈক্য ও কূটনৈতিক চাপে দলটিকে নিষিদ্ধ করতে পারেনি। এরমধ্যে গত শুক্রবার সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসসকে সাক্ষাৎকার দিয়ে সরকারের একজন উপদেষ্টা দাবি করেন, শিগগিরই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হবে। সঙ্গে সঙ্গেই বিষয়টি ‘টক অব দ্যা কান্ট্রি’-তে পরিণত হয়। দলটি নিষিদ্ধের পুরনো দাবি আবারও চাঙ্গা হয়ে ওঠে। কিন্তু সরকার ও রাজনৈতিক মহলে এ নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। সরকারের দুয়েকজন উপদেষ্টা নিষিদ্ধের পক্ষে কথা বলেছেন। তবে তাদের অনেকে আবার এটি করা সমীচীন হবে না বলেও মন্তব্য করছেন। 

এদিকে বৃহত্তম দল বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝেও এ নিয়ে রয়েছে মতানৈক্য। তাদের কেউ বলছেন, আওয়ামী লীগকে আর রাজনীতির মাঠে তারা দেখতে চান না। আবার অনেকে দল নিষিদ্ধ করে দেয়ার পক্ষপাতি নন। এমন প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠছে, আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়টি কি অমীমাংসিতই থেকে যাবে?  

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জার্মানির ডয়চে ভেলে একাডেমি ও বন রাইন-জিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক যোগাযোগবিষয়ক শিক্ষক ড. সাইমুম পারভেজ এ বিষয়ে বলেন, রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়ায় শুধু অপরাধের বিচার নয়, বরং এর সঙ্গে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় জড়িত। আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় শক্তি তার  সাংস্কৃতিক মূলধন। বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের অনেক মহারথী ও মতামত প্রভাবক আওয়ামী লীগের শক্তি। তাই দীর্ঘমেয়াদি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রাম ছাড়া দলটিকে নিষিদ্ধ করলে তা কার্যকরী হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আওয়ামী লীগকে স্বল্পমেয়াদি নিষিদ্ধ করলে কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছানো কঠিন হবে। 

তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে সুষ্ঠু ভোট না হওয়া, জুলাই হত্যাকাণ্ড এবং অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার পলায়ন- এ তিনটি কারণে আওয়ামী লীগের জনসমর্থন কতটুকু কমেছে, তা বোঝা মুশকিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের আচরণ ও বক্তব্যে এ নিয়ে অনুশোচনা লক্ষ্য করা যায় না। যদি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে কোটি মানুষের পরিণতি এর সঙ্গে জড়িত। তাই এ বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত হঠকারিতা নয়, বরং কার্যকর আলোচনা ও চিন্তার মাধ্যমেই হওয়া উচিত।

দ্বিধাদ্বন্ধে সরকার: স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন (এলজিআরডি) ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া গত শুক্রবার বার্তা সংস্থা বাসসকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে বর্তমান সরকার শিগগিরই পদক্ষেপ নেবে। 

তিনি বলেন, প্রথমত এটা অত্যন্ত ইতিবাচক যে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও একধরনের ঐকমত্য তৈরি হচ্ছে। দেশের মানুষ তৎকালীন ক্ষমতাসীন ওই দলের অগণতান্ত্রিক এবং একগুঁয়েমি মনোভাব ও কার্যকলাপ মেনে নিতে পারেনি বলেই ৫ আগস্টের আগে ও পরে তাদের মধ্যে দলটি নিষিদ্ধ করার বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এমন ঐকমত্য তৈরি হলে সরকারের জন্য যেকোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা সহজ হবে।

বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিক খালেদ মহিউদ্দীনের সঙ্গে কথা বলেন অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম। এক প্রশ্নের জবাবে নাহিদ বলেন, আওয়ামী লীগ ফ্যাসিজম ও গণহত্যার সঙ্গে জড়িত। তার বিচার কার্যক্রম এখনও চলছে। দল হিসেবে তাদের রাজনীতি করার অধিকার নেই। 

আওয়ামী লীগ কীভাবে নিষিদ্ধ হবে এমন প্রশ্নের জবাবে নাহিদ বলেন, সরকারের জায়গা থেকে আমরা এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে চাই না। এসব জাতীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর এ বিষয়ে মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। সব রাজনৈতিক দল ঐকমত্য হলেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হবে।

তবে সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা সমীচীন হবে বলে মনে করেন না। জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করে জারি করা প্রজ্ঞাপন বাতিলের পর এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। সেখানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। 

আসিফ নজরুল বলেন, যখন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার একটি দাবি হাইকোর্টে (রিট) করা হয়, তখন অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস এর বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে তিনি কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে নন। শক্তভাবে জঙ্গি তৎপরতা, রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা থাকলে সেটি সততার সঙ্গে তদন্ত করে এটি নিষিদ্ধ করা যেতে পারে। সাধারণ নিয়ম হিসেবে সংবিধানে সংগঠন করার স্বাধীনতা আছে।

এদিকে, ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য হিন্দুকে দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, রাজনৈতিক দলের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাননি তারা। তিনি বলেন, বিএনপি চায় সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুক। বিএনপি যেহেতু বাংলাদেশের একটি প্রধান রাজনৈতিক দল, তাই তাদের মতামতকে অগ্রাহ্য না করার কথাও জানান অধ্যাপক ইউনূস। তবে দমন-পীড়ন ও হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে নেতাকর্মীদের পাশাপাশি দলটিকেও বিচারের মুখোমুখি করতে আইন সংশোধনের প্রক্রিয়া চলছে। 

দলগুলোতে মতানৈক্য: বিএনপি যে কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের পক্ষে নয় সে বিষয়ে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একাধিকবার কথা বলেছেন। নভেম্বরের শুরুতে জাতীয় পার্টি এবং বৈষম্যবিরোধীসহ কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে তিনি বলেছিলেন, ‘রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার আমরা কারা?’ 

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, আওয়ামী লীগ দেশে গণহত্যার সঙ্গে জড়িত। শেখ হাসিনা ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। তার তো এই দেশে রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই। 

তিনি বলেন, রাজনীতি করার অধিকার সবারই আছে। কিন্তু যারা দেশের জনগণকে হত্যা করে, যারা ফ্যাসিস্ট তারা কীভাবে রাজনীতি করে? তাদের ব্যাপারে দেশের মানুষই সিদ্ধান্ত নেবে। এই দেশের মানুষ তাদের রাজনীতি আর গ্রহণ করবে না। তারা এখনো দেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চায়নি।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, আমরা কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে। তাতে ওই দলটির প্রতি মানুষের সহানুভূতি তৈরি হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগকে বিচারের মধ্য দিয়ে আসতে হবে। আওয়ামী লীগ যে অপরাধ করেছে তার বিচার এবং তারা জাতির কাছে এর জন্য অনুশোচনা এবং ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে কীভাবে ফিরতে চায় তার ওপর দলটির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।

যা চায় বিএনপি: দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে শিগগিরই নিষিদ্ধ করা হবে বলে সরকারের একজন উপদেষ্টার বক্তব্যের পর দেশজুড়ে তোলপাড় চললেও  কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধের পক্ষে নয় বিএনপি- এ কথা দলটি বারবারই বলে আসছে। আদালতে গণহত্যাকারী হিসেবে প্রমাণের পর আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের চিন্তাকেও শর্তসাপেক্ষে সমর্থনের কথা বলছেন বিএনপি নেতারা। 

বিএনপি প্রকাশ্যে বলছে, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ জনগণ নির্ধারণ করবে। দলটির ভাষ্য, আগামী নির্বাচনে অংশ নিলেও গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনে নৃশংসতা, বিরোধীদের ওপর নিপীড়ন, লুটপাট, আর্থিক কেলেঙ্কারি এবং জুলাই গণহত্যার কারণে জনগণ আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখ্যান করবে। 

বিএনপি সূত্রের খবর, আওয়ামী লীগ জনসমর্থন হারালেও দলটিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করলে বিতর্ক হবে। তাই একতরফা নয়, আওয়ামী লীগকে ভোটে হারিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায় বিএনপি। যাতে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দেশে-বিদেশে কোথাও প্রশ্ন না ওঠে। যে প্রশ্ন তিনটি বিতর্কিত পাতানো নির্বাচনের কারণে গত ১১ বছর আওয়ামী লীগকে তাড়া করেছে, এর মুখে পড়তে চায় না বিএনপি। 

এক সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব বলেছিলেন, ব্যক্তিগতভাবে তিনি আওয়ামী লীগ বা কোনো দলকেই নিষিদ্ধ করার পক্ষে নন। জামায়াতকে নিষিদ্ধের উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন, ‘এটি ন্যায়সংগত সিদ্ধান্ত ছিল না। ফলাফল কী হয়েছে? জামায়াত এখন রাজনীতিতে ফিরেছে।’ তবে এক অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুল স্পষ্ট করেন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের পক্ষপাতী না হলেও শেখ হাসিনা যাতে আর ক্ষমতায় ফিরতে না পারেন, সেই ব্যবস্থা চান। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠেছিলেন শেখ হাসিনা। তিনি আবার ক্ষমতায় ফিরে আসুক, তা বিএনপি চায় না। 

একচুল স্থান দিতে রাজি নন শিক্ষার্থীরা: সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি নেতারা নমনীয়তা দেখালেও অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্ব আওয়ামী লীগকে জুলাই গণহত্যার জন্য দায়ী করে রাজনীতিতে একচুল স্থান দিতে রাজি নন। তারা আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আনার কথাকেও ‘অপরাধ’ মনে করেন। 

অভ্যুত্থানের সূত্রপাত ঘটানো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে সরকারে আসা স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে যখন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের কথা বলি, তখন রাজনৈতিক দলগুলো তাদের বক্তৃতায় সেটি বাধা দেয়ার চেষ্টা করছে। ১৯৪৫ সালে জার্মানির ফ্যাসিস্ট নাৎসি পার্টিকে যদি নিষিদ্ধ করা হয় এবং এখনও তারা নিষিদ্ধ রয়েছে; সেখান থেকেই বোঝা উচিত আওয়ামী লীগের পরিণতি কী হওয়া উচিত।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ মনে করেন আওয়ামী লীগ এদেশের মানুষের কাছে নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। দলটিকে ৫ আগস্টের পরে আসলে এদেশের মানুষ অনানুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। ফলে তারা যখনই কোনো কর্মসূচির নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে আসে মানুষ তাদের প্রতিরোধ করে। এবারও তাই হয়েছে। তার কথা, তাদের আর রাজপথে আসার কোনো সুযোগ নেই। যারা অপরাধ করেছে, গণহত্যা করেছে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। আর যারা সাধারণ সমর্থক বা অপরাধ করেনি তাদের তাদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলে কীভাবে মূল ধারার রাজনীতিতে আনা যায় সেটা রাজনৈতিক দলগুলো বসে সিদ্ধান্ত নেবে। 

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম বলেন, তাদের নিশ্চয়ই রাজনীতি করার অধিকার আছে যেহেতু সরকার এখনো তাদের নিষিদ্ধ করেনি। কিন্তু আমাদের কথা হলো, তারা ফ্যাসিস্ট। তারা গণহত্যা চালিয়েছে। তাই আগে তাদের বিচার করতে হবে। তাদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত তারা কোনো রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালাতে পারেবনা। 

রয়েছে কূটনৈতিক চাপ: আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে দলটিকে নিষিদ্ধ করার প্রসঙ্গ ঘুরে ফিরে এলেও বিষয়টি নিয়ে এখন রাজনৈতিক মতবিরোধের পাশাপাশি কূটনৈতিক চাপের কথাও শোনা যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আছে এমন পশ্চিমা দেশগুলো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ প্রশ্নে ভিন্নমত পোষণ করছে বলেই মনে হচ্ছে। কারণ, বন্ধু রাষ্ট্রগুলো শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ চায়। কাউকে এক্সক্লুড করতে (বাইরে রাখতে) গেলে সংঘাতের আশংকা বাড়ে। সেজন্যই বন্ধু রাষ্ট্রগুলো তাগিদ দিচ্ছে যাতে অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাটাকে নেয়া যায়। 

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, গণতন্ত্রের কথা বলে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করতে বিভিন্ন দেশের দূতাবাস থেকে চাপ দেয়ার চেষ্টা করছে। 

আর কূটনীতিকদের যে তৎপরতার কথা বলা হচ্ছে, তা অস্বাভাবিক নয় বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষক অধ্যাপক সাহাব এনাম খান। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গণতন্ত্র সম্পর্কে ধ্যান ধারণার সাথে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির একটা ফারাক আছে। বিদেশিরা যেভাবে বাংলাদেশের দলগুলোকে দেখছে, সেভাবে বাংলাদেশের জনগণ সবসময় দেখেছে বলে মনে হয় না। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এই শিক্ষকের ধারণা, আগামীতে কূটনীতিকদের তরফে এমন তৎপরতা আরো বাড়তে পারে। 

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির বলেন, কূটনৈতিক দিক থেকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার বাংলাদেশের সরকার ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর। তারা(আলোচিত রাষ্ট্রসমূহ) আমাদের সহযোগী, তাদের সহযোগিতা ভবিষ্যতেও লাগবে, তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলে ভালো হবে আমাদের জন্য।

আইন কি বলে: গত ১৯ আগস্ট আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধে একটি রিট করেছিলেন ‘সারডা সোসাইটি’ নামে একটি সংগঠনের পক্ষে এর নির্বাহী পরিচালক আরিফুর রহমান মুরাদ ভূঁইয়া। কিন্তু গত ১ সেপ্টেম্বর বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি মুহাম্মদ মাহবুব-উল ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রিট খারিজ করে দেন। এ রিটের শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, দল নিষিদ্ধের সুযোগ নেই, সেই ইচ্ছাও নেই সরকারের। 

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত নেই রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের। সংবিধানে রাজনৈতিক দল পরিচালনার যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তা খর্ব করবে না সরকার। বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকারের অনেক অন্যায়-অবিচারের শিকার হয়েছে মানুষ। অনেক গুম-খুন হয়েছে। সেগুলোর বিচারের জন্য আইন ও আদালত রয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের অনেক ভালো নেতাকর্মীও রয়েছেন, তারা দলের মতাদর্শ ধারণ করেন। এজন্য দল নিষিদ্ধ করার সুযোগ নেই। তাদের রাজনৈতিক অধিকার খর্ব করার ইচ্ছা এ সরকারের নেই। 

অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, অতীতে অনেক রাজনৈতিক বিষয়কে কোর্টে টেনে আনা হয়েছে, যার মূল্য আমাদেরকে দিতে হয়েছে। যে গণঅভ্যুত্থানটি হয়েছে তা বিচার বিভাগের ওপরেও এসেছে। কোর্টে কোনো ঘটনা হলে আইনজীবী হিসেবে আমার ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়। এজন্য মাঠের রাজনীতি মাঠেই থাকুক। পরে রিটটি খারিজ করে দেন আদালত।