Image description

প্রাগৈতিহাসিক যুগের অনেক নিদর্শন অযত্ন অবহেলায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে। কয়েক দিন আমি যশোর জেলার কেশবপুর থানার প্রত্যন্ত পাঁজিয়া গ্রামের একটি পরিবারের পঞ্জিকা সংরক্ষণের একটি কাহিনী লিখেছিলাম। যা মানবকণ্ঠে গুরুত্ব-সহকারে প্রকাশিত হয়েছিল। ১৬৬ বছরের পঞ্জিকা সংরক্ষিত আছে হতদরিদ্র এই পরিবারটিতে। নিজেদের থাকার ঘর নেই কিন্তু পুরো একটা ঘরে যত্ন-সহকারে পঞ্জিকাগুলো তারা সংরক্ষণ করে রেখেছে লাল শালূতে মুড়ে। এমনি দুর্লভ দুটি হারিকেনের। প্রায় আড়াইশ বছরের পুরনো হারিকেন দুটি সংরক্ষিত আছে কেশবপুর বাজারের বাবু নিরঞ্জন সাহার বাড়িতে। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত নিরঞ্জন বাবুরা তৎকালীন জমিদারের সেরেস্তাদার ছিলেন। চব্বিশ পরগনার জমিদারদের ব্যবহৃত হারিকেন দুটি বংশানুক্রমে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। 

সেই সূত্রেই হারিকেন দুটি তাদের কাছে থেকে যায়। ১৯৪৭ পরবর্তী জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হয়ে যাবার পর হারিকেন দুটি নিরঞ্জন বাবুর কাছে থেকে যায়। তিনি সেরেস্তাদার হিসাবে কাজ করে ছিলেন। ইং ১৯৪২ থেকে ’৪৭ সাল পর্যন্ত জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত পর্যন্ত। বড় বাটির মতো গোল তলদেশ। যার মধ্যে কেরোসিন থাকে। দুপাশে দুটো সংযুক্তি করণ হ্যান্ডেল আর উপরে হাতে ঝোলানো হ্যান্ডেল। আলোর শিখা যাতে নিভে না যায় অথবা জল না পড়ে সে জন্যে মাথায় টোপর পরানো। যেখান দিয়ে তেল ঢোকানো হয় সেভানে প্যাঁচ ওয়ালা ছোট একটা ছিপি লাগানো আছে। আর মধ্যিখানে বাতাস থেকে নিরাপদ রাখার জন্যে লম্বা গোল কাঁচের চিমনি। এই আলোদানকারী বস্তুটি রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্যে যথেষ্ট সময় ব্যয় করতে হয়। তবু অযত্নে নেই হারিকেন দুটি। সব ধরনের পরিচর্যাই করে চলেছেন নিরঞ্জন বাবুর ছেলেরা।

হারিকেন দুটির একটিতে তেল ধরে ৬/৭ কেজি অপরটিতে ৩/৪ কেজি। সেসময় যেহেতু বিদ্যুৎ এর ব্যবস্থা ছিল না তাই জমিদারী কাজকর্ম চালানোর জন্য এই হারিকেনই ছিল অন্যতম ভরসা। সেসময় সাধারণ মানুষের রাতের ভরসা ছিল লম্প এবং হারিকেন। তবে সেই হারিকেনের আকার ছিল অপেক্ষাকৃত অনেক ছোট। যাতে সর্বোচ্চ আধাসের কেরাসিন ধরতো। গ্রামাঞ্চলে চলাচল এবং শিক্ষার্থীরা এই হারিকেনের আলো দিয়েই লেখাপড়া করতো।

নিরঞ্জন বাবু প্রয়াত হলেও তার সন্তানেরা হারিকেন দুটিকে অত্যন্ত যত্ন করে রাখে। নিয়মিত তেল, মবিল দিয়ে পরিষ্কার করে যাতে জং না ধরে। বছরান্তে হালকা রংয়ের প্রলেপ দেয় একই কারণে। নিরঞ্জন বাবুর পুত্র বাদল সাহা বলেন, যেহেতু পিতা-পিতামহের আমলের রক্ষিত সম্পদ তাই যে কোনোভাবে আমরা এটাকে সংরক্ষণের চেষ্টা করছি এবং করে যাবো। উল্লেখ্য, জমিদার আমলের একটি প্রতিমা ঘরও তারা এমন যত্ন করে রাখেন। বর্তমান প্রজন্ম হারিকেন নামক কোনো আলোক বর্তিকার কথা শুনলে হাসে। এই হারিকেনের সাথে তাদের দেখাও হয়নি এমনকি দেখেননি। তাদের সম্পর্ক বিদ্যুতের সাথে। 

তাই অনেকে এটি দেখতে নিরঞ্জন বাবুর বাড়িতে ভিড় জমায়। দুর্লভ, দুষ্প্রাপ্য জিনিস সংরক্ষণের জন্য সরকারের ‘জাদুঘর’ নামক একটি হাতিসম প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তারা হয়ত এর খোঁজ রাখেও না। অথচ এমন দুষ্প্রাপ্য ঐতিহ্য তাদের সংরক্ষণ করা উচিত।

 লেখক: কলামিস্ট