Image description

বাঙালির মাতৃভাষা প্রীতির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় মধ্য যুগ থেকে। নিজস্ব ভূখণ্ড, স্বাধিকারের বিষয়ে কিছুটা উদাস ছিল বাঙালি। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলনের পূর্বে স্বাধিকারের বিষয়ে বাঙালির উদ্দেশ্য অভিমুখী সচেতনতার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় না। স্বাধীনতা বা স্বাধীন ভূখণ্ডের বিষয়ে বাঙালির সংহতি গড়ার তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কোনো নজির নেই ইতিহাসে।

বাঙালির যত ভালোবাসা সবকিছু  মাতৃভাষাকে ঘিরে। মধ্যযুগে কবি আবদুল হাকিমের কণ্ঠে প্রথম শোনা যায় মাতৃভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসার কথা। বঙ্গে বা বাংলাতে জন্মে বাংলা ভাষার প্রতি হিংসা, অবহেলার বিষয়ে কবিতার ভাষায় তার উচ্চ কণ্ঠে বক্তব্য শুনে বিস্মিত হতে হয়। কী আন্তরিক ভালোবাসা, জানি না ভাষার জন্য পৃথিবীর অন্য কোনো জাতির  এতো ভালোবাসা সম-সাময়িককালে ছিল কি-না।  লক্ষ্য করুন “নূর নামা” কাব্য গ্রন্থে কী অসাধারণ প্রত্যয়দীপ্ত ঘোষণা: “যেসব বঙ্গেতে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী সেসব কাহার জš§ নির্ণয় ন জানি।দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়, নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়?।’’ মনে রাখতে হবে কবির এই দীপ্ত ঘোষণাটি প্রায় মধ্যযুগের অর্থাৎ আবদুল হাকিমের জন্ম ১৬২০ সালে এবং তার মৃত্যু ১৬৯০ সালে। ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি, নাট্যকার ও প্রহসন রচয়িতা মাইকেল মধুসূদন দত্তের কণ্ঠে বাংলা ভাষার প্রতি এক অন্যরকম শ্রদ্ধার কথা শুনতে পাই। মাইকেল যখন ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য সাধনা করে কোনোভাবেই পরিতৃপ্ত হতে পারছিলেন না তখন তার হƒদয়ের গহিন থেকে উঠে আসে মাতৃভাষার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ। তার লেখা “বঙ্গ ভাষা” কবিতা পাঠ করলে সে উপলব্ধি অনুভব করা যায়। “হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ’’। বাঙালির সংহতি, বাঙালির ঐক্য, বাঙালির জাতীয় চেতনা সবকিছু মূর্ত হয় বাঙালির ভাষার প্রতি ভালোবাসার অনুভূতিতে।

১৯৫২ ইংরেজিতে পূর্ববাংলার ভাষা আন্দোলন এবং বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে যে অভূতপূর্ব গণ-আন্দোলন সূচিত হয়েছিল তার তুলনা সমকালীন বিশ্বে খুঁজে পাওয়া যায় না। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন ছিল বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মতো বাংলা ভাষার অধিকারের দাবিতে রক্ত ঝরেছিল ভারতীয় উপমহাদেশের আরও এক শহরে, ঠিক ৯ বছর পর আসামের বরাক উপত্যকার শিলচর শহরে। মাতৃভাষার দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য বরাক উপত্যকায় প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন ১১ তরুণ। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রেক্ষাপট, তাৎপর্য বাংলাদেশের বাংলা ভাষাভাষী হিসেবে আমরা যতটুকু জানি বরাক উপত্যকার মাতৃভাষার দাবি প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সম্পর্কে কতিপয় অগ্রসর মানুষ ছাড়া অধিকাংশ মানুষই খুব বেশি জানেন বলে মনে হয় না। কী ছিল বরাক উপত্যকার মহান ভাষা আন্দলনের পটভূমি? আমাদের জানার দায় রয়েছে বরাক উপত্যকায় এই মহান আন্দোলনের প্রেক্ষাপট। পঞ্চাশের দশকে বরাক উপত্যকায় প্রায় চল্লিশ লক্ষাধিক নাগরিকের বসবাস ছিল, যার মধ্যে আশি শতাংশই ছিল বাংলা ভাষাভাষী বাঙালি। আসামের অন্যান্য অঞ্চলেও বিপুলসংখ্যক বাঙালির বসবাস ছিল। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি তাদের নীলনকশার অংশ হিসেবে বাংলা ভাষাভাষী জনগণের ওপর ‘অসমিয়া জাতীয়তাবাদী’ ধ্যান-ধারণাকে চাপিয়ে দেয়ার বীজ রোপণ করে এবং ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের আগে থেকেই বাঙালিদের বিরুদ্ধে অসমিয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির নাগরিকদের উসকে দেয়া হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পরও সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া অসমিয়া নাগরিকদের ভেতর এমন মানসিক দুর্ভাবনা ও আশঙ্কা ভর করে যে, অগ্রসরমান বাঙালি ও বাঙালি সংস্কৃতি হয়তো একদিন অসমিয়া যুবকদের শুধু কর্মসংস্থান দখলই নয়, পাশাপাশি তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দেবে। এ ধরনের মানসিক ভীতি থেকে আসামের রাজনৈতিক শাসকরা ১৯৪৭ সালের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে বাঙালি ও বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে নানা পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। এ সময় তারা অসমিয়াদের স্বার্থ রক্ষার্থে বিভিন্ন সময়ে একাধিক ভাষা-নীতিমালা প্রণয়ন করে। এরই ধারাবাহিকতায় অসমিয়া ভাষাকে একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৬০ সালের অক্টোবর মাসে অংংধস (ড়ভভরপরধষ) খধহমঁধমব অপঃ (অখঅ-১৯৬০) নামে একটি অ্যাক্ট  প্রাদেশিক পরিষদে পাস করিয়ে নেয়।

এই অ্যাক্ট পাসের পর বাঙালিরা নিজেদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে সুসংগঠিত ভাবে পরিচালনার জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংগঠিত হতে থাকে। আন্দোলনকে কার্যকর ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নানা নামে বাংলাভাষীরা ভাষা রক্ষায় এগিয়ে আসে। ‘নিখিল আসাম বাংলা ভাষাভাষী সমিতি’, ‘ভাষা সংগ্রাম পরিষদ’, ‘কাছাড় জেলা  গণসংগ্রাম পরিষদ’ এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এসব সংগঠন আসাম প্রাদেশিক পরিষদ কর্তৃক গৃহীত অ্যাক্ট বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। এছাড়াও সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা, নাগরিক-সমাজ ও বুদ্ধিজীবী মহল ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। যে কোনো আন্দোলনে যখন জন অংশগ্রহণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটতে থাকে তখন শাসক দল কোনো অবস্থাতেই সে আন্দোলনকে দমাতে পারে না। আন্দোলনের প্রথমদিকে শান্তিপূর্ণভাবে সভা, মিছিল, সত্যাগ্রহ, পদযাত্রা, হরতাল এবং অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। আন্দোলনকে গতিশীল এবং সাধারণ মানুষের ভেতর বাংলা ভাষার দাবিকে আরও জোরালো করার লক্ষ্যে কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ ২৪ এপ্রিল ১৯৬১ সালে সমগ্র বরাক উপত্যকায় ‘পক্ষকালব্যাপী পদযাত্রা’র কর্মসূচি শুরু করে। এ পদযাত্রায় ব্যাপক মানুষ অংশগ্রহণ করে এবং কাছাড় জেলার সদর শহর শিলচর থেকে শুরু করে উপত্যকার বিভিন্ন শহর ও শহরতলি এবং গ্রাম অঞ্চল ঘুরে আনুমানিক ২০০ মাইল পথ অতিক্রম করে ২ মে আবার শিলচরে এসে শেষ হয়। ২০০ মাইল পদযাত্রায় গণ মানুষের অংশগ্রহণের কারণে আন্দোলন তৃণমূল পর্যায়ে সফলভাবে বিস্তৃতি লাভ করে।

তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের অংশগ্রহণের কারণেই বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠে। মাতৃভাষার স্বীকৃতির দাবিটি গণমানুষের প্রাণের দাবিতে রূপান্তরিত হয়ে পড়ে। পদযাত্রা কর্মসূচির কারণে বরাক উপত্যকায় ব্যাপক গণজোয়ারের সৃষ্টি হয়। পদযাত্রা শেষে কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ ঘোষণা করেন, ১৩ মে’র মধ্যে যদি বাংলা ভাষাকে অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা না হয়, তাহলে ১৯ মে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করা হবে। আন্দোলনের এই ধারাবাহিকতায় ১৯ মে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ১৯ মে সকাল থেকেই সত্যাগ্রহীরা অহিংসভাবে হরতাল পালন করছিলেন। তিন জেলাতেই পিকেটারদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। শিলচরের তারাপুর রেলস্টেশনেও শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিল অবরোধ। ভারতীয় সময় বেলা ২টা ৩৫ মিনিট নাগাদ বিনা প্ররোচনায় নিরাপত্তারক্ষীরা ১৭ রাউন্ড গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়েন নয়জন ভাষাসৈনিক। পরে আরও দুজনের মৃত্যু হয়। জখম হন আরও একজন। বায়ান্নর পর ’৬১ সালের মাতৃভাষা আন্দোলনে প্রাণ দিলেন বাঙালি। শহীদ হলেন, কানাইলাল নিয়োগী, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, হীতেশ বিশ্বাস, সত্যেন্দ্র দেব, কুমুদরঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সুকমল পুরকায়স্থ এবং কমলা ভট্টাচার্য। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আরও ২৪ বছর বেঁচে ছিলেন কৃষ্ণকান্ত বিশ্বাস। শহিদের রক্ত স্রোতের ঢেউ এতোই তীব্র ছিল, যা দেখে শাসকরা বাংলাকে আসামের রাজ্য ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দান করতে বাধ্য হয়।

সারাবিশ্বের বাঙালিদের জন্য এ এক গর্বের ইতিহাস। ২১ ফেব্রুয়ারির মতো ১৯ মে’র ১১ জন ভাষা শহিদ সমগ্র বিশ্বের মাতৃভাষাপ্রেমী মানুষের গর্ব ও অহংকার। আশার বিষয় আসামের বরাক উপত্যকার বাংলাভাষী মানুষ এখন ১৯ মে ভাষা দিবস হিসেবে পালন করেন প্রতিবছর। ভাষা দিবস পালন করতে গিয়ে তারা স্লোগান তোলেন আমাদের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ, চেতনায় উনিশ। পঁচিশে বৈশাখ থেকে শুরু হয় ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান আর শেষ হয় ১১ জ্যৈষ্ঠ। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে দুটি চোখের তারা করে বরাক উপত্যকার মানুষ এগিয়ে যাচ্ছেন ভাষা শহিদের রক্তের প্রতিদান দিতে। বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনের বার্তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়া উচিত বিশ্ব বাঙালির মাঝে। একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনায় যেমন সারা বিশ্বের বাঙালিরা সমস্ত অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে সমর্থ হয়, বরাক উপত্যকার ভাষা শহিদের আত্মত্যাগের চেতনায়ও ভাষা-সংস্কৃতি বিরোধী যে কোনো সিদ্ধান্ত প্রতিহত করতে বাঙালিরা সমর্থ হবে। বরাক উপত্যকা হলো সর্বার্থে ভাষা শহিদের রেল স্টেশন। শিলচর শহরের রেল স্টেশনটির নাম পরিবর্তন করে ভাষা শহিদ স্টেশন করা হয়। ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যে কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কণ্ঠ উচ্চকিত করতে এই ভাষা শহিদ স্টেশন হয়ে উঠবে সকল মানুষের প্রেরণার উৎস।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক

মানবকণ্ঠ/এসআরএস