কোরবানির পশুর হাট
কোরবানির জন্য প্রস্তুত খামারিরা চাহিদার চেয়ে ২৩ লাখ পশু বেশি

আসন্ন পবিত্র ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে কোরবানির জন্য গরু প্রস্তুত করেছে খামারিরা। আর এবার চাহিদার চেয়ে ২৩ লাখ পশু বেশি আছে বলে জানিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। যে কারণে এবার ভারতীয় গরুর প্রাধান্য থাকছে না। অবৈধ প্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তেও থাকছে কঠোর নজরদারি।
এছাড়া কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে চলছে আগাম পশু কেনা-বেচা। এদিকে গত কয়েক বছরের মতো চলতি বছরও দেশে চাহিদার তুলনায় কোরবানির পশু বেশি আছে। দেশি খামারিদের কথা চিন্তা করে কোরবানিতে এবারও পশু আমদানির অনুমতি দেবে না সরকার। একই সঙ্গে পশুর অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে থাকবে কঠোর নজরদারি। এর আগে কয়েক দশক ধরে কোরবানিতে বিদেশি বিশেষ করে ভারতীয় গরুর প্রাধান্য ছিল। তখন কোরবানি উপলক্ষে গড়ে ২৪-২৫ লাখ গবাদি পশু দেশের বাইরে থেকে আসত। ধীরে ধীরে সেই চিত্র পাল্টেছে। গত কয়েক বছর দেশি পশু দিয়েই কোরবানি করা হচ্ছে। বাইরে থেকে আনা লাগছে না।
এ বছর কোরবানির জন্য এক কোটি ৭ লাখ ২ হাজার ৩৯৪টি পশুর চাহিদার বিপরীতে দেশে এক কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার ৩৬৭টি গবাদি পশু প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. আব্দুর রহমান।
তিনি বলেন, কোরবানির জন্য ৫৩ লাখ ৬০ হাজার ৭১৬টি গরু ও মহিষ, ৭৬ লাখ ১৭ হাজার ৮০১টি ছাগল-ভেড়া, এক হাজার ৮৫০টি অন্যান্য প্রজাতির প্রাণী প্রস্তুত আছে। কোরবানির জন্য ৫৩ লাখ ৬০ হাজার ৭১৬টি গরু ও মহিষ, ৭৬ লাখ ১৭ হাজার ৮০১টি ছাগল-ভেড়া, এক হাজার ৮৫০টি অন্যান্য প্রজাতির প্রাণী প্রস্তুত আছে। গত ১৬ বৃহস্পতিবার প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব তথ্য জানান।
মন্ত্রী আরও জানান, এ বছর এক কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার ৩৬৭টি পশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত আছে। যা গতবারের চেয়ে চার লাখ ৪৪ হাজার ৩৪টি বেশি। আর এবার এক কোটি ৭ লাখ দুই হাজার ৩৯৪টি পশুর চাহিদা থাকতে পারে বলে সম্ভাবনার জায়গা থেকে আমরা ধরে নিয়েছি।
এদিকে গত বছর সারাদেশে কোরবানিযোগ্য গবাদি পশুর সংখ্যা ছিল এক কোটি ২৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩৩৩টি। এর মধ্যে এক কোটি ৪১ হাজার ৮১২টি পশু কোরবানি করা হয়। কোরবানি হওয়া গবাদি পশুর মধ্যে ৪৫ লাখ ৮১ হাজার ৬০টি গরু, এক লাখ ৭ হাজার ৮৭৫টি মহিষ, ৪৮ লাখ ৪৯ হাজার ৩২৮টি ছাগল, পাঁচ লাখ দুই হাজার ৩০৭টি ভেড়া এবং এক হাজার ২৪২টি অন্যান্য পশু ছিল। চাহিদার চেয়ে দেশে কোরবানির পশুর সংখ্যা বেশি হওয়ায় এ বছরও পশু আমদানির অনুমতি দেবে না সরকার। গত বছর পবিত্র ঈদুল আজহায় সারাদেশে মোট ১ কোটি ৪১ হাজার ৮১২টি গবাদিপশু কোরবানি করা হয়। সবচেয়ে বেশি পশু কোরবানি করা হয় ঢাকা বিভাগে এবং সবচেয়ে কম পশু কোরবানি করা হয় ময়মনসিংহ বিভাগে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ঢাকা বিভাগে ২৫ লাখ ৪৮ হাজার ১৮৪টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ২০ লাখ ৫১ হাজার ৭৭৭টি, রাজশাহী বিভাগে ২১ লাখ ৩২ হাজার ৪৬৯টি, খুলনা বিভাগে ৯ লাখ ৪৯ হাজার ৫৮১টি, বরিশাল বিভাগে চার লাখ ৩০ হাজার ৬৭৩টি, সিলেট বিভাগে তিন লাখ ৯৪ হাজার ৩৯টি, রংপুর বিভাগে ১১ লাখ ৪৯ হাজার ১৮৭টি এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৩ লাখ ৮৫ হাজার ৯০২টি গবাদি পশু কোরবানি করা হয়। ঢাকা বিভাগে ১১ লাখ ৭১ হাজার ২১৭টি গরু, ৬ হাজার ৪৮০টি মহিষ, ১২ লাখ ৬৭ হাজার ৫৯৫টি ছাগল, এক লাখ দুই হাজার ১৬টি ভেড়া ও অন্যান্য ৮৭৬টি পশু কোরবানি করা হয়। চট্টগ্রাম বিভাগে ১২ লাখ ২৯ হাজার ৬২টি গরু, ৮৭ হাজার ২১৪টি মহিষ, ছয় লাখ ৪১ হাজার ৯৭৮টি ছাগল, ৯৩ হাজার ১৮১টি ভেড়া ও অন্যান্য ৩৪২টি পশু কোরবানি করা হয়। রাজশাহী বিভাগে ৭ লাখ ১১ হাজার গরু, ৯ হাজার ৪৬৯টি মহিষ, ১২ লাখ ৩১ হাজার ছাগল ও এক লাখ ৮১ হাজার ভেড়া কোরবানি করা হয়। খুলনা বিভাগে দুই লাখ ৭০ হাজার ২১৯টি গরু, এক হাজার ৪৯২টি মহিষ, ছয় লাখ ৫২ হাজার ৭৩১টি ছাগল, ২৫ হাজার ১২৩টি ভেড়া ও অন্যান্য ১৬টি পশু কোরবানি করা হয়। বরিশাল বিভাগে দুই লাখ ৭৬ হাজার ৬৩৫টি গরু, ৯৮৯টি মহিষ, এক লাখ ৫১ হাজার ৫৬৪টি ছাগল ও এক হাজার ৪৮৫টি ভেড়া কোরবানি করা হয়। সিলেট বিভাগে এক লাখ ৯৯ হাজার ১৭২টি গরু, এক হাজার ১৫৩টি মহিষ, এক লাখ ৭২ হাজার ৭৪টি ছাগল ও ২১ হাজার ৬৪০টি ভেড়া কোরবানি করা হয়। রংপুর বিভাগে পাঁচ লাখ ৩৬ হাজার ৭২০টি গরু, ২৬৯টি মহিষ, পাঁচ লাখ ৪৬ হাজার ৩৫৭টি ছাগল ও ৬৫ হাজার ৮৩৩টি ভেড়া কোরবানি করা হয়। ময়মনসিংহ বিভাগে এক লাখ ৮৭ হাজার ৩৫টি গরু, ৮০৯টি মহিষ, এক লাখ ৮৬ হাজার ২৯টি ছাগল ও ১২ হাজার ২৯টি ভেড়া কোরবানি করা হয়। জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ। ২০১১ সালের আদমশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী সে সময় জনসংখ্যা ছিল ১৪ কোটি ৪০ লাখ। অর্থাৎ ১১ বছরের ব্যবধানে জনসংখ্যা বেড়েছে আড়াই কোটির বেশি। আর ২০০১ সালে দেশে জনসংখ্যা ছিল ১২ কোটি ৪৩ লাখ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানির অনুমতি দিলে দেশের খামারিরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। বিষয়টি বিবেচনায় রেখে আমদানির অনুমতি দেয়া হবে না। এ প্রসঙ্গে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হক বলেন, দেশে চাহিদা অনুযায়ী কোরবানির পশু রয়েছে। পশু আমদানির প্রশ্নই ওঠে না। তিনি আরও বলেন, কোরবানি নিয়ে আমাদের ব্যাপক প্রস্তুতি রয়েছে। যদি কেউ আমদানির চেষ্টা করে, তাহলে সে ঠকবে। কোরবানি উপলক্ষে সীমান্ত দিয়ে পশুর অনুপ্রবেশ যেন না ঘটে সেজন্য কঠোর নজরদারি থাকবে। কেউ যদি চোখ ফাঁকি দিয়ে পশু আনতে চায় তবে বিজিবি ব্যবস্থা নেবে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রাণিসম্পদ-২ অনুবিভাগ) এ.টি.এম. মোস্তফা কামাল বলেন, কোরবানির পশুর প্রস্তুতি নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি মন্ত্রণালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হবে। সভায় বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা শেষে মন্ত্রী বিস্তারিত ঘোষণা দেবেন। মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব ড. এস এম যোবায়দুল কবির বলেন, আশা করা যাচ্ছে এ বছরও দেশি পশু দিয়েই কোরবানির চাহিদা মিটবে।
অন্যদিকে সংখ্যাগত দিক থেকে গরু উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১২তম। তবে গড় উৎপাদনশীলতায় এখনো অনেক পিছিয়ে। প্রতিনিয়ত দেশের জনসংখ্যা বাড়লেও চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদনশীলতা না বাড়ায় বাজারে গরুর মাংসের দাম বেড়ে চলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সংকটে দেশে গরুর উৎপাদনশীলতা কম। এ বিষয়ে এখনই মনোযোগ না দিলে ভবিষ্যতে ভোক্তা চাহিদা পূরণে হিমশিম খেতে হবে। প্রাণিসম্পদ খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, দেশে কৃষি খাতের গবেষণায় যথেষ্ট কাজ হলেও প্রাণিসম্পদ খাত এখনো পিছিয়ে। প্রথাগত পদ্ধতিতে গরু উৎপাদন ও খামার পরিচালনা করে কাক্সিক্ষত উৎপাদনশীলতা বাড়ানো সম্ভব নয়। উন্নত দেশগুলোর ফার্মিং পদ্ধতি অনুসরণ করে বিজ্ঞানভিত্তিক খামার গড়ে তুলতে সংশ্লিষ্টদের পদক্ষেপ নিতে হবে। জাত উন্নয়ন ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে গবেষণাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো অবদান রাখতে হবে।
আগাম ক্রেতা আসতে শুরু করেছে গরুর ফার্মে: ঈদুল আজহার সময় দেশজুড়ে কোরবানিযোগ্য পশুর চাহিদা থাকে ব্যাপক। ঈদকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় পশুর হাট বসলেও অনেকে ফার্ম থেকে কোরবানিযোগ্য পশু কিনতে পছন্দ করেন। অনেক ক্রেতা আগেই এসব ফার্মে গিয়ে কোরবানির পশু পছন্দ করে অগ্রিম টাকা পরিশোধ করে বুকিং দিয়ে রাখেন। তাই কোরবানি ঘিরে কয়েক মাস আগে থেকেই প্রস্তুতি নেন খামার সংশ্লিষ্টরা। গত কয়েক বছরে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে অসংখ্য পশুর খামার। এসব খামারে মূলত ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করেই পশু লালন-পালন করা হয়। তবে বছরের অন্য সময়ও এসব খামার থেকে পশু কিনতে পারেন ক্রেতারা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছোট গরু সংগ্রহ করে এসব খামারে লালন-পালন করে ঈদের সময় বিক্রি করা হয়। গতকাল রাজধানীর রামপুরার ডিআইটি রোডের ‘আলইকুয়া ক্যাটল ফার্ম’ ঘুরে দেখা যায়, ফার্মে থাকা পশু পালনের জন্য প্রতিটি সøট বিভিন্ন জাতের গরুতে ভরা। পশু পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন কর্মীরা। কর্মীদের কেউ কেউ পশুগুলোকে খাবার খাওয়ানোসহ নানাভাবে কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে। ফার্ম সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে অনেকে এসেছেন কোরবানির জন্য গরু দেখতে। কেউ কেউ আগ্রহ নিয়ে কথা বলছেন। তবে এখনো বিক্রি শুরু হয়নি। ফার্মের তত্ত্বাবধায়ক মহিউদ্দিন ভূঁইয়া সনি বলেন, আশপাশে ক্যাটল ফার্ম তেমন নেই। তাই রামপুরা এলাকার লোকজন গরু দেখতে আসেন। রাজধানীসহ আশপাশের এলাকায় অর্ধশত গরুর খামার রয়েছে। পশুর বাজারের পাশাপাশি কোরবানির ঈদে এসব খামারে ক্রেতাদের ভিড় থাকে চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে ঈদের আগের রাতে তো কথাই নেই। মূলত যারা পশুর হাটের ঝামেলা এড়াতে চান, তাদেরই বেশি দেখা মেলে এসব খামারে।
এদিকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় মনে করছে, দেশে চাহিদার চেয়ে বেশি কোরবানির পশু বিক্রির জন্য প্রস্তুত রয়েছে। তাই এবার বিদেশ থেকে পশু (গরু-মহিষ) আমদানির অনুমতি দেয়া হবে না। এই বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. আব্দুর রহমান মানবকণ্ঠকে বলেন, বাইরে থেকে যেন পশু না আসে, এটা আমাদের নীতিগত সিদ্ধান্ত। এবার চোরাই পথে যেন গরু না আসে, সে ব্যাপারেও আমরা সতর্ক এবং সজাগ থাকব। তিনি জানান, এ বছর সারাদেশে তিন হাজার পশুর হাট বসবে। এরমধ্যে ঢাকা সিটি করপোরেশনে বসবে ২১টি। গত বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও কোনো খামারি নিজ বাড়ি থেকে পশু বিক্রি করলে তাকে হাসিল দিতে হবে না। কোনো খামারি তার পশু দূরবর্তী হাটে নিতে চাইলে, রাস্তাঘাটে জোর করে নামাতে বাধ্য করা যাবে না। এক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় সরকারের ইউনিট তথা পৌরসভা, উপজেলা বা ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি করপোরেশন এ বিষয়টি নিশ্চিত করবে।
মানবকণ্ঠ/এসআরএস
Comments