Image description

সিরাজগঞ্জ শাহজাদপুরে রবীন্দ্র কাছারিবাড়ির অডিটোরিয়াম ভাংচুরের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৯ জনকে আটক করেছে সেনাবাহিনী ও শাহজাদপুর থানা পুলিশ। অপরদিকে এই ভাংচুরের আড়ালে পড়ে গেছে কাছারিবাড়ির স্টাফদের দ্বারা মারধরের শিকার দর্শনার্থী শাহনেওয়াজের আর্তনাদ। 

গত ৮ জুন রবীন্দ্র কাছারিবাড়িতে ঘুরতে গিয়ে পার্কিং ফি নিয়ে গেটের এক কর্মচারীর সঙ্গে তার বাকবিত-ার একপর্যায়ে ওই দর্শনার্থীকে গেট থেকে মারধর করতে করতে অডিটোরিয়ামের ভেতরে আটকে রেখে বাঠাম দিয়ে পিটিয়ে আহত করা হয়। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী শাহনেওয়াজ ঐ দিন রাতেই কাস্টোডিয়ান হাবিবুর রহমানকে ১ নম্বর আসামি করে ৬ জনের বিরুদ্ধে শাহজাদপুর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করলেও সেই অভিযোগ এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। 

এদিকে কাছারিবাড়ির এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির অন্যতম সদস্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (শাহজাদপুর সার্কেল) মোঃ কামরুজ্জামান ভুক্তভোগী শাহনেওয়াজের অভিযোগের বিষয়ে কিছুই জানেন বলে জানিয়েছেন প্রতিবেদককে। 

অপরদিকে মারধরের ঘটনার দুই দিন পেরিয়ে গেলেও থানা পুলিশ কোনো কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় গত মঙ্গলবার (১০ জুন) স্থানীয়রা শাহজাদপুর প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেন। পরে উত্তেজিত জনতা কাছারিবাড়িতে প্রবেশ করে অডিটোরিয়ামের দরজা ও জানালা ভাংচুর করে। ভাংচুরের ঘটনায় রবীন্দ্র কাছারিবাড়ির কাস্টোডিয়ান গত ১০ জুন নির্যাতিত শাহনেওয়াজকে প্রধান আসামী করে ১২ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ৫০/৬০ জনের নামে থানায় মামলা দায়েরের পর থেকে এখন পর্যন্ত সেনাবাহিনী ও থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে মোট ৯ জনকে আটক করেছে। 

আটককৃতরা হলেন- সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য শাহজাদপুর পৌর এলাকা রূপপুর মহল্লার বাসিন্দা মৃত আবু কাশেমের ছেলে অধ্যাপক আবু শামিম (৬০), রূপপুর নতুনপাড়ার শাহ আলমের দুই ছেলে রিমন হোসেন (২৫) সজিব হোসেন (২২), পাঠানপাড়ার শুকুর মাহমুদের ছেলে আশিকুর রহমান আরমান (২১), একই মহল্লার আব্দুল জব্বারের ছেলে তানভীর হাসান অর্ক (২২), চুনিয়াখালীপাড়ার আব্দুল্লাহ আল মাহমুদের ছেলে জুবায়ের হোসেন (২৪) রুপপুর নতুন পাড়ার হাজী মহসেনের ছেলে মিলন হোসেন(২৫)। এদের মধ্যে প্রথম তিনজনকে সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করেছে।

এব্যপারে কথা জানতে গেলে কাছারিবাড়িতে নির্যাতিত শাহনেওয়াজের বাবা আমজাদ হোসেন কান্নায় ভেঙে পড়েন। কান্না জড়িত কণ্ঠেই তিনি জানান, তার ছেলে শাহনেওয়াজ একজন রেমিট্যান্সযোদ্ধা। ঈদের ছুটিতে দেশে এসে স্ত্রীকে নিয়ে রবীন্দ্র কাছারিবাড়িতে বেড়াতে গিয়ে স্টাফদের দ্বারা অমানবিক মারধরের শিকার হয়। ঐদিন রাতেই শাহজাদপুর থানায় লিখিত অভিযোগ দিলেও এখন পর্যন্ত কোন প্রকার ব্যাবস্থা নেইনি থানা পুলিশ। পরে ১০ জুন এলাকাবাসী এ ঘটনার ক্ষুব্ধ হয়ে দোষীদের শাস্তি দাবী করে মানববন্ধন এবং শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করে। এরপর কারা কোন উদ্দেশ্যে কাছারিবাড়িতে ঢুকে ভাংচুর চালিয়েছে তিনি তা না জানলেও সব দোষ তাদের উপর চাপিয়ে দিয়ে সুকৌশলে শাহনেওয়াজের নির্যাতনের ঘটনাকে আড়াল করে দওেয়া হয়েছে। এই ভাংচুরের ঘটনা কাছারি বাড়ির স্টাফরাই নিজেদের লোকজন দিয়ে করিয়ে বিক্ষোভকারীদের উপর দায় চাপিয়ে নিজেরা মুক্ত হতে চাচ্ছেন বলেও জানান শাহনেওয়াজের বাবা ।

বিভিন্ন মাধ্যমে কাছারিবাড়ির ঘটনা নেতিবাচক ভাবে প্রচারের ফলে দেশে এবং বিদেশে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। ইতোমধ্যে কাছারিবাড়ির এ ঘটনায় বিবৃতি দিয়েছে ভারতের সরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিবৃতিতে ভারত কাছারি বাড়ির ঘটনায় শক্ত ব্যাবস্থা নেওয়ার দাবী জানিয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষেও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় আলাদা ভাবে বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতিতে জানানো হয়েছে অনাকাঙ্খিত ঘটনাটি কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে ঘটেনি। ব্যাক্তিগত দ্বন্দ্ব থেকে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

এরপর গত ১২ জুন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় স্থানীয় বিএনপি সংবাদ সম্মেলন করে ছাত্রলীগ নেতার নেতৃত্বে কাছারিবাড়ি ভাংচুর করা হয়েছে উল্লেখ করলেও সেই রাতেই এই মামলায় সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সম্মেলন প্রস্তুত কমিটির সদস্য অধ্যাপক আবু শামিমকে আটক করার পর নতুন বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীদের মধ্যে ধোয়াসা ক্রমেই গাঢ় হচ্ছে। এই ভাংচুরের সাথে কাছারিবাড়ির কোন স্টাফ বা স্বার্থন্বেষি কোন মহল ইন্ধন জুগিয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখার দাবী জানিয়েছে সচেতন মহল।

এ বিষয়ে কথা হলে স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মী ও নাট্য ব্যাক্তিত্ব কাজী শওকত প্রতিবেদককে জানান, গত ৮ জুন একজন দর্শনার্থীর সাথে কাছারিবাড়ির স্টাফরা যে পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে এবং পরবর্তীতে আন্দোলনকারীদের পক্ষ নিয়ে অতিউৎসাহিত কিছু মানুষ মিলনায়তনে যে ভাংচুর চালিয়েছে এই দুটো ঘটনাই অনাকাঙ্খিত এবং অপ্রত্যাশিত। দুটো ঘটনারই সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তির দাবী জানান। সেইসাথে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিরীহ কেউ যেন হেনস্তার শিকার না হন সে বিষয়েও প্রশাসনকে সজাগ দৃষ্টি রাখার আহ্বান জানান তিনি।

এদিকে কাছারিবাড়িতে দর্শনার্থীদের প্রবেশে যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল তা তুলে নেওয়ায় স্বস্তি ফিরেছে সংস্কৃতি প্রেমী এবং রবীন্দ্র ভক্তদের মাঝে। গত শুক্রবার সকালে সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ঘোষণার পর প্রথম দিনেই বিকেল পর্যন্ত অন্তত দুইশত জন দর্শনার্থী টিকেট নিয়ে প্রবেশ করেছেন। উপস্থিত দর্শনার্থীদের সাথে কথা হলে তারা জানান, অনাকাঙ্খিত ঘটনার পর দুইদিন বন্ধ থাকায় তারা হতাশ হয়েছিলেন। তবে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ায় তারা আনন্দিত। 

তারা আরও জানান, অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যাবস্থায় তারা কিছুটা অস্বস্তি বোধ করলেও আর যেন এমন অনাকাঙ্খিত ঘটনা না ঘটে সে দাবী করেন এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন শাহজাদপুরে এসে এ অঞ্চলের মানুষকে আপন করে নিয়েছিলেন তেমনি করে এখানকার স্টাফরা যেন সবাইকে আপন করে নেন সেই দাবীও করেন।

কাছারিবাড়ি কেন্দ্রিক ছোট ছোট ব্যাবসায়ীরা জানান, দুইদিন বন্ধ থাকায় তারা অনেক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। কবি যেমন শাহজাদপুরের মানুষের আপন হয়ে গিয়েছিলেন তেমনি এ অঞ্চলের মানুষও তাঁকে ভালোবেসে আপন করে রেখেছেন। বড় বড় অনুষ্ঠানেও এখানে কখনো অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটেনি। ভবিষ্যতেও যেন আর এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনা না ঘটে এমটাই প্রত্যাশা করেন ব্যাবসায়ীরা।

এ ব্যাপারে শাহজাদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আছলাম আলী জানান, গত কয়েকদিনে সেনাবাহিনীর এবং পুলিশের অভিযানে ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে। অপরদিকে শাহনেওয়াজ অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিবেককে জানান অভিযোগের তদন্ত চলমান রয়েছে।