
সাকিব আল হাসান! যাকে বলা হয় দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন! কিন্তু দেশসেরা ক্রিকেটার হওয়ায় নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে বারবার বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন তিনি। ক্রিকেট ক্যারিয়ারের সাফল্যতার সাথে জড়িয়ে আছে নানা কেলেঙ্কারি। প্রায় ডজন খানেক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে বেশ কয়েক বার শাস্তি পেয়েছেন!
কয়েক দিন আগেই বিপিএলে মাঠে দর্শকদের অশালীন ভঙ্গিতে বাজে ইঙ্গিত দিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি। যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এবার ভারতের বহুল আলোচিত মাহাদেভ বেটিং কেলেঙ্কারির তদন্তে সাকিবের বোনের নাম উঠে এসেছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে।
ভারতের আলোচিত মাহাদেভ বেটিং কেলেঙ্কারির তদন্তে সাকিব আল হাসানের বোনের নাম উঠে আসা নিয়ে এই তারকা ক্রিকেটারের কাছে জানতে চাওয়া হলেও সাড়া দেননি তিনি। অন্যদিকে বিসিবি জানিয়েছে, এখনই এই বিষযটি নিয়ে কোনো মন্তব্য করার অবস্থায় নেই তারা। মাহাদেভ বেটিং অ্যাপ কেলেঙ্কোরির তদন্ত চলছে গত কয়েক মাস ধরেই। সেখানেই সাকিবের বোনের নাম বেরিয়ে আসার চমকপ্রদ তথ্য জানায় ভারতীয় সংবাদমাধ্যম। গত শুক্রবার রাতে ইন্ডিয়াটুডে ডট ইন-এ এই খবর প্রকাশিত হয়। ভারতের আরও কিছু সংবাদমাধ্যমে পড়ে দেখা যায় একই খবর। মাহাদেভ অ্যাপ একটি অনলাইন বেটিং প্লাটফর্ম, যেখানে ব্যাডমিন্টন, টেনিস, ফুটবল, ক্রিকেট ও পোকারসহ বিভিন্ন কার্ড খেলায় অবৈধ জুয়ার কারবার চলত। ভারতীয় সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের রাজস্ব বিভাগের তদন্তকারী সংস্থা ‘এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেট (ইডি)’ খতিয়ে দেখছে এই কেলেঙ্কারির ব্যাপারটি।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তারা জানায়, এই ঘটনার তদন্ত প্রক্রিয়ায় গিরিশ তালরেজা ও সুরাজ চোখানি নামের দুজন ব্যবসায়ীকে আটক করা হয়েছে। মাহাদেভ অ্যাপের অগ্রণীদের একজন দুবাইভিত্তিক হুন্ডি ব্যবসায়ী হারি শাঙ্কার তিব্রেওয়ালের ঘনিষ্ঠ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ওই দুজনকে। ওই তদন্তে উঠে এসেছে, ‘ংশুবীপযধহমব’ নামে একটি অবৈধ বেটিং ওয়েবসাইট পরিচালনা করতেন এই তিব্রেওয়াল। দুবাইভিত্তিক বিভিন্ন পরিচয়ের ভিত্তিতে ভারতের স্টক মার্কেটেও বিনিয়োগ করতেন তিনি ফরেন পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট-এর আওতায়।
অবশ্য বেটিং সাইটে বিনিয়োগে বোনের নাম আসার প্রসঙ্গে সাকিব নিশ্চুপ! এ বিষয়ে কোন মন্তব্য নেই’ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড বিসিবির। স্টক মার্কেটের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে এই তিব্রেওয়ালের অর্থ বিনিয়োগ করতেন আটক হওয়া সুরাজ চোখানি। পাশাপাশি বাংলাদেশে ১১রিপশবঃ.পড়স নামের একটি বেটিং সাইটেও বিনিয়োগ করেন চোখানি, যেখানে সাকিবের বোন তার অংশীদার বলে উল্লেখ করা হয়েছে ইন্ডিয়াটুডে ডট ইন-এর খবরে।
এই খবরে সাকিবের বোনের নাম বলা হয়েছে জান্নাতুল হাসান। তবে তার বোনের প্রকৃত নাম জান্নাতুল ফেরদৌস রিতু। এই অ্যাপ ছাড়াও নেপালের কাঠমান্ডুতে একটি ক্যাসিনোতে চোখানি ৪০ কোটি রুপি বিনিয়োগ করেছেন বলেও খবরটিতে বলা হয়েছে এবং সেখানে দাবি করা হয়েছে, লোটাস ৩৬৫ ও মাহাদেভ অ্যাপ থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে আয় করা অর্থ তিনি ওখানে বিনিয়োগ করেছেন।
বোনের নাম উঠে আসা নিয়ে সাকিবের সঙ্গে ফোনে কল করে এবং হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠিয়ে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজামউদ্দিন চৌধুরি সুজন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আজকে সকালেই খবরটি দেখলাম। এখনই আমরা এটি নিয়ে মন্তব্য করার অবস্থায় নেই।’ সাকিবের সঙ্গে এই প্রসঙ্গে কোনো কথা হয়নি বলেও জানান তিনি। বিসিবির মিডিয়া কমেটির চেয়ারম্যান তানভীর আহমেদ টিটু মানবকণ্ঠকে বলেন, ‘আসলে ক্রিকেট বাইরের বিষয়টা বিসিবির বিষয় নয়। এ বিষয়ে সাকিবের কাছে জানতে চাওয়াই ভালো।’
কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) প্রধান ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান সংবাদমাধ্যমকে বলেন,‘আমরা ক্রিকেটার সাকিবের বোন বা এই সংক্রান্ত বেটিং অ্যাপ নিয়ে কাজ করছি না।’
এ দিকে বিসিবির কেন্দ্রীয় চুক্তিতে তিন সংস্করণেই আছেন সাকিব। বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার হিসেবেও তিনি অবিসংবাদিত। তবে ক্যারিয়ারজুড়ে অসংখ্য বিতর্কে নাম জড়িয়েছে তার। দুর্নীতিবিরোধী ধারা ভঙ্গের কারণে ২০১৯ সালের অক্টোবরে তাকে এক বছরের স্থগিত নিষেধাজ্ঞাসহ দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে আইসিসি। তিন দফায় ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব পেয়েও তা গোপন করায় এই শাস্তি হয়েছিল তার। গত বছর বেটউইনার নিউজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের শুভেচ্ছাদূত হয়েও তিনি খবরের শিরোনামে উঠে আসেন। সেটিও ছিল মূলত বেটিং সাইট সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। প্রবল আলোচনা-সমালোচনার মুখে বিসিবির হস্তক্ষেপে পরে সেই চুক্তি থেকে সরে আসেন তিনি। গত জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হয়ে মাগুরা-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সাকিব। বিপিএল শেষে বিশ্রামে থাকায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চলতি সিরিজে তিনি খেলছেন না।
সাকিবের ক্যারিয়ারের উত্থান শুরু হয় প্রায় এক যুগ আগে। জাতীয় দলে খেলার পাশাপাশি ২০১০ সাল-পরবর্তী সময়ে ব্যবসা জগতে পা রাখেন সাকিব আল হাসান। এরপর থেকে বিভিন্ন খাতে একের পর এক বিনিয়োগ করেছেন তিনি। রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যবসায়ী হিসেবে হাতেখড়ি সাকিব আল হাসানের। এরপর দ্রুতই নিজের ব্যবসায়িক পরিমণ্ডল বিস্তৃত করেছেন তিনি।
একই সাথে দেশের পুঁজিবাজার, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, প্রসাধনী, ট্রাভেল এজেন্সি, হোটেল, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, কাঁকড়া ও কুঁচের খামার, শপিংমল, স্বর্ণ আমদানির প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ রয়েছে তার।
দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে বড় অংকের বিনিয়োগ করেছেন সাকিব। তবে ব্যাট-বল হাতে তার সাফল্য ব্যবসায় ধরা দেয়নি। কারণ কিছু প্রতিষ্ঠান তিনি এরই মধ্যে বিক্রি করে দিয়েছেন। ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর ওয়ান ব্যাংক লিমিটেডের শেয়ারদর ছিল ১২ টাকা ৬০ পয়সা। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে তা দাঁড়ায় ২০ টাকা ১০ পয়সায়। ব্যাংকটির ওই সময়কার শেয়ার লেনদেন নিয়ে তদন্ত চালিয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ লেনদেনকারীদের তালিকায় আবারো সাকিব আল হাসানের নাম উঠে আসে। কয়েক দিন আগেই দ্বাদশ জাতীয় সংদস নির্বাচনে মেজাজ হারিয়ে ভক্তকে চড় মারলেন সাকিব। কিন্তু তার ক্যারিয়ারে যত অনিয়ম তিনি করেছেন, তা দেখেও দেশের কোটি কোটি ক্রিকেট ভক্ত সাকিবকে ভালোবেসে গেছেন।
সেই সব মানুষ আজ সাকিবকে সমালোচনা করতে গিয়ে ভাণ্ডার খুলে বসছেন। অনেকই বলছেন, সাকিব কী এমন রসগোল্লা! লজ্জার কথা! অপমানের কথা! সাকিব এই লজ্জার কথা শুনেছেন কি না, জানা নাই। কখনো সতীর্থদের সঙ্গে বাজে আচরণ, কখনো মিডিয়া ও দর্শকদের সঙ্গে, বোর্ডের নিয়ম ভেঙেও শাস্তি পেয়েছেন অনেকবার।
সাকিবের তার ক্যারিয়ারের বিতর্কিত অধ্যায়গুলো তুলে ধরা হলো-
২০১০: ভারতের বিপক্ষে সিরিজের চতুর্থ ম্যাচে ব্যাটিং করছিলেন সাকিব। ঠিক সেই এ সময় সাইড স্ক্রিনের পাশে এক দর্শকের নড়াচড়ায় রেগে উইকেট ছেড়ে বাউন্ডারি লাইনে ছুটে গিয়ে বাজে ভাষা ব্যবহারের পাশাপাশি ব্যাট উঁচিয়ে দর্শককে হুমকি দেন।
২০১১: আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশ ৫৮ রানে অলআউট হওয়ার পর সাকিবকে ইঙ্গিত করে গ্যালারি থেকে দুয়ো আসতে থাকে। এ সময় সাকিব দর্শকদের মধ্যমা আঙ্গুল দেখিয়ে বাজে ইঙ্গিত করেন। ২০১৩ বিজয় দিবস টি-টোয়েন্টি ম্যাচ চলাকালীন এক দর্শকের কলার চেপে ধরেন সাকিব।
২০১৪: মিরপুরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডেতে আউট হওয়ার পর ডেসিংরুমে বসে থাকা সাকিব টিভি ক্যামেরার সামনে অশালীন ভঙ্গিতে বাজে ইঙ্গিত করেন। সেই ঘটনায় তিন ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ হন তিনি। ২০১৪ : ভারতের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডে চলাকালে স্ত্রীকে উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে এক দর্শককে পিটিয়ে আহত করেন সাকিব।
২০১৫: বিপিএলে সিলেট সুপার স্টার্সের বিপক্ষে ম্যাচে আম্পায়ার তানভীর আহমেদের সঙ্গে অসদাচরণ করে এক ম্যাচ নিষিদ্ধ ও ২০ হাজার টাকা জরিমানা দেন রংপুর রাইডার্সের সাকিব।
২০১৬: বিপিএলের প্রথম কোয়ালিফায়ারে আম্পায়ারের সঙ্গে বিবাদে জড়ান ঢাকা ডায়নামাইটসের অধিনায়ক সাকিব।
২০১৭: দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের আগে ছয় মাসের ছুটি চান। কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে ছুটি দিতে রাজি ছিলেন না।
২০১৮: বিসিবির কাছ থেকে অনাপত্তিপত্র না নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজে সিপিএল খেলতে যাচ্ছিলেন সাকিব। মাঝপথ থেকে তাকে ফিরিয়ে আনে বোর্ড। এরপর টেস্ট ও ওয়ানডে দল থেকে অবসর নেয়ার হুমকি দিয়ে সবধরনের ক্রিকেটে ছয় মাস নিষিদ্ধ হন সাকিব।
২০১৯: জুয়াড়ির কাছ থেকে প্রস্তাব পাওয়ার পর সেটি গোপন করায় এক বছর সব ধরনের ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ হন।
২০২১: ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে জৈব সুরক্ষাবলয় ভঙ্গ করে আবার ক্ষমাও চান সাকিব।
২০২১: সালে আবাহনীর বিপক্ষে ম্যাচে আম্পায়ারদের সঙ্গে কয়েক দফা বাজে আচরণের পর মোহামেডান অধিনায়ক সাকিব নিষিদ্ধ হয়েছেন তিন ম্যাচ। জরিমানা গুনতে হবে পাঁচ লাখ টাকাও।
মানবকণ্ঠ/আরএইচটি
Comments