
বাংলাদেশের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীরা এক ভয়ংকর অধিকার বঞ্চনা নিয়ে বসবাস করছে। বঞ্চনার ভয়াবহতা এতোই দীর্ঘ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, থেকে শুরু করে মুখ ফুটে কথা বলার অধিকার পর্যন্ত। সব স্তরে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ওপর অদৃশ্য নিষেধাজ্ঞা, অদৃশ্য শাসন ব্যবস্থা আরোপ রয়েছে। দেশের পার্বত্য চট্টগ্রামসহ পাহাড়ে বসবাস করা জনগোষ্ঠী ব্রিটিশ শাসন আমল থেকে নির্যাতিত, নিপীড়িত এবং স্বাধীনতার পরও তাদের একই ধারার ব্যবস্থায় নির্যাতিত, নিপীড়িত হতে হয়।
বিভিন্ন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীর ওপর সমতলের কিছু সংখ্যক উগ্র সাম্প্রদায়িক জনগোষ্ঠীর মদদে অসংখ্যবার হামলা, নির্যাতন, ধর্ষণ, করা হয়েছে। বেদনাদায়ক বিষয় হলো এই হামলা, হত্যা, পরিসংখ্যান এক হাজার, দু’হাজারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না। নানা সময়ে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায় পাহাড়ে এই পর্যন্ত অজস্র অঘটন ঘটেছে। পাহাড়ে বসবাস করা জনগোষ্ঠীর মতে এর চেয়েও দ্বিগুণ হত্যাকাণ্ড হয়েছে। বাংলাদেশের সমস্ত মুক্তি, সংগ্রামের লড়াইয়ে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সমান অংশগ্রহণ, অবদান ছিল। কিন্তু তারপরও দুঃখের সাথে বলতে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী বঞ্চিত। পাহাড়ে এখনো প্রতিনিয়ত পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে হত্যা, নির্যাতনের শিকার হতে হয়।
অন্যদিকে পাহাড়ে জনগোষ্ঠীর ওপর সাম্প্রদায়িক নির্যাতন, নিপীড়ন করা সেটেলার বাঙালির বসবাস পাহাড়কে আরো অশান্ত করে তুলছে। পাহাড়ে সেটেলার বাঙালিদের স্থানান্তর সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিকভাবে হয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন ১৯০০ খি. আইনে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সমতলের বাঙালিদের এই অঞ্চলে জমি কেনা-বেচা বৈধ ছিল। সে প্রক্রিয়ায় সমতলের বাঙালিদের জমি চাষাবাদের জন্য পাহাড়ে এনেছিলো পাহাড়ি জনগোষ্ঠী। পরবর্তীতে জমি চাষ ও বসবাসের জন্য পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে নানাভাবে প্রভাবিত, নির্যাতিত করে জমি ক্রয় ও দখল করেন। এর মধ্য দিয়ে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ভূমি দখল হতে শুরু করে। যা এখনো চলমান রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে এই সেটেলার বাঙালিদের একটি অংশ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং সে আতঙ্ক স্বাধীনতার ৫৩ বছরে আরো দ্বিগুণ পরিমাণে বেড়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ ও ২৯ নং অনুচ্ছেদ বিশ্লেষণ করে দেখা যায় ধর্ম, বর্ণ, জাত কিংবা জন্মস্থানের বিবেচনায় নাগরিকদের কোনো প্রকার বৈষম্য করতে পারবে না রাষ্ট্র। পাশাপাশি সরকারি চাকরি কিংবা সরকারি সুযোগ সুবিধায় প্রতিনিধিত্বমূলক অংশগ্রহণের লক্ষ্যে বিশেষ আইন ও বিধানের ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে রাষ্ট্রকে।
১৯৮৫ সালে দেশের কোটাব্যবস্থায় প্রথমবারের মতো উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য নামমাত্র ৫ শতাংশ কোটা চালু করা হয়। যা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশার থেকেও একেবারে সংকীর্ণ। বরাদ্দকৃত যে কোটা চালু রয়েছে তার কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কারণ এই কোটার সুফল পাহাড়ি জনগোষ্ঠী সম্পূর্ণভাবে পায় না। এর এক-তৃতীয়াংশ সুফল ভোগ করছে পাহাড়ে বসবাস করা সেটেলার বাঙালি। এই সেটালার বাঙালিরা পাহাড়ের কোটা ব্যবস্থার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশের সরকারি চাকরি থেকে শুরু করে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সরকারি সকল পরিষেবা ভোগ করছে। অর্থাৎ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য যে ক্ষুদ্র কোটাব্যবস্থা নামমাত্র ছিল সেটি সম্পূর্ণ ভোগ করছে সেটেলার বাঙালি জনগোষ্ঠী। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ওপর এই যেন বঞ্চনার সর্বোচ্চ প্রক্রিয়া।
১৯৮৬ থেকে সরকারি চাকরিসহ সমস্ত সরকারি পরিষেবায় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য নির্ধারিত ৫ শতাংশ কোটার উপরি উপরি প্রায় ১ থেকে ৩ অংশ বাদে বাকি ২ অংশ সেটেলার বাঙালিদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। যা শিক্ষা ক্ষেত্রে ৪ শতাংশেই সেটেলার বাঙালি সন্তানদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য সেবায় কোটার সুফল তো দূরে থাক পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য মানসম্মত হাসপাতালও নেই।
গত কয়েকদিন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা মেডিক্যালের ফলাফল নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ব্যাচেলর অব সার্জারি এবং ব্যাচেলর অব মেডিসিনের (এমবিবিএস) ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। উল্লেখ হচ্ছে এই জন্য, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য যে কোটা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। সেটি তাদের চাহিদা অনুযায়ী কম হলেও এটির সম্পূর্ণ ভোগ পাহাড়ি জনগোষ্ঠী করবে। সংবিধান অনুযায়ীও এই কোটার সুফল পাহাড়ি জনগোষ্ঠীরায় ভোগ করবে। তাহলে কেন সেটেলার বাঙালিরা এই সুযোগের অপব্যবহার করছে? পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য নির্ধারিত ৫ শতাংশ কোটায় কি পাহাড়ি জনগোষ্ঠী আসলে সুফল পাচ্ছে? না এই কোটার অপব্যবহার অদৃশ্য শক্তি নিয়ন্ত্রণ করছে?
পাহাড়ের নিয়ন্ত্রণ ও নিয়ন্ত্রয়ক দুটো নিয়মে বিভক্ত একটি অদৃশ্য শক্তি, অন্যটি দৃশ্যমান অপশক্তি যার কোন্দলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন অধিকার বঞ্চনার শিকার। সুতরাং পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের এই বঞ্চনা মুক্তির দাবিও পাহাড়ে নিরাপত্তা ও তাদের নির্ধারিত অধিকারের সঠিক বাস্তবায়ন নিয়ে সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি পাহাড়ের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিয়ে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সাথে আলোচনা করতে হবে। আর এসব পদক্ষেপ গ্রহণে সরকার যদি সময়ক্ষেপণ করে, তাহলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ওপর বঞ্চনা ও অত্যাচারের ভয়াবহতা আরো বাড়বে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
মানবকণ্ঠ/এফআই
Comments