Image description

গত চার বছর ধরে ফ্রিজিং ভ্যান চালাচ্ছেন ২৮ বছর বয়সী মোস্তফা। এর আগে আরও বছর চারেক অ্যাম্বুলেন্স চালিয়েছেন তিনি। বর্তমানে জনি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের হয়ে কাজ করেন মোস্তফা। রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেন রোডে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে ফ্রিজিং কার নিয়ে মরদেহের অপেক্ষায় থাকেন চালক মোস্তফা। 

নিজের ফ্রিজিং ভ্যানে চালকের আসনে বসে তিনি বলেন, কারও কাছ থেকে ফোন কল এলেই কেবল আমি একটা ট্রিপ দিতে পারব। এখন খুব কম লোকই অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশ বাড়িতে নিয়ে যায়; গরমে তারা ফ্রিজিং ভ্যানে নিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। দেশজুড়ে ক্রমেই বাড়ছে তাপমাত্রা। উচ্চ তাপমাত্রার মধ্যে ভালো থাকে না মরদেহ। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন উন্নত ও দ্রুতগতির না হওয়ায় গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে বাড়তি সময় লেগে যায়। এতে গরমের কারণে পথেই পচন ধরে যায় মরদেহ। ফলে ফ্রিজিং ভ্যানের দিকে ব্যাপকহারে ঝুঁকছেন মৃত ব্যক্তির লোকজনরা। 

বাংলাদেশ অ্যাম্বুলেন্স ওনার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি গোলাম মোস্তফা বলেন, অতীতের চেয়ে এবারের বছরগুলোতে দেশে বেশি তাপমাত্রা দেখা যাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে এ ধরনের লাশবাহী ভ্যানের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। চাহিদা বাড়ার একটা অন্যতম কারণ হচ্ছে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা। উচ্চ তাপমাত্রায় মরদেহ ভালো অবস্থায় রাখা কঠিন। তিনি আরও বলেন, চাহিদা বাড়ার কারণে কোম্পানিগুলো ফ্রিজিং ভ্যান আমদানি বাড়িয়েছে। গরমের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে ঢাকা শহরে সবচেয়ে বেশি ফ্রিজিং ভ্যান পার্ক করা থাকে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালের সামনে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মিরপুর-২-এ জাতীয় হৃদরোগ ফাউন্ডেশন, মুগদা হাসপাতালসহ শহরের আরও অনেক হাসপাতাল এলাকাতেও এসব ফ্রিজিং ভ্যান দেখা যায়। কিন্তু গত এক দশকে এই চিত্র আরও অনেক বদলে গেছে। বর্তমানে ঢাকা শহরে প্রায় ২০০টি ফ্রিজিং ভ্যান চলাচল করে। 

অ্যাম্বুলেন্স সেবাদাতারা জানান, মরদেহ বহনের জন্য ফ্রিজিং ভ্যানের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। গরম মৌসুম গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ফ্রিজিং ভ্যান আনা শুরু হয়েছে। অ্যাম্বুলেন্স সেবাদাতারাও এখন ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে তাদের অ্যাম্বুলেন্স বহরে লাশবাহী ফ্রিজিং ভ্যান যুক্ত করেছে। শীতের দাপট কেটে দেশজুড়ে শুরু হচ্ছে তীব্র গরম মৌসুম। এ মৌসুমে দূরবর্তী জেলায় মরদেহ নিয়ে গেলে পচনের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাছাড়া অনেক সময় আত্মীয়-স্বজনরা দাফনের আগে দু-একদিন লাশ রাখতে চায়, যাতে দূরের বা দেশের বাইরে থাকা আত্মীয়রা এসে মৃত ব্যক্তিকে শেষবারের মতো দেখতে পারে। সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এসব ভ্যান ভাড়া করে। তবে ধনী পরিবারই তুলনামূলক ফ্রিজিং ভ্যানে মরদেহ নিয়ে থাকে বেশি। পাবলিক ইমার্জেন্সি হেল্পলাইন ৯৯৯-এ ডায়াল করে ফ্রিজিং ভ্যান বা অ্যাম্বুলেন্স নেয়া যায়। অনলাইনভিত্তিক অ্যাম্বুলেন্স সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানও আছে বেশ কিছু। লাশবাহী ফ্রিজিং ভ্যানের ভাড়া অ্যাম্বুলেন্সের চেয়ে বেশি। 

অ্যাম্বুলেন্স সেবাদানকারী কোম্পানি টুয়েন্টিফোর অ্যাম্বুলেন্সের ওয়েবসাইটে দেয়া মূল্য তালিকায় বলা হয়েছে, ঢাকা থেকে সাভারে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করলে ৩ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হবে। কিন্তু লাশ বহনকারী ফ্রিজার ভ্যান নিলে ভাড়া পড়বে চার হাজার টাকা। দীর্ঘ দূরত্বের জন্য ভাড়া বেশি আসে। ঢাকা থেকে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া যেতে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ১৬ হাজার টাকা ভাড়া গুনতে হয়। ফ্রিজিং ভ্যানের ক্ষেত্রে ভাড়া গুনতে হয় ২২ হাজার টাকা। তবে বাড়তি খরচ আছে। অনেকে এক বা দুই দিন লাশ রাখার জন্য ফ্রিজিং ভ্যান ভাড়া করে। সেক্ষেত্রে কোম্পানি প্রতি ঘণ্টায় ওয়েটিং চার্জ হিসেবে অন্তত ৫০০ টাকা নেয়। রেন্ট-এ-কার ব্যবসার মতোই অ্যাম্বুলেন্স সেবা প্রদানকারীরাও ছোট ব্যবসায়ী। তাদের বেশ কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারত্ব থাকে। এদের মধ্যে একজন মোহাম্মদ শাহাদাত ২০১৭ সালে একটি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। 

তিনি বলেন, শহরের ভেতরে সার্ভিস চার্জ আড়াই হাজার টাকা এবং ওয়েটিং চার্জ প্রতি ঘণ্টায় ৫০০ টাকা। শাহাদাত বলেন, এই গাড়িগুলো জাপান থেকে আমদানি করা হয়। আর একটা সিঙ্গেল ফ্রিজিং ভ্যানের দাম প্রায় ৩০ লাখ টাকা। ২০১২ সালে বাংলাদেশে প্রথম ফ্রিজিং ভ্যান নিয়ে আসে আলিফ অ্যাম্বুলেন্স। মালিক মমিন আলী বলেন, মানুষ যাতে তাদের মৃত আত্মীয়ের সঙ্গে আরেকটু বেশি সময় কাটাতে পারে। মরদেহে পচন ধরার ভয়ে শঙ্কিত না হয়, সেজন্য আমি ফ্রিজিং ভ্যান কিনেছি। আলিফ অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের স্বত্বাধিকারী মমিন বলেন, প্রায়ই এমন হয় যে, আমরা গাড়ি দিতে পারছি না। কারণ গাড়ি ফ্রি থাকে না। আমাদের ছয়টা ফ্রিজিং গাড়ি। প্রতিদিন গড়ে ৬-৮টা লাশ বহন করে। ঢাকার মধ্যে দেখা যায় দিনে ২-৩ বারও বহন করতে হচ্ছে।

মানবকণ্ঠ/আরএইচটি