
সামাজিক মাধ্যমকে অনেকেই খুব গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চান না। দায়িত্বহীন অনেক কথা সামাজিক মাধ্যমে আবেগে পরিপূর্ণ হয়ে প্রকাশিত হয় বলে তাদের কাছে এই মাধ্যমের গুরুত্ব খুব বেশি নেই। সকল শ্রেণি, পেশা, বর্ণ, ধর্ম, উদার, রক্ষণশীল, মৌলবাদী, মানবতাবাদী-সহ পৃথিবীর সকল ধরনের মানুষের মতামত আপনি পাবেন সামাজিক মাধ্যমে। মনে রাখতে হবে প্রতিটি মানুষ অনন্য। এই যে এত মানুষের মতামত স্বতঃস্ফূর্তভাবে সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, যেখানে শুধু আবেগ থাকে না, যুক্তি ও ভালোবাসা দিয়ে অনেকে আন্তরিকভাবে তাদের মনোভাব প্রকাশ করে থাকেন।
মূলধারার মাধ্যম থেকে সংখ্যায় বেশি সৃজনশীল লেখা সামজিক মাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে থাকে। তবে সৃজনশীলতার মান বিবেচনা দুরূহ। সামাজিক মাধ্যমের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্লাটফর্ম হলো ফেসবুক, সেখানে মানবতার বাণী যেমন প্রতিফলিত হয় একইভাবে হিংসা-বিদ্বেষও ছড়ানো হয় বিরামহীনভাবে। এত শ্রেণি, এত পেশার মানুষের বৈচিত্র্যপূর্ণ ধারণাকে যারা এড়িয়ে যাওয়ার কথা বলেন তারা কী যথেষ্ট বিবেচনা প্রসূত কাজ করে থাকেন? যুক্তিবাদী, উদার মানুষ সকল মানুষের মতামতকে আগ্রহ নিয়ে শুনে থাকেন। মানুষের মনোভাব এবং ধারণাকে অবজ্ঞা করা অনুদার মানসিকতার পরিচায়ক।
নীতিবিদ্যায় একটি কথা আছে, একটি ধারলো চাকু যখন একজন দক্ষ শৈল চিকিত্সকের হাতে পড়ে তখন সেই চাকু দিয়ে মানুষের জীবন রক্ষা করা হয়। ওই চাকুটি যখন অসৎ ছিনতাইকারী কিংবা হিংস্র মানুষের হাতে পড়ে তখন চাকুটি জীবন এবং সম্পদের জন্য হুমকি হয়ে পড়ে। চাকুটি দিয়ে জীবন রক্ষার কাজ নীতিবিদ্যার ধারণা অনুযায়ী ‘নৈতিক’ এবং দ্বিতীয় কাজটি নীতিবিদ্যার আলোকে সম্পূর্ণ ‘অনৈতিক’। সামজিক মাধ্যম কে যদি আমরা এভাবে বিবেচনা করি তাহলে সেটি নির্দোষ চাকুটির মতো। মানুষের নৈতিক, অনৈতিক মানসিক চিন্তার প্রতিফলনের স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয় মাধ্যমটি, মাধ্যমের নিজস্ব কোনো উদ্দেশ্যের প্রতিফলন ঘটে না উপস্থাপিত কোনো বিষয়ে।
সামাজিক মাধ্যম বিষয়টির স্বরূপ নিয়ে খুব বেশি আলোচনার প্রয়োজন নেই বহমান সময়ে। সকল শ্রেণির পাঠকের কথা বিবেচনা করে কিছুটা ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ঠিকুজি অন্বেষণ করলে দেখা যায় ১৮৪৪ সালের মে মাসের ২৪ তারিখে, স্যামুয়েল মোর্স বাল্টিমোর থেকে ওয়াশিংটন ডিসিতে প্রথম যে টেলিগ্রামটি পাঠিয়েছিলেন সেটি হলো সামাজিক যোগাযোগের প্রথম কার্যকর চেষ্টা। ডট ও ড্যাশের মাধ্যমে তিনি সেদিন লিখেছেন ‘ঈশ্বর কী করেছেন’। এই যোগাযোগের ১৮০ বছরের মধ্যে যোগাযোগমাধ্যমে ঘটে যায় যুগান্তকারী এক বিপ্লব। ভাবতে অবাক লাগে জাদুকরী উপায়ে প্রযুক্তিবিদরা সারা বিশ্বকে একটি মাত্র সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি কিংবা এর থেকেও ছোট পর্দার মধ্যে স্থান দিতে সক্ষম হয়েছে। আমরা যে বলি “গ্লোবাল ভিলেজ” বা ভূ-গ্রাম সেই ভূ-গ্রামকে গড়তে সব চেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে সোশ্যাল মিডিয়া বা সামজিক মাধ্যম। সমগ্র পৃথিবীকে আজ এক সুতোয় বেঁধে নিয়েছে ফেসবুক, টুইটার, লিংকডইন সহ নানা নামের প্লাটফর্ম। সামাজিক মাধ্যমে কী শুধুই সামাজিক যোগাযোগ ঘটে।
সামাজিক মাধ্যম এখন রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি সহ মানুষের জীবনের সকল যোগাযোগকে সজীব করে তুলতে সহায়তা করে। শুধু কী সজীব? একই সাথে এসব বিষয়কে ধূসর করে তুলাতেও সামাজিক মাধ্যমের বিশাল প্রভাব রয়েছে। প্রথম সোশ্যাল মিডিয়া বা সামজিক মাধ্যম কোনটি? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে দুটি সাইটের নাম বলতে হয়; প্রথমটি জিওসিটি ও অন্যটি সিক্সডিগ্রি। তবে ১৯৯৭ সালে তৈরি করা সিক্সডিগ্রিস ডটকম-কেই অধিকাংশ মানুষ প্রথম সোশ্যাল মিডিয়া হিসেবে বিবেচনা করে। সিক্সডিগ্রিস ব্যবহারকারীরা তাঁদের কাছের লোকেদের সাইটে নিবন্ধিত করতে পারত এবং তাদের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ডিগ্রি, এভাবে বিভাজন করতে পারত।
পরে ২০০১ সালে ফ্রেন্ডস্টার আসে, যার সঙ্গে খুব অল্প দিনের মধ্যেই কয়েক মিলিয়ন ব্যবহারকারী যুক্ত হয়। ২০০২ সালে লিংকডিন প্রতিষ্ঠিত হয়, ক্যারিয়ারের প্রতি মনোযোগী পেশাদারদের এক প্লাটফর্মে নিয়ে আসার উদ্দেশ্য নিয়ে। বর্তমানে এই লিংকডিনে প্রায় ৭৪০ মিলিয়ন লোক প্রতিনিয়ত চাকরি খুঁজছে, চাকরি দিচ্ছে কিংবা নিজের দক্ষতা বৃদ্ধিতে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। ২০০৩ সালে মাইস্পেস আসার পর ২০০৬ সালে এটি হয়ে ওঠে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ভিজিট করা সাইট। কিন্তু ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠা পাওয়া ফেসবুক সব ধরনের সোশ্যাল মিডিয়াকে ছাড়িয়ে গিয়ে নিজের শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে নেয়।
সামাজিক মাধ্যমের প্রতি আমরা যতোই নাক-সিটকাই না কেনো, যে কোন সমাজ চিন্তকের জন্য সামাজিক মধ্যম হলো সমাজ বিশ্লেষণের একটি উর্বর ও যথাযথ ক্ষেত্র। মূল ধারার মাধ্যম গুলো এখন কোন না কোন ভাবে পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়েছে। অর্থাত্ মূলধারার মাধ্যম গুলোর বিষয় বা কন্টেন্ট বিশ্লেষণ করে যুক্তিসঙ্গগত উপসংহারে পৌঁছা অসম্ভব নয় তবে বেশ কঠিন। তবে কোন সমাবিজ্ঞানী যদি সমাজের মানুষের অকৃত্রিম চিন্তা চেতনার স্বরূপ অন্বেষণ করতে চান তাহলে সামাজিক মাধ্যমকে নিজস্ব প্রক্রিয়ায় বিশ্লেষণ করে উপসংহারে পৌঁছুতে পারবেন বলে সকলেই মনে করেন।
বাংলাদেশের মানুষের সামজিক এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির মান নির্নয় করতে হলে সামজিক মাধ্যমে বিশেষ করে ফেসবুকে মনোযোগ দিয়ে ডুব দিতে পারলে কিছুটা ধারণা পাওয়া সম্ভব। মূলধারার সংবাদপত্রে কিংবা ইলেক্ট্রোনিক চ্যানেলে সাধারণ পাঠকদের মনোভাব প্রকাশের স্থান সীমিত থাকার কারণে হাতের মুঠের ভেতরে থাকা স্বাধীন সামাজিক মাধ্যমে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের মনোভাবকে প্রকাশ করে থাকেন। যে কোনো বিষয়ে সাধারণ মানুষের মতামত সম্পর্কে অনেকটা ধারণা পাওয়া যায় সামাজিক মাধ্যমে।ওই যে “চাকু”র ব্যবহারের কথা বলা হলো এর মতোই সারা পৃথিবীকে সামাজিক মাধ্যম যেমন বন্ধন সৃষ্টির চেষ্টা করে যাচ্ছে একইভাবে সামাজিক মাধ্যম ঘৃণা, বিদ্ধেষ ছড়িয়ে এক ধরনের তথ্য বিভ্রান্তিরও জন্মদিচ্ছে।
তথ্য প্রাপ্তি মানুষের মৌলিক অধিকার। সামাজিক মাধ্যমে এই মৌলিক অধিকার নিয়ে ছেলে খেলা হচ্ছে বিরামহীনভাবে। সামাজিক মাধ্যমের অপার স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও গুজব এবং হিংসা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। সহজ, সরল সাধারণ মানুষ এসব গুজবকে বিশ্বাস করে নিজেদের মধ্যে হিংস্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হচ্ছেন। এসব গুজব হিংসা সৃষ্টিকারী বার্তা সমাজকে ভারসাম্যহীন এবং অমানবিক করতে সাহয্য করছে। যে কোনো বিষয়ের অন্তর্নিহিত কারণ না জেনে মানুষ নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাচ্ছে। সমাজে মানুষ একধরনের বিভ্রম, বিভ্রান্তিতে বসবাস করে সেই পরিবেশকে সঠিক বলে মনে করছে। দড়িকে সাপ ভেবে মানুষ যেমন বিভ্রান্ত হয় একইভাবে নিরপরাধ মানুষকে অপরাধী ভেবে ভেতরে বিদ্বেষ পোষে রাখে। এরকম বিদ্বেষ কখনো কখনো প্রতিবেশীকে শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে। বাংলাদেশে সামজিক মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক সংঘাত তৈরির মতো পরিবেশও তৈরি করা হয়েছে বেশ কয়েকবার।
গণতন্ত্রে মতভিন্নতা থাকা খুব স্বাভাবিক। ভিন্ন মতকে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য বলে বিবেচনা করা হয়। গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেলে একটি সমাজে বসবাসরত মানুষের সহিষ্ণুতা বেড়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে এবং অব্যবহিত পরে রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের মধ্যে আদর্শিক ভিন্নতা থাকলেও পরস্পরের প্রতি চরম হিংসা, হিংস্রতা প্রদর্শন করতে দেখা যায়নি। রাজনৈতিক অঙ্গনে হিংসা ছড়িয়ে দেশে অনৈক্য বিভাজন সৃষ্টিতে আমরা সামাজিক মাধ্যমের প্রভাব সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করছি। রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরিতে সামাজিক মাধ্যমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে নানা গোষ্ঠী। সামাজিক মাধ্যমে হিংসা ছড়াতে গিয়ে যেসব শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে তা পাঠ করলে আমাদের সামাজিক সংস্কৃতির নিম্নমানকে অনুধাবন করতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়না। আমরা কী এভাবে অন্ধকারের কালো গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হব?
আমাদেরকে প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে। সমাজের অভিভাবকরা যদি সামজিক মাধ্যমকে অবজ্ঞা করে, চোখ বন্ধ করে রাখেন তাহলে কিন্তু প্রলয়ের কাছাকাছি গিয়ে সজীব জীবনে ফেরত আসা সম্ভব হবে না। সামাজিক মাধ্যম যেন সমাজের জঞ্জাল দূর করার হাতিয়ারে পরিণত হয়; এজন্য শুধু সরকার নয় আমাদের নাগরিক সমাজকেও বিচক্ষণতার সাথে এগিয়ে আসতে হবে।
সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার নিরঙ্কুশ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে আমরা যেন কুসংস্কার থেকে মুক্ত হতে পারি সে চেষ্টায় ব্রতী হতে হবে। আমাদের তরুণ সমাজকে বাঙালির চিরায়ত মূল্যবোধে জাগ্রত করা কঠিন কোন কাজ নয়, সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে সে লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব। জাতীয়ভাবে মানুষের স্বাধীনতা হরণ না করে আমাদের একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা প্রণয়ন খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এই প্রয়োজনীয় কাজটি খুব দ্রুত করা উচিত। শুভস্য শীঘ্রম।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক
মানবকণ্ঠ/এফআই
Comments