
জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও সংস্কার ইস্যুতে পূর্বে এক ধরনের ঐকমত্য থাকলেও সম্প্রতি দুই দলের মধ্যে দূরত্ব ও টানাপোড়েন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন, পিআর পদ্ধতিতে সংসদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন দাবিতে জামায়াত, এনসিপি, খেলাফত মজলিস ও ইসলামী আন্দোলনসহ আটটি দলের যুগপৎ আন্দোলনের পরিকল্পনা থাকলেও গত সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) জামায়াতসহ চারটি দল যুগপৎ বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করলেও তাতে এনসিপি অনুপস্থিত। এই দূরত্বের পেছনে রাজনৈতিক কৌশল, দলের অভ্যন্তরীণ মতপার্থক্য ও নির্বাচনি জোট নিয়ে অস্পষ্টতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
যুগপৎ আন্দোলন থেকে এনসিপির সরে দাঁড়ানো
গত কয়েক মাস ধরে জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও নির্বাচন সংস্কার নিয়ে ঐকমত্য থাকলেও এনসিপি শেষ পর্যন্ত জামায়াতের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যোগ দেয়নি। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ও নেজামে ইসলাম পার্টির একাংশ আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু করলেও এনসিপি, গণ অধিকার পরিষদ ও আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি এতে অংশ নিচ্ছে না।
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, “সংস্কারের সব দাবিতে আমরা একমত নই এবং নির্বাচনি জোট নিয়ে নানা অস্পষ্টতা থাকায় আপাতত জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধতার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি এনসিপি।” তিনি আরও জানান, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ও খেলাফত মজলিস সংসদের উচ্চ ও নিম্ন উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতি চায়, কিন্তু এনসিপি শুধু উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতির পক্ষে। এই মতপার্থক্য যুগপৎ আন্দোলনে না যাওয়ার অন্যতম কারণ।
এনসিপির অভ্যন্তরীণ মতপার্থক্য
এনসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির কয়েকজন নেতা ও দলের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, নির্বাচন সংস্কার ও জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে দলের মধ্যে দুটি স্পষ্ট ধারা তৈরি হয়েছে। একটি অংশ ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে জোটে যাওয়ার বিরোধিতা করছে, বিশেষ করে গণ অভ্যুত্থানের পর দলটিতে যোগ দেওয়া বাম ঘরানার তরুণদের একাংশ। এই গ্রুপ জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠনে আপত্তি জানাচ্ছে।
এনসিপির একজন সিনিয়র নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “জামায়াতের সঙ্গে জোট করে এবার ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব হলে আমরা সেটা করতাম। কিন্তু জামায়াতের সঙ্গে ভোট করে বিরোধী দল হলে দীর্ঘমেয়াদে আমরা রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হব। এটি আমাদের নীতিগত অবস্থান।”
অন্যদিকে, দলের ইসলামপন্থী অংশ ও বাম বলয়ের মধ্যে মতবিরোধ আরও স্পষ্ট হয়েছে সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ফলাফলের পর। এই নির্বাচনে এনসিপির সমমনা ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) ভরাডুবি করে, আর জামায়াত সমর্থিত ইসলামী ছাত্রশিবির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। এই ফলাফল এনসিপির শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে হতাশা তৈরি করেছে।
জুলাই সনদ নিয়ে মতপার্থক্য
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর টানা আলোচনা চলছে। এই সংস্কার প্রস্তাবের বেশ কিছু বিষয়ে বিএনপির দ্বিমত থাকলেও জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলনের মধ্যে অনেকটা কাছাকাছি অবস্থান ছিল। জামায়াত ও এনসিপি এমনকি সনদ বাস্তবায়নে গণভোট বা গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিও তুলেছিল। তবে, জুলাই সনদের কিছু দাবি, বিশেষ করে পিআর পদ্ধতির ব্যাপ্তি নিয়ে এনসিপির সঙ্গে জামায়াতের মতপার্থক্য স্পষ্ট হয়েছে।
জামায়াত পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলন ঘোষণা করলেও এনসিপি এই দাবিগুলোর সবকটির সঙ্গে একমত নয়। ফলে তারা যুগপৎ আন্দোলন থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
নির্বাচনি জোট নিয়ে অস্পষ্টতা
জামায়াতে ইসলামী তার মিত্র দলগুলোর সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের পাশাপাশি আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে বিএনপি-বিরোধী বৃহত্তর রাজনৈতিক সমঝোতা গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এই জোটে এনসিপির অংশগ্রহণ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা চলছে। গত কয়েক মাসে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে এনসিপির সখ্যতা দেখে ধারণা করা হচ্ছিল যে, তারা জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনি জোট গঠন করতে পারে। তবে, এনসিপি এখনই কোনো জোটে যাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়নি।
দলের একাংশের নেতারা জানান, বর্তমানে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে জোট গঠনের বিরোধিতা করছে দলের বাম ঘরানার নেতাকর্মীরা। এই মতপার্থক্যের কারণে এনসিপি জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনি সমঝোতা থেকে পিছু হটেছে।
ছাত্র নির্বাচনের প্রভাব
ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বাগছাসের পরাজয় এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাফল্য এনসিপির মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। এই ফলাফলের পর শনিবার রাতে অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ফেসবুকে একটি পোস্টে লেখেন, “বাংলাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে আরেকটি ‘ছায়া মওদুদীবাদী’ দল প্রয়োজন নেই।” তিনি স্পষ্ট করে কোনো দলের নাম উল্লেখ না করলেও অনেকে মনে করছেন, এটি এনসিপি ও জামায়াতের সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে লেখা।
এনসিপির ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, ছাত্র নির্বাচনের ফলাফল এবং দলের বাম ও ইসলামপন্থী অংশের মধ্যে মতবিরোধ এনসিপির জামায়াত-বিরোধী অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছে। দলের বাম বলয় জামায়াতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থেকে সরে আসার পরামর্শ দিচ্ছে।
রাজনৈতিক কৌশল নাকি দীর্ঘমেয়াদি অবস্থান?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এনসিপির এই অবস্থানকে কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিশ্লেষক রাশেদা রওনক খান বলেন, “লক্ষ্যের জায়গা এক হলেও লক্ষ্য অর্জনের পর বিভিন্ন স্বার্থ ও মতাদর্শগত পার্থক্যের কারণে দূরত্ব তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। এনসিপি একটি নতুন দল, যেখানে বিভিন্ন মতাদর্শের তরুণরা রয়েছে। তাদের মধ্যে মতবিরোধ থাকাটা স্বাভাবিক। এটি তাদের রাজনৈতিক কৌশল হতে পারে।”
তবে, তিনি আরও বলেন, “ভোটের সময় ঘনিয়ে আসলে এনসিপির অবস্থানে পরিবর্তন আসতে পারে। এটি দলের মধ্যে মতাদর্শগত পার্থক্য বা রাজনৈতিক কৌশলের ফলাফলও হতে পারে।”
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের মনে করেন, এনসিপির সঙ্গে জামায়াতের অনেক দাবির মিল রয়েছে। তিনি বলেন, “আপাতত তারা কোনো কর্মসূচিতে না গেলেও পরবর্তীতে তাদের অবস্থান বদলাতে পারে।”
এনসিপির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব জানান, “জামায়াতের সঙ্গে এখন আমাদের দূরত্ব বা সখ্যতা কোনোটিই নেই। শিগগিরই তাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের সম্ভাবনাও নেই। আমরা আপাতত নিজস্ব রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের পরিচিত করার চেষ্টা করব।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এনসিপির এই অবস্থান রাজনৈতিক মাঠ বুঝে নেওয়া কৌশল হতে পারে। তবে, নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসলে দলটির অবস্থানে পরিবর্তন আসতে পারে, বিশেষ করে জুলাই সনদ ও নির্বাচন সংস্কারের ইস্যুতে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
Comments