
খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। স্মরণকালের মধ্যেই আমরা দেখেছি-ছোট ছোট চিংড়ি মোয়া, কাচকি, বারো মিশেলি ছোট মাছ ব্যবসায়ীরা ভাগা করে বিক্রি করছেন। নিম্নবিত্তদের সামর্থ্য অনুযায়ী দু-এক ভাগা বা তার চেয়েও বেশি ভাগা নিতে দেখেছি। বড় বড় সুস্বাদু মাছও, বিশেষ করে ইলিশ, বড় বড় পাঙাশ, রুই, কাতলা মাছ ইত্যাদি টুকরো করে ভাগা হিসেবে বিক্রি করারও প্রচলন ছিল; ধনী-গরিব সবাই যাতে কিনতে পারে, সেজন্য।
এখন সব ধরনের মাছের দাম নিম্নবিত্তদের ক্রয়-ক্ষমতার বাইরে গেলেও মাছের সেই ভাগাগুলো আর চোখে পড়ে না। অথচ মাছের এই দুর্মূল্যের বাজারে এ ধরনের ভাগা মাছের প্রয়োজন এখন সবচেয়ে বেশি। শুধু যে মুখের স্বাদ মেটানোর জন্য এটা প্রয়োজন, তা নয়, শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টি যোগান দেয়ার জন্যও প্রয়োজন। কারণ একটি সুষম খাদ্যের মাধ্যমে শরীর প্রয়োজনীয় ভিটামিন, খনিজ, প্রোটিন, শর্করা এবং চর্বি পায়, যা শারীরিক বৃদ্ধি, শক্তি উৎপাদন, রোগ প্রতিরোধ ও সুস্থ জীবন যাপনের জন্য অপরিহার্য।
যে কোনো একটি খাবার সব পুষ্টি সরবরাহ করতে পারে না। তাই বিভিন্ন ধরনের খাবার গ্রহণ করা জরুরি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর তথ্যানুযায়ী দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে ১৯.২ শতাংশ মানুষ। চলতি বছরের মধ্যে জাতীয় দারিদ্র্যের হার ২২.৯ এবং চরম দারিদ্র্যের হার ৯.৩ শতাংশে পৌঁছতে পারে বলে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
দারিদ্র্যের হার বাড়া মানে দরিদ্রজনের পর্যাপ্ত ও পুষ্টিযুক্ত খাবারের ক্রয়-ক্ষমতাও কমে যাওয়া। বাংলাদেশের একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য দৈনিক আমিষ লাগে ৩৩-৬৬ গ্রাম। আর গর্ভবতী মা যদি প্রয়োজনীয় পরিমাণ আমিষ না পান, তাহলে তার পেটের শিশুটির বিকাশ ধীরগতিতে হয়। বিশেষ করে আমিষের অভাবে শিশুদের মস্তিষ্ক ঠিকমতো বিকাশ লাভ করে না।
এটি শুধু বিত্তবান বা মধ্যবিত্তদের জন্য নয়, দরিদ্রজনদেরও প্রয়োজন ও অধিকার। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যের কারণে আমিষের চাহিদা পূরণ করতে পারেন না। যেখানে তিন বেলা পেট পুরে খাওয়ারই সামর্থ্য নেই অনেকের, সেখানে প্রয়োজনীয় আমিষের কথা ভাবা তাদের কাছে আকাশ-কুসুম কল্পনার মতো। নিম্নবিত্তের জন্য আমিষের এ দুরবস্থা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে তেমনটা নেই।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়- ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, এমনকি তামিলনাড়– রাজ্যেও ১০০/২৫০ গ্রামের মাছ মাংস কেনার সুযোগ আছে। আমাদের দেশে তো এমন পরিবারের সংখ্যাই বেশি, যাদের ছয় মাসে, এমনকি কোরবানি ঈদের আগে পর্যন্ত মাংসের মুখ দেখার সুযোগ তাদের হয় না বললেই চলে। প্রতিবছর এত এত ইলিশ ধরা পড়ার খবর পাওয়া যায় কিন্তু কয়জন ঘাম ঝরানো দিনমজুর, শ্রমিক সেসব ইলিশ খেতে পারে? দাম সাধ্যের মধ্যে না থাকলে পারবে কী করে? এখন ইলিশের ভরা মৌসুমেও আধা কেজি ওজনের ইলিশের দামও হাজার টাকা।
এক কেজি ওজনের ইলিশের দাম ২০০০ টাকারও বেশি। বিত্তবানরা সহজেই আর মধ্যবিত্তরা কিছু প্রয়োজন কাঁটছাট করে ইলিশের স্বাদ কিছুটা নিতে পারলেও ঘাম ঝরানো শ্রমজীবী, দিনমজুর রিকশাওয়ালাদের কাছে এর স্বাদ নেয়া এখনও অনেকটা স্বপ্ন হয়েই রয়েছে। যদি বাজারে কিছু ইলিশ কেটে ১০০/১৫০ গ্রাম করে ভাগা আকারে বিক্রি করা হতো, তাহলে হয়তো একজন রিকশাচালক বা দিনমজুর তার সন্তান বা বৃদ্ধ মা-বাবার জন্য দু-এক ভাগা কিনে নিতে পারতো।
মাংস বাজারের অবস্থাও মাছের মতোই। নি¤œবিত্তের বড় ভরসা যে ব্রয়লার মুরগি, তার দাম আগে নাগালের মধ্যে ছিল বলে তাদের পাতে মাঝেমধ্যেই মাংস উঠতো কিন্তু এখন সেই ব্রয়লারের কেজি প্রায় ২৫০ টাকা, যা তাদের নাগালের বাইরে। গরুর মাংস এখনও ৭০০/৮০০ টাকা কেজি। খাসির মাংসের কেজি ১১০০/১২০০ টাকা। এক কেজি গরু বা খাসির মাংস কেনার কথা তো নিম্নবিত্তের মানুষ ভাবতেই পারেন না।
কম পরিমাণে বিক্রি না হওয়ার কারণে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ সন্তানদের আবদার পূরণ করতে অনেকেই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর জন্য গরুর মাথার কিছু অংশ, কলিজা, ফুসফুস, ভুঁড়ি কিনে বাড়ি ফেরে। এই বাস্তবতায় দেশের কিছু কিছু জায়গায় মাছ মাংস ভাগা আকারে বিক্রির ব্যবস্থা চালু হওয়ার খবর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামের চকবাজারের কাঁচাবাজারে টুকরো হিসেবে মুরগির মাংস বিক্রি হওয়া, খুলনা নগরীর পাশে হরিণটানা গ্রামে ইমন নামে এক দোকানির অল্প ওজনের গরুর মাংস ভাগা আকারে বিক্রি শুরু করার খবর।
তখন লিমা বেগম নামের একজন ক্রেতা বলেছিলেন- বাজারে ৭০০ টাকা দিয়ে এক কেজি গরুর মাংস কেনার সামার্থ্য তাদের নেই। যেখানে কোথাও আধা কেজির কম গরুর মাংস বিক্রি হয় না, সেখানে এই দোকানে কম পরিমাণে মাংস বিক্রি হওয়ায় তারা সাধ্যমতো গরুর মাংসের স্বাদ নিতে পারছেন। পাশের দোকানেও ঝোলানো ব্যানারে লেখা ছিল, ‘এখানে মুরগির মাংস পিস হিসেবে বিক্রয় করা হয়’। পিস কিংবা ভাগা- যে আকারেই বিক্রি হোক, এটি যে অতি দরিদ্র মানুষের সাধ্য অনুযায়ী মাছ মাংস পাওয়ার সহজলভ্য সুযোগ, তা অস্বীকার করা যাবে না।
এটি সর্বত্র প্রচলিত হলে আশা করা যেতেই পারে- স্বল্প আয়ের মানুষের পাতেও মুরগি ও গরুর মাংস দু-এক পিস করে হলেও উঠবে। প্রকাশিত খবর থেকেই জানা যায়- কম ওজনের মাংস বিক্রির সময়োপযোগী এই আইডিয়াটি রংপুর সিটি কর্পোরেশনও গ্রহণ করেছিল। একজন ক্রেতা তার যতটুকু সামর্থ্য বা প্রয়োজন ততটুকুই যেন মাংস কিনতে পারেন-সেই ব্যবস্থা চালু হয়েছিল সেখানে। বর্তমান বাস্তবতায় এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা এখন আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে।
স্বল্প আয়ের মানুষের পাতে যেন নিয়মিত মাছ মাংস ওঠে সেটি বিবেচনায় নিয়ে উপরে বর্ণিত দৃষ্টান্তগুলো অনুসরণ করে সরকার দেশের সর্বত্র মাছ মাংস কেজি দরে বিক্রির বর্তমান ব্যবস্থা অক্ষুণ্ন রেখেই পাশাপাশি পিস বা ভাগা আকারেও বিক্রির ব্যবস্থা চালু করার ব্যবস্থা নিতে পারেন। বিক্রেতারা যেন ভাগা আকারে ইলিশসহ মাছ মাংস বিক্রি করতে অনীহা প্রকাশ না করেন, সেটা নিশ্চিত করতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ প্রশাসনের সহায়তা দরকার। প্রয়োজন মাছ মাংস ব্যবসায়ীদের সহযোগিতাও। এই সহযোগিতা নিয়ে সংশ্লিষ্ট সকল মহল এগিয়ে এলে নিম্নবিত্তের অসংখ্য মানুষ এসব সুস্বাদু মাছ মাংসের স্বাদ যেমন সারা বছরই নিতে পারবেন, তেমনি তাদের আমিষের ঘাটতিও অনেকটা পূরণ হবে- এমন আশা করাই যায়।
লেখক: কবি, কথাশিল্পী ও কলামিস্ট।
Comments