Image description

গত ৫ আগষ্ট পতন হলো স্বৈরশাসক হাসিনার। তিনি ছিলেন একজন ফ্যাসিবাদি নেত্রী। শেখ হাসিনা ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠেছিলেন তার চার পাশে ঘিরে থাকা সহয়োগীদের দ্বারা। বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি  গণঅভ্যুত্থান ঘটেছে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা দূর করার জন্য। বাংলাদেশ থেকে ফ্যাসিবাদ দূর হয় না, বার বার নতুন রূপে শানযন্ত্রের স্ট্যায়ারিং চেপে বসে ফ্যাসিবাদী ব্যক্তিরা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ফ্যাসিবাদ পতনের পর ফ্যাসিবাদী নেতা ও তার গুটিকয়েক সহযোগী দণ্ডপ্রাপ্ত হন। অন্য যারা ফ্যাসিবাদের সহযোগী ছিলেন, তাদের অনেককে দেখা যায় নতুন করে গঠিত সরকারে স্থান পায়। 

এই কারণে দেশ থেকে ফ্যাসিজম বা স্বৈরশাসকের মূল উৎপাটন করা হয় না। অসংখ্য শহীদের রক্তের বিনিময়ে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান ঘটেছিল, পতন হয়েছিল সেনাশাসক এরশাদের। এরশাদ জেল খাটেন। তার সাথে তার গুটিকয়েক সহযোগী সাজা পায়। আর কিছু সহযোগী আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে ঠাঁই নিয়ে নেয়। এ রকম যদি হয় তাহলে কি ফ্যাসিজম ধ্বংস করা সম্ভব? যতই অভ্যুত্থান হোক আবার জন্ম নেবে ফ্যাসিবাদের। স্বৈরশাসক ফ্যাসিজম তৈরি করে তার চারপাশে থাকা সহযোগীদের পরামর্শে এবং ফ্যাসিজমটির প্রয়োগও ঘটায় তারই সহযোগীদের সাহায্যে। প্রশ্ন হচ্ছে, ফ্যাসিজমের সহযোগীরা যদি পতনের পর যারা পতন ঘটালো তাদের ছায়াতলে ঢুকে পড়ে, তাহলে ফ্যাসিজমের বীজ আর ধ্বংস হবে না। ওই বীজ থেকে পুনরায় আরেকটি ফ্যাসিজমের জন্ম নেয়। 

১৯৭৫ সালের পট-পরিবর্তনের পর  থেকে অদ্যাবধি স্বৈরশাসন নিরোধ কল্পে ঘটেছে বেশকিছু গণঅভ্যুত্থান। কিন্তু কোনো পজিটিভ ফল পাওয়া যায়নি। অভ্যুত্থানের পর দোসরদের স্বরূপ চিহ্নিত করাটাও কষ্টকর। এরা খোলসের আবরণে থাকে, সাপের মতো ছলম (চামড়া) বদলায়। এরশাদের পতনের পর কি দেখা গিয়েছিল, দেখা গেছে এরশাদের আমলের আমলারা যোগ দিয়েছে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মতো রাজনৈতিক দলে। এরশাদের আমলের মন্ত্রিপরিষদ সচিব এমকে আনোয়ার যোগ দেন বিএনপিতে। তারপর তিনি হয়ে যান মন্ত্রী।

প্রশ্ন হলো, এরশাদ যদি তার সচিবদের সহযোগিতা না পেত, তাহলে কি তিনি স্বৈরাচার হিসাবে ফ্যাসিজম গড়ে তুলতে পারতেন। মরহুম মোশারফ হোসেন ছিলেন এরশাদের শিল্প সচিব তিনি বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন। এ রকম আরো উদাহরণ দেয়া যাবে। ১৯৯১ সালে নির্ভেজাল ভোটে বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দেশে দ্বিতীয় বারের মতো সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠা পায়। খালেদা জিয়া হন দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। খালেদা জিয়াকে সেই সময় বলা হতো আপোষহীন নেত্রী। অথচ এই খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালের ফ্রেব্রæয়ারি মাসে ভোটারবিহীন এক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। 

আর এই নির্বাচনের কারণে তিনি হয়ে যান স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদী। তিনি তো এই কাজটি করেছিলেন তার চারপাশ ঘিরে থাকা নেতাদের পরামর্শে। সুতরাং তার যে গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল তা বিনষ্ট হয়ে যায় ওই মাজুদুল মার্কা নেতার কারণে। হাসিনা সরকারের আমলে উপজেলা থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত স্তরে স্তরে পতিত স্বৈরাচার এরশাদের দোসররা ঘাঁটি বাঁধে। প্রকৃত রাজনীতিকরা আওয়ামী লীগ থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য হয়। উদাহরণ হিসাবে রাজশাহীর কয়েকটা বিষয় উল্লেখ করছি।

রাজশাহীর মেয়র ছিলেন জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহীদ কামারুজ্জামানের পুত্র খায়রুজ্জামান লিটন। লিটন মেয়রের আমলে যারা আওয়ামী লীগে স্থান পায় তারা সবাই হাইব্রিড। প্রকৃত আওয়ামী লীগার কেউ ছিল না। লিটন, তার স্ত্রী, তার মেয়ে গোটা রাজশাহী বিভাগটি দাপটের সাথে বিচরণ করেছে। লিটনের আমলে সিটি করপোরেশনের টেন্ডার বাণিজ্য এক নৈরাজ্য রূপ লাভ করে। তার বা তার নিকটতম চামচা ছাড়া কেউ কাজ পেত না। তার পোষা ঠিকাদাররা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। এক কাজই বছরে তিনবার করে করা হয়। লিটনের আমলে কোনো এলটিএম পদ্ধতির টেন্ডার ছিল না। তাই ঠিকাদারি কাজ ভাগ করার জন্য কোনো লটারী প্রয়োজন হতো না। 

লিটনের টেন্ডারবাজিসহ দুর্নীতিমূলক কাজের অন্যতম সহযোগী ছিল ১২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর সরিফুল ইসলাম বাবু। বর্তমানে বাবু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিচ্ছে, তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন। সত্যিই কি সেলুকাস এই রাজশাহী তথা বাংলাদেশ। দেখা যাবে এই সরিফুল ইসলাম বাবু কোনো ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে এসে আবার মহীরুহে পরিণত হয়ে যাবেন। আবার শুরু করবেন তার পুরাতন দুর্নীতির খেলা। দখলদারিত্বে বিশেষ স্থান দখল করেছিল এক সময়ের উগ্রবাদী কমিনিস্ট নেতা, পরে ব্যাংকার আরিফুল হক কুমার।

শোনা যায়  ব্যাংক থেকে পাঁচ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এই নেতা পাবলিক লাইব্রেরি, কবিকুঞ্জের নামে ভূমি দখল, সিটি করপোরেশনের উপদেষ্টাসহ সংস্কৃতিক অঙ্গনে আধিপত্য স্থাপন করেন আওয়ামী লীগের সময়ে। এখন শোনা যাচ্ছে, তিনিও নাকি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন, হাসিনার পতনের জন্য কুমারও নাকি অনেক কাজ করেছেন।

মন্ত্রিপরিষদ, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য, বাংলাদেশ বিমানের এয়ারলাইন্স ও সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন আলী ইমাম মজুমদার। বর্তমানে তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা। তার আদর্শিক মূল্যবোধটি কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে মিলেছিল যার প্রেক্ষিত তিনি আগের দায়িত্বগুলো পেয়েছিলেন। এই বিষয়টিও ভাববার দরকার আছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এই সমস্ত মানুষের আদর্শিকতার কি প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে কি না তা ভেবে দেখার প্রয়োজন।

শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ১ টাকা পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন নুসরাত ইমরোজ তিশা। ওই সময় তিশা গণমাধ্যমে বলেছিলেন “আমি এক টাকাও পারিশ্রমিক নিতাম না, যেহেতু চুক্তি লিখতে হবে তাই নিয়েছি। শুধু ভালোবাসার জায়গা থেকে এই কাজটি করতে চেয়েছি। এখন মনে হচ্ছে যে, যত ভালোবাসার কথা ভেবেছিলাম, তার চাইতে অনেক বেশি পেয়েছি। এর চেয়ে সম্মান আর কি হতে পারে।”

অনুরূপ কথা বলেছিল মুজিব চরিত্রে অভিনয় করা আরেফিন শুভ। তিশা তো হাসিনা পরিবারের সদস্য হয়ে উঠেছিলেন। হাসিনার সাথে মেট্রোভ্রমণ। বিভিন্ন পার্টিতে যাওয়া-আসা ছিল, তিশার নিত্যদিনের বিষয়। তার স্পাউস হিসাবে মি. ফারুকী যেতেন ওই সকল জমকালো পার্টিগুলোতে। ফারুকী সাহেবের অগাধ বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার জায়গা ছিল হাসিনা পরিবার। গণভবনে তিশার স্পাউস হিসাবে তার জন্য দ্বার ছিল খোলা। শুভের নামে বরাদ্দকৃত সরকারি সম্পত্তি বাতিল করা হয়েছে অপরদিকে ফারুকী সাহেব হলেন মন্ত্রী সমকক্ষ উপদেষ্টা। একেই বলে ভাগ্য নাকি ভেলকিবাজির খেলা এটা ভাবার দরকার। বাংলাদেশে কে কোন আদর্শের ধব্জা বহন করছে তা বুঝা মুশকিল। 

গ্রামের সেই প্রবাদের মতো, যে দিকে থেকে বৃষ্টি আসে সেদিকে ছাতাটা মেলে ধরার মতন। এই পদলোভীরা রাষ্ট্র যন্ত্রটাকে নষ্ট করে দিয়েছে। এরা  ক্ষমতাবানদের পদলেহন করেন। জ্বী হুজুর জ্বী হুজুর বলে জিকির করেন আর এদের জিকিরে শাসকরা হয়ে উঠে স্বৈরাচার। শাসকদের ফ্যাসিবাদ বানিয়ে পতন ঘটায় এরাই। তাই এদেরকে সবার আগে চিনতে হবে। এই ধরনের ব্যক্তির কারণে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি হয় না। কথিত উচ্চ মহলের সুশীলদের আদর্শিক ভাবনাটার জানা প্রয়োজন। 

কে কার লোক অর্থাৎ কে হাসিনার কে খালেদা জিয়ার কে জামায়াতের আদর্শ লালন করে তা আগে নির্ণয় করা প্রয়োজন। তারপর এদেরকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিচালনার সদস্য করা। নইলে বার বার দেশে ফ্যাসিবাদ জন্ম নেবে আর তরুণদের দিতে হবে আত্মাহুতি- গণতন্ত্রের জন্য। লাখ লাখ প্রাণ যাবে কিন্তু গণতন্ত্র আসবে না।
 
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট