জীবে দয়া করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর- কত আগেই বলে গেছেন স্বামী বিবেকানন্দ। ঈশ্বরের সৃষ্টিকে ভালোবাসলেই যে তিনি খুশি হন, এমন তত্ত্ব মেনে চলার খুব বেশি মানুষ পাওয়া যাবে না চারপাশে। মানুষও একপ্রকার জীব, যদিও মানুষকে সচরাচর কেউ জীব বলে না। সৃষ্টির সেরা সেই মানুষকেও কি অন্য মানুষ ভালোবাসতে পারছে? যদি পারত চারপাশের চিত্র এমন হতাশাজনক হতো না। মাদার তেরেসার একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য- ‘তুমি যদি দৃশ্যমান মানুষকে ভালোবাসাতে না পারো, তবে অদৃশ্য ঈশ্বরকে কী করে ভালোবাসবে?’
মানুষ হয়ে আমরা যখন মানুষকেই ভালোবাসতে পারছি না, সংঘাতে-জিঘাংসায় জড়াচ্ছি প্রতিনিয়ত; সেখানে জীবজন্তুকে ভালোবাসব কীভাবে! তবুও কেউ কেউ ঠিকই প্রাণীজগৎকে ভালোবাসেন। অল্প হলেও এসব নজির সামনে আসে। পথে-ঘাটে এমন দৃশ্য দেখতে পাই...। বড়ই সাদামাটা স্বাস্থ্যবতী মহিলাটির মুখাবয়ব। মহল্লার স্টলে বসেছি চা খেতে। তিনি পাশের বেঞ্চে পান চিবুচ্ছিলেন। হঠাৎ একটি কুকুর এসে তার পায়ের কাছে মুখ ঘষতে শুরু করে। মহিলা স্নেহ-প্রশ্রয়ের হাসি দিয়ে বললেন, ‘আবার আইছছ? তোরে না সকালে খাওয়াইছিলাম!’
এরপর দোকানের সামনে ঝুলিয়ে রাখা প্যাকেট থেকে একটা বনরুটি নিলেন। ছিঁড়ে ছড়িয়ে দিলেন রাস্তায়, কুকুরটির গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘খা’।
আমার অবাক দৃষ্টি অনুসরণ করে বললেন, ‘ওরে আমি প্রত্যেকদিন খাওয়াই। মানুষ বেইমানি করে, কুত্তা কোনোদিন বেইমানি করব না।’ হেসে বললাম, ‘মানুষ আপনেরে বহুত ঠকাইছে?’ হালকা বাতচিতের মধ্যেই খেয়াল করি, কুকুরটি সামনের ভবনের দেয়াল ঘেঁষে পায়ের আঁচড়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করেছে। দেখতে দেখতে আরেকটি বিস্ময় চলে এলো সামনে। সবটুকু রুটি কুকুরটি খেতে পারেনি। অবশিষ্ট টুকরোগুলো সদ্য তৈরিকৃত গর্তে রেখে আবার মাটিচাপা দিল। সাবধানী গৃহস্থ যেভাবে সোনাদানাসহ মূল্যবান জিনিসপত্র ঘরের ভেতরে মাটিচাপা দিয়ে থাকে। মহিলা বললেন, ‘কুত্তাগুলা এইসব করে। বিলাই করে না।’ কতকিছুই চতুর্দিকে ঘটে, আমাদের জানাশোনার পরিধিইবা কতটুকু বিস্তৃত। রুটি সংরক্ষণের পর কুকুরটি চলে গেল আরেকদিকে। মহিলা জানালেন, ক্ষুধা পেলে ঠিকই ফিরবে কুকুরটি। মাটি সরিয়ে রুটিটা বের করে খাবে।
শেষ প্রশ্নের জবাবে মমতাময়ী বলেন, ‘মানুষ চাইয়া খাইতে পারে, কুকুর তো পারে না; জবান নাই।’
টাঙ্গাইলের নাগরপুরে বেড়াতে গিয়েছি। সাহিত্যিক ও কালিহাতী কলেজের অধ্যাপক আলী হাসান সাহেবের আতিথ্যে ঘুরে-ফিরে দেখছি জমিদারবাড়িসহ নানা নিদর্শন। হঠাৎ ময়লা পোশাক পরা এক কিশোরকে দেখলাম, একটি কুকুরকে দুই কাঁধে বসিয়ে ছুটছে। থামিয়ে প্রশ্ন করলাম- ‘কী হয়েছে, বাবু?’
‘ওরে হাসপাতালে নিয়া যামু।’ হাসপাতাল নিতে হবে কারণ কুকুরটি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সত্য-মিথ্যা জানি না। ছেলেটি নিজেই সুস্থ কিনা তাও না। কত মানুষই পড়ে থাকে রোজ, অনাদরে পথে-ঘাটে। তাদের কেউ হাসপাতালে নিয়ে গেছে, এমন চিত্র কখনো চোখে পড়েনি।
সম্প্রতি ফেনীতে ভয়াবহ বন্যা গেল। লাখো মানুষের জীবন ভয়াবহ হুমকিতে। এর মধ্যেই ফেসবুকের একটি ছবি দৃষ্টি কেড়েছে অনেকের। দুই কিশোরী টেনে নিচ্ছে একটি কুকুরকে। তারা ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। কুকুরটিকে ফেলে আসেনি। মমতার জয় এভাবেই হয়। বন্যার্ত সময়ের একটি কার্টুন-দৃশ্য নজর কেড়েছিল অনেকের। কার্টুনে দেখা যায়- নৌকায় চড়ে এলাকা ত্যাগ করছে দুই তরুণ। পাশেই বসা একটি কুকুর। দ্বিধাদ্বন্দ্বজনিত তার করুণ আর্তি ফুটে উঠেছে সংলাপ-বক্সে- ‘আমারে নিব না?’
প্রাকৃতিক দুর্যোগে পশুপাখিই বেশি সমস্যায় পড়ে। করোনাকালে অভিনেত্রী জয়া আহসান সংবাদ শিরোনাম হয়েছিলেন কুকুরপ্রেমের কারণে। লকডাউনে যখন সবাই ঘরবন্দি, তিনি পথে নেমে এসেছিলেন কুকুরদের খাবার দিতে। ভারতের সঙ্গীতশিল্পী ইমন চক্রবর্তী এক ঝড়ের রাতে সবান্ধবে বেরিয়েছেন প্রাণীদের খাবার পৌঁছে দেয়ার তাগিদে। ফেসবুক লাইভে দেখেছি- ঝড়-পানি মোকাবিলা করে কীভাবে সতীর্থদের নিয়ে প্রাণী খুঁজে বের করছেন। মোবাইল ফোনের চার্জ ফুরিয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত তিনি দেখিয়ে গেছেন নানা দৃশ্য। শেষে ইমন এটাও বলেছেন তার লাইভ নিজেকে জাহির করার জন্য নয়, অন্যরাও যেন নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসেন, উজ্জীবিত করার জন্য। পশুপ্রেম অনেকেরই আছে। বিড়াল-কুকুরের প্রতি মানুষের যে প্রেম, তার ছিটেফোঁটাও কেউ কেউ স্বজাতির প্রতি দেখাতে পারেন না। যিনি বাসায় বিদেশি কুকুর পালেন, নিজ শয্যায় আদুরে বিড়ালকে জায়গা দেন- তিনিই কীভাবে গৃহকর্মীর গায়ে খুন্তির ছ্যাঁকা দেন- সমীকরণ মেলাতে পারি না। সহজে মিলবেও না হয়তো।
গত সপ্তাহে রাতের বেলায় রাজধানীর কাঁটাবন মোড়ে অন্যরকম একটি চিত্র দেখেছি। পলিব্যাগে মুরগির পা নিয়ে কুকুরদের মাঝে বিতরণ করছেন জনৈক তরুণ। এগুলো হয়তো তিনি মুরগির দোকান থেকে কিনে এনেছেন। মুরগি ড্রেসিং করিয়ে নেন, এমন অনেক ক্রেতাই পা-টা রেখে যান। দোকানিরা সেগুলো আলাদাভাবে বিক্রি করে। তরুণের এই পশুপ্রেম দেখে ভালো লাগল। কুকুর প্রভুভক্ত প্রাণী, কিন্তু চারপাশে ‘মানবিক নির্যাতনের’ শিকার কুকুরই বেশি হয়। সেবা প্রকাশনীর অনুবাদে প্রকাশিত হয়েছিল ‘হোয়াইট ফ্যাং’ নামে একটি উপন্যাস। একটি কুকুরের জীবনকাল নিয়ে রচিত উপন্যাসটি ব্যতিক্রমী অবশ্যই।
আবার দেশীয় পটভূমিতে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচনা করেছিলেন অবিস্মরণীয় গল্প ‘মহেশ’। দানাপানির অভাবে একটি গরুকে কী নির্মম পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছিল সেই গল্প বিধৃত হয়েছে। প্রায়ই কোরবানির ঈদে কৃষকের কান্নায় ভাসে গবাদি পশুর হাট। জীবন-জীবিকার তাগিদে কোনো কোনো মানুষ পেলেপুষে বড় করা গরুকে হাটে তুলে বিক্রি করতে আসেন। দীর্ঘদিন একত্রে থাকার কারণে গরুর প্রতিও সন্তানের মতো কান্না জন্মে। সেসব ক্ষেত্রে বিক্রেতার কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে হাট। বছর কয়েক আগে একজন ভদ্রলোক একটি গরু কিনেছিলেন। বিক্রেতার কান্নাজড়িত ছবি পত্রিকায় পড়ে তিনি গরুটি তাকে ফেরত দিয়ে আসেন। এভাবেও জন্ম হয় উদারতা ও মানবতার গল্প!
সনাতন ধর্মেও গরুকে বিশেষ ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখা হয়। এক মহেশ আমাদের চোখে জল এনে দেয়, অলক্ষে এমন হাজারো মহেশ ও গফুরের গল্প জমা হয়ে আছে দেশের নানা প্রান্তে। মানুষ সাপকে ভয় পায়, তাই সাপ দেখলেই মেরে ফেলে। বর্তমান কতিপয় তরুণের উদ্যোগ চোখে পড়ে, যারা সাপের টিকে থাকার জন্য প্রচার-প্রচারণা ও সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। ‘সাপ মারবেন না’ স্লোগান দিয়ে জনমত সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। বেদেনী যখন খোঁপায় একটি জ্যান্ত সাপ পেঁচিয়ে পরে হেঁটে যায়, কারও কারও কাছে সেটা ‘ভয়ংকর সুন্দর’ আবার কোনো তরুণ যখন দশাসই একটি সাপকে গলায় পেঁচিয়ে ‘মালা’ বানায় সেটাও আরেক ধরনের সৌন্দর্য।
সাপের ভালোবাসা নিয়ে একটি গল্প লিখেছেন হুমায়ূন আহমেদ। জনৈক ব্যক্তি একটি সাপ পালার জন্য বাসায় নিয়ে আসেন। এরপর দীর্ঘদিন বাসার বাইরে কাটিয়ে ফেরেন তিনি। এসে দেখতে পান, বাচ্চাকাচ্চা ফুটিয়ে সাপটি বিশাল বংশবিস্তার করে বসে আছে! লেখক গল্পের ইতি টানেন এভাবে- মানুষ শুধু মানুষের ভালোবাসাই সইতে পারে, সাপের নয়। জীবে দয়া, জীবনের প্রতি ভালোবাসা খুবই জরুরি। আমরা সৃষ্টির সেরা- এটাকে কথার কথাতে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবায়নটাই বেশি জরুরি। জীবকে ভালোবাসব, মানুষকেও। ভালোবাসাবাসির শক্তিটাই এমন- নিজের মনটাও বড় হয়ে যায়! যে বিশালত্বে তখন কারও দোষ-ত্রুটি বা ক্ষুদ্রতা বড় হয়ে উঠতে পারে না।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সম্পাদক
Comments