পরিবেশ আমাদের উপর নয় বরং আমরাইপ্ররিবেশের উপর নির্ভরশীল। মানুষের সুস্থ ও সুন্দর জীবনের জন্য প্র্রয়োজন সুন্দর ও দূষণ মুক্তপ্ররিবেশের। মানুষ একদিন প্র্রকৃতিকে জয় করার নেশায় মত্ত হয়েছিল। প্র্রকৃতিকে জয় করেও মানুষের সেই নেশার অবসান হয়নি। বিজ্ঞান ও প্র্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ জলে-স্থলে-মহাশূন্যে আধিপত্য বিস্তার শুরু করে। কিন্তু মানুষের এই বিজয় মানুষকে এক ধরনের পরাজয়ের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আজ আমরা এক ভয়ংকর সংকটের মুখোমুখি। এ সংকট বিশেষ কোনো দেশের নয়, বিশেষ কোনো জাতিরও নয়। এ সংকট আজ বিশ্বজুড়ে। বিশ্বেও পরিবেশ আজ নানাভাবে দূষিত। এই দূষণ আজ ভয়ঙ্কর এক ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের। আজ জলে বিষ, বাতাসে আতঙ্ক, মাটিতে মহাত্রাস। বিগত ৬০ বছরে ৮০টির বেশি প্রজাতির প্রাণী নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কয়েকশ প্রজাতির গাছপালা বিলুপ্ত হয়েছে।
আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে; কিন্তু এর পরিণামে বাতাসে প্রতিবছর ২২ কোটি টন কার্বন মনোক্সাইড সঞ্চিত হচ্ছে। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড গ্যাসের আনুপাতিক হার ক্রমেই বাড়ছে। এর ফলে বৃষ্টির পানিতে অ্যাসিডের পরিমাণ বেশি হচ্ছে। এই অ্যাসিড বর্ষণ অরণ্যে মহামারি সৃষ্টি করছে, যা খাদ্যশস্যকে করছে বিষাক্ত। দ্রুত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সবুজ অরণ্য। প্রতিবছর ৭৫ লাখ হেক্টর জমি মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। প্রতি মিনিটে ৫০ হেক্টর উর্বর জমি বালুকাকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর বাতাসে বিপুল পরিমাণ অক্সিজেন কমছে। বিজ্ঞানের অপব্যবহারে ভূ-প্রকৃতির ওপর অত্যাচার বাড়ছেই। শস্য রক্ষার জন্য নানা ধরনের কীটনাশক তৈরি ও প্রয়োগ হচ্ছে। এসব বিপজ্জনক রাসায়নিক দ্রব্যের অনুপ্রবেশ ঘটছে মানুষের শরীরে। ফলে নানা জটিল ও কঠিন রোগ দানা বাঁধছে আমাদের শরীরে। পরিবেশ দূষণের কারণে পৃথিবীতে ৮০ শতাংশ নিত্যনতুন রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। মেরু অঞ্চলের বরফ গলে পানিতে পরিণত হচ্ছে। বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তরের আয়তন সংকুচিত হচ্ছে। দূষণের কারণে উদ্ভিদ ও জীবজগৎ আজ বিপন্ন। সমুদ্র-নদী-জলাশয়ে মাছের সংখ্যা দিনদিন কমছে। মাছের শরীরেও দেখা দিচ্ছে নানা রোগ।
দেশের পরিবেশকেন্দ্রিক ভাবনাগুলোকে তাই যেমন পরিসর থেকে আরও বৃহত্তর পরিসরে বিস্তৃত ও ব্যাপক করে তুলতে হবে। একইসাথে বিশ্ব-পরিসরের পরিবেশকেন্দ্রিক সমস্যা সম্পর্কেও আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। সেগুলো সমাধানের উদ্যোগগুলোর সাথেও যথাসম্ভব সংযুক্ততা ও সম্পৃক্ততা গড়ে তুলতে হবে। আর এভাবে গড়ে তুলতে হবে অটুট বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব শুধু পরিবেশপ্রেমী মানুষের মাঝে নয়, পরিবেশবাদী প্রতিষ্ঠানের সাথে অন্য পরিবেশবাদী প্রতিষ্ঠানের, পরিবেশ ও প্রকৃতিপ্রেমী মঞ্চের সাথে অন্য মঞ্চের, পরিবেশ সুরক্ষার লক্ষ্যে নিবেদিত বলিষ্ঠ সামাজিক আন্দোলনের সাথে অন্য আন্দোলনের। ওই ঐক্য গড়তে হবে ক্ষেত্রবিশেষে এক দেশের সাথে অন্য দেশের। আর এই ঐক্যে নেতৃত্ব দেবার জন্য এগিয়ে আসতে হবে তরুণ সমাজকেই। এভাবে বৃহত্তর একটি ঐক্য গড়ে তোলা এখন খুবই জরুরি। এ ঐক্যই আমাদেরকে ধীরে ধীরে সামাজিক ও পরিবেশকেন্দ্রিক সুচিন্তা এবং পরিবেশসম্মত রাজনৈতিক অঙ্গীকার এনে দেবে।
চাইলেই আমরা আমাদের দেশের সভ্যতা নগরের পরিবর্তে অরণ্যে বিকশিত করে তুলতে পারি; আমাদের গ্রামগুলোকে, ছোট ও বড় শহরগুলোকে পরিকল্পিত এবং পরিবেশ সমুন্নতভাবে গড়ে তুলতে পারি; চাইলেই আমরা একতাবদ্ধ হয়ে আমাদের চারপাশ থেকে পরিবেশের সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারি; সকল অবৈধ স্থাপনা ও কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদ গড়ে তুলতে পারি; সতর্ক থাকতে পারি সরকারের সকল গোপন কূটনীতি ও চুক্তির সম্পর্কে; জলদস্যু-বনদুস্যদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট আওয়াজ তুলতে পারি; একটু আন্তরিক ও বলিষ্ঠভাবে উদ্যোগ নিলে আমরা আমাদের শহরগুলোকে যানজট ও দূষণ নিয়ন্ত্রিত বসবাসের উপযুক্ত শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারি; নদী রক্ষার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে নদীগুলোকে ঝুঁকি ও দূষণমুক্ত রাখতে পারি, বৈচিত্র্যপূর্ণ উপকূল বনায়ন ও পরিবেশ সমুন্নত জীবপ্রকৃতি গড়ে তুলতে পারি; একটু খেয়াল রেখে চললেই আমরা স্বাস্থ্য সম্পর্কে আরও সচেতন হয়ে উঠতে পারি, বাড়ির পরিবেশকে আরও সুন্দর করে তুলতে পারি, আরও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে পারি; খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে আরও সচেতনতা অবলম্বন করতে পারি। এভাবে নিজেরা আরও সচেতন ও সক্রিয় হয়ে উঠতে হবে আমাদেরকে!
আমরা যদি উন্নয়ন করতে চাই এবং একে টেকসই করতে চাই তাহলে পরিবেশ সুন্দর রাখতে হবে। আমরা যদি পরিবেশ ঠিক রাখতে না পারি তাহলে উন্নয়ন টেকসই হবে না। এক্ষেত্রে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। আর সচেতনতা সৃষ্টির অন্যান্য সাপোর্টও প্রয়োজন। এটি সরকারের পলিসি থেকে শুরু করে আরও বিভিন্ন সহায়তা হতে পারে। আগামী দিনের উন্নয়নে প্রকৃতি ও সমাজকে রক্ষা করার যে অঙ্গীকার, সেটি রক্ষা করতে হবে। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বাস্তবায়ন। আমাদের সেটি বাস্তবায়নের দিকে যেতে হবে। এক্ষেত্রে তরুণ প্রজš§ বা যুবসমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা শুধুই অর্থনৈতিক মানুষ নই, আমরা সামাজিক মানুষ।
সমাজের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে আমরা চলি। এখানে প্রকৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সামাজিক জীব হিসেবে আমাদেও প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে। বিভিন্ন স্কুল-কলেজ জলবায়ু ক্লাব তৈরি করতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ নতুন তরুণ প্রজš§ তথা যুবসমাজ সকলের সঙ্গে মতবিনিময় সভার আয়োজন করা যেতেপ্রারে। পরিবেশ সচেতনতা ও উন্নয়নে আমাদের যুবসমাজের ভূমিকা অপরিসীম। আমাদের ছাত্র ও যুব সমাজ এ করোনাকালে নিষ্ক্রিয় ও নিষ্প্রভ হয়ে থাকবে-এ আমাদের কাম্য নয়। নাগরিক দায়িত্ববোধ নিয়ে নিজস্ব উদ্যোগে পরিবেশ ও প্রকৃতির সুরক্ষায় এবং স্ব-স্ব এলাকার পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযানে শামিল হতে হবে।
আমরা যদি একটা পৃথিবী কল্পনা করি যা বৃক্ষহীন, জলাভূমিহীন এবং বৃষ্টিশূন্য, প্রথমেই যা মাথায় আসবে তা হলো ধূসর, জীবনবিহীন একটি গ্রহ, যেখানে প্রাণের কোনো অস্তিত্ব নেই। আদিম মানুষ প্রকৃতির সাথে সমন্বয় রেখে বসবাস করতো। কিন্তু সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে মানুষ নিজের হাতে এই সমন্বয় নষ্ট করে নতুন সব প্রযুক্তির উদ্ভব ঘটিয়েছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে পৃথিবীর বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ এখন ৪১৫ পিপিএম যা মানব সভ্যতার ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এখনই যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে দিন দিন এই পরিমাণ বাড়তে থাকবে।
মানবজাতিকে সুস্থভাবে পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখার গুরুত্ব অপরিসীম। এরই প্রেক্ষিতে মানুষের জন্য সবুজ পরিবেশের প্রয়োজনীয়তা এবং জীবজগৎ ও প্রকৃতির সুরক্ষায় জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ২৭তম অধিবেশনে প্রতিবছর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এরপর ১৯৭৪ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা ও বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে পরিবেশকে সুস্থ রাখার অঙ্গীকার নিয়ে প্রতিবছর এদিনে বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয়ে আসছে। এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে একটাই পৃথিবী, প্রকৃতির ঐকতানে টেকসই জীবন। প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে টেকসই জীবনযাপনের ওপর জোর দেয়া হয়েছে এই প্রতিপাদ্যর মাধ্যমে।
উন্নয়নের মহাসড়কে যাত্রা করতে গিয়ে আমরা আসলে কতখানি পিছিয়ে যাচ্ছি তা বোঝা যায়, যখন দেখি বর্তমানে দেশে জনপ্রতি বনভূমির পরিমাণ প্রায় ০.০২ হেক্টর মাত্র। আমরা যদি অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশে প্রকৃতিকে না রেখে উন্নয়নের মিছিলে অংশগ্রহণ করি তবে সেই উন্নয়ন মানব সভ্যতার জন্য কতটা যৌক্তিক হবে সেটা বিবেচনার বিষয়। প্রায়শই দেখি রাস্তায় গাছ কেটে, জলাশয় ভরাট করে, খেলার মাঠ দখল করে উন্নয়নের কাজ চলছে। যেখানে তৈরি করা হচ্ছে আধুনিক সুযোগ সুবিধা সংবলিত বহুতল ভবন, আবাসিক হোটেল, সোসাইটি এবং সুপারমার্কেট। উন্নয়নের যে পরিকল্পনায় প্রকৃতির কল্যাণ বিবেচনা করা হয় না, সে পরিকল্পনার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। কয়েকদিন আগেই বড় বড় বিশ্ব নেতাদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল জলবায়ুবিষয়ক সম্মেলন। এই সম্মেলন কতখানি ফলপ্রসূ হবে জানি না। তবে এই সমাজের চিত্রকে পরিবর্তন করে দূষণমুক্ত সুস্থ ও সুন্দর সমাজ উপহার দেয়ার জন্য সকলকে সম্মেলিতভাবে চেষ্টা করতে হবে। আমাদের সামষ্টিক ও ব্যাক্তিগত উদ্যোগের মাধ্যমে পরিবর্তন হোক বিশ্ব। আগামী শিশুর জন্য পৃথিবী হোক বাস যোগ্য ও নিরাপদ।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
মানবকণ্ঠ/এসআরএস
Comments