Image description

বিশ্বখ্যাত লেখকদের লেখালেখি বিচিত্র অভ্যাসের কথা আমাদের জানা আছে। এসব কাহিনী শুনতে কার না ভালো লাগে? একইসঙ্গে জানতে ইচ্ছে করে বিশ্বখ্যাত বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর— কিভাবে লিখতেন? লেখার সময় কারও উপস্থিতি তাকে বিরক্ত করত কি? প্রকৃতি তাকে কতটা টানত লেখার বেলায়? আজ তার ১৬৩তম জন্মদিনে সেটা কিছুটা হলেও জানতে পারি।

ব্যাথা-বেদনায় অনাদিকালের কাতর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাংসারিক কর্তব্য, জমিদারির তদারকি সামলে যে মানুষটা নিরলসভাবে লিখে গেছেন। কিন্তু কিভাবে লিখতেন তিনি জানতে কার না ইচ্ছে করে? মাত্র সাত বছর বয়সে লিখতে শুরু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি থেকে কিছু কথা উদ্ধুত করা যায়। ‘কবিতা আমার বহুকালের প্রেয়সী। বোধ হয় যখন আমার রথীর মতো বয়স ছিল, তখন থেকে আমার সঙ্গে বাগ্দত্তা হয়েছিল।’ (চিঠিটি কবি লিখেছিলেন মেজ দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা ইন্দিরা দেবীকে। ১৮৯৩ সালের মে মাসের ৮ তারিখ।)

রবীন্দ্রনাথ খাতায় লিখতে শুরু করেন সাত বছর বয়সে। তখন তিনি নর্মাল স্কুলের ছাত্র। নীল কাগজের একটি ফুলস্কেপ খাতা উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন। সেই খাতাতেই পেনসিল দিয়ে পদ্য লেখেন। লিখেই পড়ে শোনান বড় দাদা সোমেন্দ্রনাথকে। সোমেন্দ্রনাথও তাকে অনুপ্রাণিত করেন। নতুন কিছু লিখলে বাড়ির সবাইকে ডেকে বলেন, রবি কবিতা লিখেছে, শুনবে এসো। তেমনই একদিন ন্যাশনাল পেপারপত্রের সম্পাদক নবগোপাল মিত্র এলেন বাড়িতে। সোমেন্দ্রনাথ তাকে বললেন, নবগোপাল বাবু, রবি একটা কবিতা লিখেছে, শুনুন না। কবি গলা ছেড়ে আবৃত্তি করে শোনালেন। নবগোপালবাবু হেসে বললেন, বেশ হয়েছে।

বাবার সঙ্গে প্রথমবারের মতো শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসেছিলেন ১৮৭৪ সালে। সঙ্গে লেখার উপকরণ হিসেবে ছিল কেবল একটা পেনসিল ও পুরনো লেট্স ডায়েরি। শান্তিনিকেতনের উদাত্ত আকাশের নিচে দাঁড়াতেই কবির মনে হলো, গাছের ছায়ায় বসে কবিতা লিখলে অনায়াসে কবিত্ব করা যায়। ভাবনামতো গাছগাছালির ছায়ায় বসে লিখতে শুরু করলেন। ‘পৃথ্বীরাজের পরাজয়’ শিরোনামের বীররসাত্মক কবিতাটি ওই সময়ে লেখা। ‘পৃথ্বীরাজের পরাজয়’ লিখতে রবিঠাকুরের সময় লেগেছিল সাতদিন।

কবির মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন আহমেদাবাদের জজ। কবি বিলেত যাওয়ার আগে তার সঙ্গে দেখা করতে আহমেদাবাদ গেলেন। সেখানের ব্যাপারতো বলার অপেক্ষা রাখে না। জজের বাসভবন মানে তো রাজকীয় প্রাসাদ। প্রাসাদের পাশ ঘেঁষে বয়ে গেছে সবরমতী নদী। নদীর জলের কলকল শব্দ আর প্রকৃতির নিরূপম আকিঞ্চণে রবীন্দ্রনাথের কবিসত্তা যেন সবরমতির কল্লোলিত ধ্বনির চেয়েও উদ্বেলিত হয়ে উঠল। কি এক অজানা উদ্বেগ তাকে গোপনে স্পর্শ করে বসল। রবীন্দ্রনাথ চাঁদের আলোয় ছাদে বসে নিজের সুরের প্রথম গানগুলো রচনা করলেন। তখন তার বয়স মাত্র ১৭। ‘কবি-কাহিনী’ রবীন্দ্রনাথের প্রথম কাব্যগ্রন্থ। রবীন্দ্রনাথ বিলেত যাওয়ার কিছুদিন পর কলকাতা থেকে এটি প্রকাশিত হয়েছিল। পুরনো লেট্স ডায়েরিতে লেখা ‘কবি-কাহিনী’ লিখতে তার সাতদিন সময় লেগেছিল। খসড়ায় উল্লেখ করা তারিখ অনুযায়ী এটা জানা গেছে। 

কবির জীবনে শিলাইদহ পর্বটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ— এ কথা সবার জানা। এখানে কবি সৃষ্টিসুখের সন্ধান পেয়েছিলেন। শিলাইদহের আশপাশ নৌকায় ঘুরে ঘুরে তিনি যেমন ঋতুবৈচিত্র্য আর প্রকৃতির অকৃপণ উদারতা উপভোগ করেছেন, তেমনই ঘুরতে ঘুরতেই কলম ও কালির আঁচড়ে ফলিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের সোনালি ফসল। রথীন্দ্রনাথের ‘পিতৃস্মৃতি’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়— ‘আমার ধারণা, বাবার গদ্য ও পদ্য দুই রকম লেখারই উত্স যেমন খুলে গিয়েছিল শিলাইদহে, এমন আর কোথাও হয়নি। এ সময় তিনি অনর্গল কবিতা, প্রবন্ধ ও গল্প লিখে গেছেন একদিনের জন্যও কলম বন্ধ হয়নি।’ 

একইভাবে প্রবহমান গঙ্গাও প্রভাবিত করেছিল কবিকে। কবিতাসহ বেশ কিছু গদ্য আর ‘বৌ-ঠাকুরাণীর হাট’ উপন্যাস গঙ্গার ধারে বসেই তিনি লিখতে শুরু করেন। আর উপন্যাসটি লেখার জন্য কবি গিয়ে ওঠেন চৌরঙ্গীর কাছে ১০ নম্বর সদর স্ট্রিটে জ্যোতি দাদাদের বাড়িতে। তখন ক্রমেই ‘বৌ-ঠাকুরাণীর হাট’ লেখার কাজ এগিয়ে চলেছে। এরমধ্যে একদিন প্রবল কৌতূহলে কবি আন্দোলিত হলেন। দুপুর ও বিকালজুড়ে সৃষ্টি করলেন বাংলা সাহিত্যের অমর কবিতা ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’। রবীন্দ্রনাথও স্নানের সময় গুন গুন করে গাইতে পছন্দ করতেন। কেবল পছন্দ করতেন বললে ভুল বলা হবে। স্নানের সময় মুখে মুখে গাইতে গাইতে রচনাও করেছেন। ‘বড়ো বেদনার মতো বেজেছ তুমি হে আমার প্রাণে’ বিখ্যাত গানটি স্নানের সময় গুন গুন করতে করতে অনেকদিন ধরে একটু একটু করে তিনি তৈরি করেছিলেন।

তার দিন শুরু হতো ভোর চারটা থেকে। কিন্তু টেবিলে বসেই লিখতে শুরু করতেন না। আধা ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় চুপ করে বসে ভাবতেন। তারপর লিখতে শুরু করতেন। কোনো লেখা শেষ করার পর রবীন্দ্রনাথ কেমন বোধ করতেন? এর উত্তর নিজেই দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘যতক্ষণ একটা লেখা চলতে থাকে ততক্ষণ মনটা বেশ শান্তিতে থাকে, —সেটা শেষ হয়ে যাওয়া মাত্রই আবার একটা নতুন বিষয়ের অন্বেষণে নিতান্ত দিশেহারার মতো, লক্ষ্মীছাড়ার মতো, চারিদিকে ঘুরে বেড়াতে হয়।’ একইভাবে এক খাতা ও কলমেও দীর্ঘদিন লিখতেন না তিনি। সময়ে সময়ে খাতা, কলম, পেনসিল পাল্টে নিতেন। 

এছাড়াও আবহাওয়া, ঋতু পরিবর্তন ইত্যাদি কবির সাহিত্য সাধনায় কখনও ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি। বাইরে প্রচণ্ড রোদ, দাবদাহ, বৃষ্টিলেখার সময় কোনো কিছুতেই ভ্রুক্ষেপ করতেন না তিনি। একমনে লিখছেন তো লিখছেন। তেমনিভাবে লেখার সময় তার কাছে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে কোনো বিধিনিষেধ ছিল না। লেখার সময় কেউ আসলে তার সঙ্গে গল্প করে, পুনরায় কবি লিখতে শুরু করতেন। এই সবকিছু মিলিয়েই আমাদের রবীন্দ্রনাথ এভাবেই লিখতেন। 

একটা জীবন লিখে পার করে যাওয়া কবির লেখা— এক পাঠকের এক জীবনে শেষ করার নয়। প্রকৃতি, মাটি ও মানুষের কাছে বসেই যিনি লিখে গেছেন আজীবন।


মানবকণ্ঠ/এফআই