
নালিশী মামলা দাখিল কিংবা জামিন শুনানী সহ যেকোন মামলার নথি পুট অফ'র প্রেয়ার দাখিলের সাথেই বেঞ্চকে কমপক্ষে ৫০০-১০০০ টাকা হারে দিতে হচ্ছে। নতুবা মামলার নথি শুনানীর জন্য আদালতে নিচ্ছে না বেঞ্চ। ফলে বাধ্য হয়েই বিচার কার্যক্রমে অংশ নিতে বেঞ্চের দাবীকৃত ঘুষ মেটাতে বাধ্য হচ্ছে ফরিয়াদীরা। এমন চিত্র পটুয়াখালীর কলাপাড়া সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট চৌকি আদালতের।
দীর্ঘদিন ধরে জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতের বিচারক শূন্যতায় পটুয়াখালী চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে গিয়ে বিচার প্রার্থীকে মামলার কার্যক্রমে অংশ নিতে হচ্ছে। এতে নিযুক্তীয় কৌশুলী, তাঁর সহকারীর যাতায়াত ভাড়াসহ ফিস এবং নতুন করে আদালতের বেঞ্চ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষের দাবী মেটাতে বিচারপ্রার্থী মানুষ এখন নি:স্ব হওয়ার পথে। একই অবস্থা আদালতের পুলিশ শাখা সহ সিনিয়র সহকারী জজ আদালতেরও। টাকা ছাড়া মামলার নথি যেন শুনানীর জন্য হাঁটছে না আদালতে, এমন অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
এনিয়ে আইনজীবী সমিতি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কিংবা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের জানিয়েও কোন প্রতিকার মিলছেনা। গনঅভু্ত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে আদালতের বেঞ্চ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রকাশ্যে এমন ঘুষ দাবীতে হতবিহবল হয়ে পড়েছে বিচারপ্রার্থী মানুষ।
সূত্র জানায়, কলাপাড়া সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আমলী আদালতে নালিশী মামলা দাখিল, মামলার নথি পুট অফ, এমনকি ধার্য তারিখেও মামলার নথি প্রতি ৫০০-১০০০ টাকা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে বিচার প্রার্থী মানুষকে। নালিশী মামলার জবান বন্দি শেষে স্বাক্ষর নেয়া, আদেশ পরবর্তী সমন দাখিল, গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি, জামিন পরবর্তী বেলবন্ড দাখিল,ওযারেন্ট রিকল পেতেও আলাদা ভাবে টাকা দিতে হচ্ছে। এছাড়া আসামী পক্ষের মোটা অংকের তদ্বিরে মামলায় জামিন, খালাসের কন্টাক্ট নেয়া সহ মামলার ওয়ারেন্ট ধামা চাপা দেয়া, টাকা পয়সা লেনদেন সংক্রান্ত মামলা বিচারে বদলী, চাঁদাবাজী, মারামারি সংক্রান্ত সিআর মামলায় বাদী পক্ষের হাজিরা সরিয়ে অর্ডার শীটে অনুপস্থিত লিখে মামলা খারিজ করে দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে বেঞ্চের বিরুদ্ধে।
কলাপাড়া চৌকি আদালতে প্রাকটিসরত আইনজীবী ও তাদের একাধিক সহকারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে গনমাধ্যমকে জানান, বিচারক শূন্যতায় মামলার নথি নিয়ে উপজেলা থেকে পটুয়াখালী চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে যাওয়ার যাতায়াত খরচের নামে বেঞ্চ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখন নিয়মিত ঘুষ নিচ্ছেন বিচার প্রার্থীদের কাছ থেকে। এনিয়ে এরা সিন্ডিকেট করে ফেলেছে। দু'একজন আইনজীবী নেতাদের অনৈতিক সুবিধা দিয়ে তারা তাদের পক্ষে রাখছে। এ সিন্ডিকেটে রয়েছে আদালতে কর্মরত একাধিক স্থানীয় অধিবাসী, যারা নিজ এলাকার রয়েছেন বছরের পর বছর ধরে। এছাড়া ঘুরে ফিরে একই আদালতে কর্মরত আছেন অনেকে। কেউ কেউ আদালতের এখতিয়ারধীন এলাকায় জমি জায়গাও কিনে ফেলেছেন।
সূত্রটি আরও জানায়, বিচারকের সাথে এদের রয়েছে গোপন সখ্যতা। প্রভাবশালী আসামীদের জামিন, খালাসে মোটা অংকের লেনদেন করছেন এ সিন্ডিকেটের সদস্যরা। এনিয়ে বার ও বেঞ্চের সাথে মতানৈক্য হওয়ায় আইনজীবীদের লাগাতার আদালত বর্জন কর্মসূচী পালনের ঘটনাও ঘটেছে। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার জেলা আইনজীবী সমিতির হস্তক্ষেপে আদালত বর্জন কর্মসূচী প্রত্যাহার হলেও ঘুষ বানিজ্য প্রত্যাহার হয়নি আদালত অঙ্গন থেকে। ৫ আগষ্ট পরবর্তী সময়ে নিম্ন আদালত থেকে আ'লীগ নেতা-কর্মীদের স্বল্প হাজতবাসের পর জামিন পেতে ভূমিকা রেখেছে বেঞ্চ। এছাড়া ঘুষ লেনদেনে জামিন খালাস নিয়ে আইনজীবীদের জরুরী সভায় রেজুলেশন করা হয়েছে।
এ রেজুলেশনে কলাপাড়া সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট চৌকি আদালতের জিআর-২২১/২০১৮, জিআর-৫০/২০২২, জিআর-২৮৭/২০২৭, জিআর-৯৭/২০১৯, জিআর-২৫২/২০২৮, জিআর-৪৪১/২০১৯, জিআর-২৪৮/২০১৮, সিআর-১৪৭/২০১৪, জিআর-৪২৪/২০২৯, সিআর-১২২৮/২০২৩, জিআর-৯৮/২০২৪ মামলা সহ বেশ কিছু মামলার তথ্য উঠে এসেছে।
উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের বিচার প্রার্থী আফজাল মুন্সী বলেন, 'আমি গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়ায় মামলার তারিখ কোর্টে আসতে পারি নাই। এতে আমার নামে ওয়ারেন্ট হয়। পুন:রায় পটুয়াখালী গিয়ে আমাকে জামিন নিতে হয়েছে। জমিন নিতে উকিল, মহুরী, পেশকার, পিয়নকে টাকা দিয়ে আমার অবস্থা বারোটা।'
টিয়াখালী ইউনিয়নের অপর বিচার প্রার্থী শাহাবুদ্দিন বলেন, 'চেকের উকিল নোটিশ দিয়েছি। এখন মামলা করার সময় প্রায় শেষ। দু'চার দিনে পটুয়াখালী গিয়ে মামলা করতে হবে, খরচের কথা যা শুনলাম তাতে কিভাবে মামলা করবো বুঝি না।'
নীলগঞ্চ ইউনিয়নের ভুক্তভোগী কৃষক গোলাম সরোয়ার বলেন, '১৬ বছর মামলা চালিয়ে আদালত থেকে জমির রায় পেয়েছি। জমির মূল্যের সমান ইতিমধ্যে খরচ হয়েছে। জমির বুঝ পেতে সরকারী খরচ ট্রেজারী চালানের মাধ্যমে আদালতে জমা দেয়ার পরও বেঞ্চ আমার কাছে ২৫ হাজার টাকা খরচ দাবী করে। আমি বাধ্য হয়ে হালের গরু বিক্রী করে তাদের টাকা দিয়েছি। এখন কি দিয়ে জমি চাষাবাদ করবো, এ নিয়ে দু:শ্চিন্তায় আছি।'
এদিকে কলাপাড়া চৌকি আদালত আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সালাম মিয়া তাঁর ভেরিফায়েড ফেজবুক পেইজে ২১ জুলাই এক ষ্ট্যাটাসে লেখেন, 'বিচারক শুন্য কলাপাড়া। আজ ৫১ দিন কলাপাড়ায় জজ ও ম্যাজিস্ট্রেট দুই জনের একজনও নেই। পটুয়াখালী জেলা থেকে কলাপাড়ার কিছু কিছু অঞ্চলের দুরত্ব প্রায় ১৫০ কি.মি.। সেই বিবেচনায় সরকার কলাপাড়ায় চৌকি আদালতের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু চৌকি আদালতের বিচারকদের বদলি একজন বিচারকও না দিয়ে? ভাবতে অবাক লাগে। হাজার হাজার মামলার জট। বিচারপ্রার্থী মানুষের দুর্ভোগ, ভূমি দস্যু কর্তৃক ভূমি দখল, শান্তি শৃঙ্খলার অবনতি, চুরি, ডাকাতি, খুন জখম সহ সকল প্রকার অপরাধ মুলক কাজ দিন দিন বেড়েই চলেছে। যার মুল কারন বিচারক শুন্য কলাপাড়া।'
কলাপাড়া চৌকি আদালতের সহকারী সরকারী কৌশুলী অ্যাডভোকেট মেহেদী হাসান রুবেল বলেন, 'সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে বর্তমানে ৬ হাজার মামলা চলমান রয়েছে। এরমধ্যে ২ হাজার মামলা রয়েছে সরকারের বিরুদ্ধে। বিচারক মূন্যতায় এসব মামলায় বেঞ্চ শুধু তারিখ দিচ্ছে। নিস্পত্তি না হওয়ায় মামলার জট বাড়ছে।'
অ্যাডভোকেট রুবেল আরও বলেন,'সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে ৩ হাজার মামলা চলমান রয়েছে। বর্তমানে পটুয়াখালী গিয়ে সপ্তাহে দুই দিন নালিশী মামলা দায়ের ও জামিন শুনানী হচ্ছে। পটুয়াখালী গিয়ে মামলার কার্যক্রমে অংশ নেয়া আইনজীবী কিংবা ফরিয়াদীদের জন্য দুরুহ হয়ে পড়েছে।'
এ সব অভিযেগের বিষয়ে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট চৌকি আদালতের বেঞ্চ সহকারী মো. কাইউম রাসেল বলেন, 'পটুয়াখালী মামলার নথি নিয়ে আসা যাওয়া খরচের জন্য চৌকি আদালত আইনজীবী সমিতির সভাপতি মামলার নথি পুট অফে ৫০০ টাকা হারে খরচ নিতে বলেছে। এর বেশী নেয়া হচ্ছে না।'
জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. হুমায়ুন কবির বলেন, 'বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি জেনে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবো।'
প্রসংগত, ১৯৮৩ সালে কলাপাড়া থানা সদরের অফিস মহল্লা এলাকায় একতলা আদালত ভবন নির্মাণ করা হয়। শুরুতে এই ভবনে ফৌজদারি বিচারকাজ পরিচালিত হতো। ১৯৮৬ সালে ভবনের পূর্ব পাশের অংশে ‘মুনসেফ আদালত’ (বর্তমানে দেওয়ানি আদালত) চালু হয়। এরপর ১৯৯২ সালে উপজেলা থেকে মুনসেফ আদালত সরিয়ে নেওয়া হয়। পুনরায় ২০১১ সালের ২৪ এপ্রিল দেওয়ানি বিচারকাজের জন্য সহকারী জজ আদালতের কার্যক্রম চালু হয়। তবে নিম্নমানের উপকরন সামগ্রী দিয়ে ভবন তৈরীতে ২০১৬ সাল নাগাদ জরাজীর্ন ওই আদালত ভবনের দেয়াল, ভিম ও পিলার ভেঙ্গে পড়ায় এটিকে পরিত্যক্ত ঘোষনা করা হয়। সেই থেকে বর্তমান অবধি পৌরসভার অব্যবহৃত স্বল্প পরিসরের পানি শাখা ভবনে চলে আসছে বিচার বিভাগের কার্যক্রম। যেখানে দূর দূরান্ত থেকে আসা বিচারপ্রার্থী মানুষ কষ্ট করে হলেও আদালতে এসে বিচারিক কার্যক্রমে অংশ নিয়ে আসছিল। এরপর উভয় আদালতের বিচরককে ২৪'র জুলাই আন্দোলনের পর একই আদেশে অন্যত্র বদলী করা হয়। বিচারক শূন্য হয়ে পড়ে কলাপাড়া চৌকি আদালত।
Comments