Image description

প্রযুক্তি জগতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই নিয়ে চলছে তীব্র প্রতিযোগিতা। এরই মধ্যে চীনের স্টার্ট-আপ প্রতিষ্ঠান ডিপসিক বাজারে নিয়ে এসেছে একটি কম খরচের এআই অ্যাপ, যা প্রযুক্তি বাজারে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ডিপসিকের তৈরি চ্যাটবট তুলনামূলকভাবে কম দামের চিপ ব্যবহার করে এবং ডেটার ব্যবহারও অনেক কম বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এই উদ্ভাবন এআই বাজারে নতুন আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।

এতদিন ধারণা ছিল যে কার্যকর ও অত্যাধুনিক এআই সেবা দিতে প্রয়োজন অত্যন্ত শক্তিশালী এবং উন্নত চিপসেট। নিত্যনতুন এআই প্রযুক্তি আরও বেশি ডেটা ব্যবহার করবে, এমনটাই ধরে নিয়ে এআই বাজার পরিচালিত হচ্ছিল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য একের পর এক অত্যাধুনিক ও দামি চিপ বাজারে আনা হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে চীনের স্টার্ট-আপ ডিপসিক একটি সত্যিকারের বিপ্লব ঘটিয়েছে, যা এআই বাজারের পুরো সরবরাহ ব্যবস্থাকেই কাঁপিয়ে দিয়েছে।

চলতি জানুয়ারিতেই ডিপসিক তাদের চ্যাটবট, ডিপসিক-আর১ বাজারে উন্মোচন করে। ইতোমধ্যেই এটি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং চীনের অ্যাপল অ্যাপ স্টোরে শীর্ষস্থানীয় বিনামূল্যের অ্যাপের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। এর মাধ্যমে ডিপসিক চ্যাটজিপিটিসহ এ বাজারের প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য চ্যাটবটকে পেছনে ফেলতে সক্ষম হয়েছে।

এটি কেবল প্রযুক্তিগত দিক থেকেই নয়, ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বৈশ্বিক প্রযুক্তির প্রতিযোগিতায় দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। এতদিন এআই শিল্পের প্রধান উদ্ভাবনগুলো যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে, এবং দেশটি এআই শিল্পের নেতা হিসেবে বিবেচিত হতো। কিন্তু ডিপসিকের সাফল্য সেই অবস্থানকেও প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।

ডিপসিক-ভি৩ নামে একটি ওপেন সোর্স মডেলের মাধ্যমে পরিচালিত হয় ডিপসিকের চ্যাটবট, যা তৈরি করতে মাত্র ৬০ লাখ ডলার ব্যয় হয়েছে বলে দাবি করেছেন এর উদ্ভাবকরা। অথচ অন্যান্য এআই নির্মাতারা একই ধরনের প্রযুক্তি তৈরিতে শত শত কোটি ডলার ব্যয় করেছে।

ডিপসিকের এই দাবি নিয়ে এআই শিল্পে চলছে তুমুল বিতর্ক। অনেকেই এমন অল্প খরচে এমন উন্নত মডেল তৈরির কথা বিশ্বাস করতে পারছেন না, আবার কেউ কেউ ভিন্ন মত প্রকাশ করছেন। এক কথায়, ডিপসিকের অ্যাপটিকে ঘিরে প্রযুক্তি দুনিয়ায় ব্যাপক শোরগোল চলছে।

এই মাসের শুরুর দিকে ডিপসিক-আর১ উন্মোচনের সময় প্রতিষ্ঠানটি দাবি করে যে, ভাষার যৌক্তিক বিশ্লেষণ, গণিত এবং কোডিংয়ের ক্ষেত্রে তাদের চ্যাটবট চ্যাটজিপিটির সমতুল্য পারফরম্যান্স প্রদান করতে সক্ষম।

যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালিতে প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগকারী ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উপদেষ্টা মার্ক অ্যান্ড্রেসেন ডিপসিক-আর১-কে এই শিল্পের ‘স্পুটনিক মুহূর্ত’ বলে আখ্যা দেন। তিনি এর মাধ্যমে ১৯৫৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ঐতিহাসিক সাফল্যের কথা স্মরণ করান, যখন তারা মহাকাশে প্রথম স্যাটেলাইট পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলেছিল। সেই ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হয়েছিল, যা তাদের মহাকাশ প্রতিযোগিতায় আরও উৎসাহিত করেছিল। অ্যান্ড্রেসেন ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, ডিপসিক এআই শিল্পে একই ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।

চীনের এই সাফল্যের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। বাইডেন প্রশাসনের সিদ্ধান্তে চীনে যুক্তরাষ্ট্রের নকশায় তৈরি কিংবা উৎপাদিত অত্যাধুনিক চিপের রপ্তানি নিষিদ্ধ করা হয়। এর ফলে চীন অত্যাধুনিক চিপের সরবরাহ সংকটে পড়ে। এমনকি চিপ নিষেধাজ্ঞা সম্প্রসারিত করতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। ঠিক এই পরিস্থিতিতেই বাজারে আসে ডিপসিকের চ্যাটবট, যা কম দামের চিপ ব্যবহার করেই কার্যকরভাবে কাজ করতে পারে। এর মানে, চিপ নিষেধাজ্ঞা চীনা গবেষকদের বিকল্প এআই উদ্ভাবনে প্রণোদনা দিয়ে থাকতে পারে। চীনের সরকারও এআই গবেষণায় বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ করছে।

শিল্প বিশেষজ্ঞদের মতে, আমদানি করা চিপের নিশ্চিত সরবরাহ ছাড়াই চীনের এআই ডেভেলপাররা নিজেদের মধ্যে জ্ঞান ও প্রযুক্তি শেয়ার করেছেন এবং নতুন সমাধান খুঁজতে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন। এর ফলেই এমন এআই মডেল তৈরি সম্ভব হয়েছে, যা তুলনামূলকভাবে কম যান্ত্রিক গণনাশক্তি বা কম্পিউটিং পাওয়ার ব্যবহার করে। ফলে ডিপসিকের এআই মডেল তৈরিতে খরচ অনেক কম হয়েছে, যা এআই শিল্পের প্রচলিত ব্যবস্থাকে ওলটপালট করে দিতে পারে।

এই উদ্ভাবনের প্রভাব ইতোমধ্যেই দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজারে এনভিডিয়া, মাইক্রোসফট ও মেটা-সহ এআই সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর শেয়ারদরে পতন ঘটেছে। ইউরোপের বাজারও এর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। নেদারল্যান্ডসের বিখ্যাত চিপ উৎপাদন যন্ত্রনির্মাতা এএসএমএল-এর শেয়ারদর ১০ শতাংশের বেশি কমেছে, আর সিমেন্স এনার্জির বাজারদরে প্রায় ২১ শতাংশ পতন হয়েছে।

সিটি ইনডেক্সের জ্যেষ্ঠ বাজার বিশ্লেষক ফিওনা সিনকোট্টা বলেন, "চীন যে স্বল্পমূল্যের এআই মডেল নিয়ে আসতে পারে, তা কেউই আগে অনুমান করতে পারেনি। ফলে এই চমকের ধাক্কা পুঁজিবাজারে লেগেছে। যদি ভোক্তারা কম খরচে একটি কার্যকর এআই মডেল পেতে শুরু করে, তবে প্রতিযোগী এআইগুলোর মুনাফা হ্রাস পাবে। বিদ্যমান এআই অবকাঠামোতে যে বিপুল বিনিয়োগ হয়েছে, তার ফলেও এসব সেবার খরচ বেশি।"

সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক প্রযুক্তি খাতের বিনিয়োগ পরামর্শদাতা ভে-সার্ন লিং বলেন, "ডিপসিক এআই সাপ্লাই চেইনের বিনিয়োগকেই পুরোপুরি ব্যাহত করতে পারে।"

মানবকণ্ঠ/এসআর