
যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির সাবেক নেতা জেরেমি করবিন এবং সদ্য পদত্যাগী লেবার এমপি জারা সুলতানা একটি নতুন বামপন্থী দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন।
ব্রিটেনের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার লেবার পার্টি থেকে পদত্যাগের পরপরই জারা সুলতানা ঘোষণা করেন, জেরেমি করবিনের সঙ্গে তিনি এই নতুন দলের সহনেতৃত্ব দেবেন। যদিও নতুন দলটির এখনো কোনো নাম ঘোষণা করা হয়নি। জারা সুলতানা জানিয়েছেন, এতে অন্যান্য স্বতন্ত্র এমপি, প্রচারকর্মী এবং অ্যাকটিভিস্টরা যুক্ত হবেন।
পাঁচ বছর আগে জেরেমি করবিনকে লেবার পার্টি থেকে বহিষ্কার তৎকালীন লেবার নেতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার।
এই পদক্ষেপ ব্রিটেনের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি বড় বিভক্তির আশঙ্কা তৈরি করেছে। ডানপন্থীদের মধ্যে রিফর্ম ইউকে এবং কনজারভেটিভদের মধ্যকার বিভাজন ব্রিটেনের রাজনীতিতে নানা উত্থান-পতনের কারণ হয়েছে। এবার বামপন্থীদের মধ্যকার বিভাজন ব্রিটেনকে বহুদলীয় জটিল রাজনীতিতে ঠেলে দেবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, একটি নতুন বামপন্থী দল গঠিত হলে তারা ১০ শতাংশ ভোট পেতে পারে। এটি হলে ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির জন্য হবে বড় ধাক্কা। সে ক্ষেত্রে লেবার পার্টি এবং কনজারভেটিভ উভয়ই ২০ শতাংশ ভোট নিয়ে সমানে সমান থাকতে পারে।
নতুন দলের ঘোষণা দিয়ে জারা সুলতানা বলেছেন, পরবর্তী নির্বাচন হবে ‘সমাজতন্ত্র বনাম বর্বরতার’ মধ্যে একটিকে বেছে নেওয়া। কভেন্ট্রি সাউথের এই এমপি বলেন, নতুন দল কিয়ার স্টারমার সরকারের কল্যাণমূলক ভাতা কমানোর চেষ্টার বিরুদ্ধে লড়াই করবে। গত সপ্তাহে হাউস অব কমন্সে এই বিল পাস করাতে ব্যর্থ হয়েছেন স্টারমার। এ ছাড়া, গাজায় যা ঘটছে তাকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করে ফিলিস্তিনের পক্ষে আরও সোচ্চার হবেন বলেও জানিয়েছেন জারা।
রাজনীতি বিশ্লেষকেরা বলছেন, জারা সুলতানার এই ঘোষণা কিয়ার স্টারমারের ওপর আরও বামপন্থী নীতি গ্রহণের জন্য চাপ তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে তিনি কল্যাণমূলক ভাতাদি কমানোর পরিকল্পনা থেকে অপমানজনকভাবে সরে আসার মাত্র কয়েক দিন পরেই এ ঘটনা ঘটল। তাঁর নিজের দলের ৪৯ জন এমপি এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছেন। এই বিলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সুবিধা কমানোর প্রস্তাব রয়েছে।
জারা সুলতানা ও জেরেমি করবিন আশা করছেন, লেবার পার্টির বহু সমর্থক যারা কিয়ার স্টারমারের পরিকল্পনার বিরোধিতা করছেন, তাঁরা তাঁদের নতুন দলে যোগ দেবেন।
এক্স-এ দেওয়া এক বার্তায় জারা সুলতানা জানিয়েছেন, ১৪ বছর পর তিনি লেবার পার্টি থেকে পদত্যাগ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘জেরেমি এবং আমি দেশজুড়ে অন্যান্য স্বতন্ত্র এমপি, প্রচারকর্মী এবং অ্যাকটিভিস্টদের সঙ্গে একটি নতুন দল গঠনে সহনেতৃত্ব দেব।’
তিনি আরও বলেন, ‘এক বছর আগে আমাকে লেবার পার্টি থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল, কারণ আমি দুই সন্তানের সুবিধা বাতিল করার পক্ষে ভোট দিয়েছিলাম এবং ৪ লাখ শিশুকে দারিদ্র্য থেকে তুলে আনতে চেয়েছিলাম। আমি আবারও তা করব। আমি পেনশনভোগীদের জন্য শীতকালীন জ্বালানি ভাতা বাতিল করার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলাম। আমি আবারও তা করব।’
জারা সুলতানা ওই পোস্টে ব্রেক্সিট আন্দোলনের অন্যতম নেতা নাইজেল ফারাজের নেতৃত্বাধীন রিফর্ম ইউকেরও সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘বিলিয়নিয়ারদের টাকায় চলা একজন ধোঁকাবাজকে বিভিন্ন জরিপে এগিয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে, কারণ লেবার পার্টি মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।’
গাজায় চলমান পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, ‘ফারাজ থেকে স্টারমার পর্যন্ত রাজনৈতিক বলয়ের সবাই গাজায় গণহত্যা বন্ধ করার চেষ্টা করা বিবেকবান মানুষকে সন্ত্রাসী হিসেবে অপবাদ দিচ্ছে। কিন্তু সত্য স্পষ্ট—এই সরকার গণহত্যার সক্রিয় অংশীদার। ব্রিটিশ জনগণ এর বিরোধিতা করছে। আমরা আর এটা সহ্য করব না।’
অভিবাসন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের গত মাসের বক্তব্যেরও সমালোচনা করেন জারা সুলতানা। কিয়ার স্টারমার বলেন, ব্রিটেন ‘বিদেশিদের দ্বীপ’ হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। জারা সুলতানা বলেন, ‘আমরা বিদেশিদের দ্বীপ নই—আমরা এমন দ্বীপ, যেখানে ভোগান্তি রয়েছে। আমাদের এমন বাসস্থান এবং জীবন দরকার, যার ব্যয় আমরা বহন করতে পারি। এমন বিল নয়, যা আমরা প্রতি মাসে মুষ্টিমেয় কিছু এলিটকে দিই, যারা নগদ টাকায় ডুবে আছে। আমাদের অর্থ জনসেবায় ব্যয় করা দরকার, অনন্ত যুদ্ধে নয়।’
জারা সুলতানা আরও যোগ করেন, ‘২০২৯ সালে কোনটি বেছে নেবেন সেটি স্পষ্ট হবে—সমাজতন্ত্র বা বর্বরতা। বিলিয়নিয়ারদের জন্য ইতিমধ্যেই তিনটি দল লড়াই করছে। বাকিদের জন্য একটি দল থাকুক, সেই সময় এসেছে। আমাদের সঙ্গে যোগ দিন। এখনই সময়।’
এক্স-এর বার্তায় ‘টিম জারা’-তে যোগদানের জন্য একটি লিংকও দেওয়া হয়েছে।
জেরেমি করবিন ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত লেবার পার্টির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বর্তমানে ইজলিংটন নর্থের স্বতন্ত্র এমপি। তিনি এখনো জারা সুলতানার ঘোষণার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।
তবে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে একটি খবর ছড়িয়েছে, তিনি নতুন দলে যোগ দিতে রাজি হননি। যদিও এর আগে গত বুধবার রাতে আইটিভির রবার্ট পেস্টনকে তিনি বলেছিলেন, একটি নতুন বামপন্থী দল গঠনের জন্য কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘একটি বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে এবং সেখানে একটি বিকল্প উত্থাপিত হবে, যা দারিদ্র্য, অসমতা এবং যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তির ওপর ভিত্তি করে একটি পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কাজ করবে।’
জেরেমি করবিনের ছায়া চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী জন ম্যাকডনেল অবশ্য নতুন দলে যোগ দেওয়ার বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি এক্স-এ পোস্ট করেছেন, ‘জারাকে লেবার পার্টি থেকে হারিয়ে আমি অত্যন্ত দুঃখিত। বর্তমানে লেবার পার্টি যারা চালাচ্ছেন তাঁদের নিজেদেরই জিজ্ঞাসা করা উচিত কেন একজন তরুণ, স্পষ্টভাষী, প্রতিভাবান, অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ সমাজতান্ত্রিক অনুভব করেন যে তাঁর এখন লেবার পার্টিতে কোনো জায়গা নেই এবং তাঁকে দল ছাড়তে হবে।’
উল্লেখ্য, জেরেমি করবিনকে ২০২০ সালে লেবার পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়। কারণ তাঁর নেতৃত্বে দলের মধ্যে ইহুদি-বিদ্বেষ বেড়ে যাওয়ার অভিযোগে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি সেই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
গত মাসে জারা সুলতানা প্যালেস্টাইন অ্যাকশন নামে একটি গ্রুপকে সমর্থন করে এক্স-এ ‘আমরা সবাই প্যালেস্টাইন অ্যাকশন’ লিখে সমালোচিত হন। এ ছাড়া, গত বুধবার রাতে হাউস অব কমন্সে সন্ত্রাসী আইনের অধীনে এই গ্রুপটিকে নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে ভোট দেন তিনি।
২০২০ সালে জারা একটি বিলের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন, যা কার্যকর হলে দলত্যাগী এমপিদের উপনির্বাচনের মুখোমুখি হতে হতো।
এদিকে গ্রিন পার্টির প্রধান পদে প্রতিদ্বন্দ্বী জ্যাক পোলানস্কি নতুন দলের সঙ্গে কাজ করার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি। তিনি এক্স-এ পোস্ট করেছেন, ‘যারা টোরি, রিফর্ম এবং এই ব্যর্থ লেবার সরকারের মোকাবিলা করতে চায়, তারা আমার বন্ধু। বাস্তবে এটি কেমন দেখায় তা দেখার অপেক্ষায় আছি।’
লেবার পার্টির একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘মাত্র ১২ মাসে, এই লেবার সরকার মজুরি বাড়িয়েছে, অতিরিক্ত ৪০ লাখ এনএইচএস অ্যাপয়েন্টমেন্ট সরবরাহ করেছে, ৭৫০টি বিনা মূল্যে প্রাতরাশের ক্লাব খুলেছে, তিনটি বাণিজ্য চুক্তি এবং চারটি সুদের হার হ্রাস করে লাখ লাখ মানুষের বন্ধকের (মর্টগেজ) কিস্তি কমিয়েছে। কেবল লেবারই ব্রিটেনকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে পারে।’
Comments